মুসলিমরা কি পাবে বাবরি মসজিদ?
মুসলিমরা কি পাবে বাবরি মসজিদ? - ছবি : সংগ্রহ
ভারতের উত্তর প্রদেশের ফয়েজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরের সুপ্রাচীন বাবরি মসজিদসংক্রান্ত ১৩৪ বছরের পুরনো মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার ক্ষণগণনা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এ মামলার চূড়ান্ত রায় আগামী ১৫ নভেম্বর বা তার আগেই প্রকাশ করার কথা রয়েছে। কারণ এই ১৫ নভেম্বর হচ্ছে ভারতের প্রধান বিচারপতি রাজন গগৈ-এর শেষ কর্মদিবস। তিনি এর দুই দিন পর ১৭ নভেম্বর অবসরে যাবেন। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি এই রায় দিয়ে যাবেন। এই কনস্টিটিউশন বেঞ্চে ভারতের প্রধান বিচারপতি ছাড়াও আরো রয়েছেন বিচারপতি এস এ ভবদে, বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রশূদ, বিচারপতি অশোকভূষণ ও বিচারপতি এস এ নাজির। সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা এ মামলার শুনানি চলছে এই কনস্টিটিউশন বেঞ্চে। এর আগে এলাহাবাদ হাইকের্টের লক্ষেèৗ বেঞ্চ ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এক আদেশে বলেছিলেন, বাবরি মসজিদের সাইটটি বিভক্ত করা হবে তিনটি অংশে : দু’টি অংশ যাবে হিন্দুদের পক্ষে আর একটি অংশ যাবে মুসলমানদের পক্ষে।
হিন্দুপক্ষের প্রতি মৌন সম্মতি রয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় ও ইউপি সরকারের। হিন্দুরা ইতোমধ্যেই এই রায় উৎসব পালনের হর্ষোৎফুল্ল মনোভাব নিয়ে অপেক্ষা করছে। এ ব্যাপারে সরগরম আলোচনা এখন আরএসএস, বিএইচপি, ভজরং দল, আখড়া পরিষদ, হিন্দুসেনা, এবিভিপি, হিন্দু মহাসভা, হিন্দুসমাজের মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে। এসব সংগঠনের প্রতিনিধিদের মধ্যে জোরালো আলাপ-আলোচনা চলছে, কী করে বাবরি মসজিদের সাইট ও এর লাগোয়া ১৯৯৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিগ্রহণ করা ৬৭.৭ একর জমি হিন্দু দাবিদারদের মধ্যে বিতরণ করা যায়। এসব দাবিদারদের মধ্যে আছেন নির্মোহী আখড়া, রাম জন্মভূমি ন্যাস, ভগবান শ্রী রাম লালা বিরাজমন প্রমুখ। ভারতের প্রায় প্রতিটি নিউজ চ্যানেল এখন সাগ্রহে অপেক্ষা করছে এই মামলার রায় প্রচারের জন্য। এর অ্যাঙ্কররা নানাভাবে কৌশলী প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে চেষ্টা-সাধ্যি চালিয়ে যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের আসন্ন এই রায় হিন্দুদের পক্ষে নেয়ার জন্য। মনে হচ্ছে, তাদের এই প্রয়াস অব্যাহত থাকবে এমনকি এই রায়ের আগের দিন পর্যন্ত। চার দিক থেকে ভীতি প্রদর্শন, প্রলুব্ধ করা, জবরদস্তিমূলক মৌন সম্মতি আদায় করা ও নানাধর্মী আক্রমণের প্রয়াসও জারি রয়েছে মুসলমানদের ওপর, যাতে মুসলমানেরা হিন্দুত্ববাদীদের ধ্বংস করা বাবরি মসজিদের স্থানটি রামমন্দির নির্মাণের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়।
যদিও কোনো ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যে, রামমন্দির ধ্বংস করে মুসলমানেরা এই স্থানে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছিল। হিন্দুত্ববাদীদের দাবি মালিকুল মুলক জহিরুদ্দিন বাবর ১৫২৮ সালে রামমন্দির ভেঙে সে স্থানে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। বিজেপির বড় বড় কিছু নেতা এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা এই দাবি তুলেই ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। শুধু এখানেই শেষ নয়, হিন্দুত্ববাদীরা ইতোমধ্যেই এক আন্দোলন শুরু করেছে কাশি ও মথুরার কিছু বিতর্কিত স্থানের ওপরও এ ধরনের মিথ্যা দাবি তোলে।
গত ১৭ অক্টোবর অল ইন্ডিয়া আখড়া পরিষদ ঘোষণা দিয়েছে- তারা খুবই আশাবাদী, আসন্ন সুপ্রিম কোর্টের রায় হিন্দুদের পক্ষে যাবে, আর বাবরি মসজিদসংক্রান্ত এই রায় হবে উল্লিখিত দু’টি মুখ্য বিতর্কিত স্থান-সংশ্লিষ্ট আন্দোলনের জন্য একটি কিক-স্টার্ট এবং পরবর্তী রাউন্ডে একইভাবে হিন্দুরা দাবি তুলবে ভারতের ৪০ হাজার মসজিদের ওপর। অথচ দূরতম কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই হিন্দুদের হত্যা ও রামমন্দির ধ্বংস করে সেখানে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। অন্য দিকে বাবরি মসজিদ যারা ধ্বংস করেছে তাদের বিরুদ্ধে ভারত সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় লোকদেখানো ফৌজদারি দু’টি মামলা মামলা এখনো চালু রাখা হয়েছে লক্ষেèৗয়ের একটি বিশেষ আদালতে। এ মামলা দু’টির নম্বর যথাক্রমে ১৯৭/৯৩ এবং ১৯৮/৯২। মামলা দু’টি জিইয়ে রাখা হয়েছে আইনের বাধ্যবাধকতা কিংবা সরকারের মুখরক্ষার কারণেই। প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দেয়ার জন্য নয়।
নিকটাতীতের ইতিহাস থেকে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়- ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ফয়েজাবাদ জেলার অযোধ্যার ৯০ শতাংশ ভূমির মালিক ছিল মুসলমানেরা। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর ফয়েজাবাদের উত্তর প্রদেশের বহু ভূমিমালিক মুসলমানেরা দলবদ্ধভাবে পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হয়। ১৯৪৯ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর উত্তর প্রদেশের কংগ্রেস-দলীয় মুসলিমবিদ্বেষী মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ ভল্লব পান্ত গোপনে লুকিয়ে রামমূর্তি বাবরি মসজিদে নিয়ে রেখে দেন এবং বাবরি মসজিদে তালা দিয়ে রাখা হয়। কিন্তু রিসিভার হিসেবে আদালত হিন্দুদের প্রার্থনার অনুমতি দেয়। এরপর মুসলমানদের সেখানে নামাজ আদায় বন্ধ হয়ে যায়। মওলানা মোজাফ্ফর হোসেন ১৯৫৪ সালে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান বাবরি মসজিদে নামাজ আদায়ের জন্য। কিন্তু পুলিশ তাতে বাধা দেয়। তা সত্ত্বেও কিছু মুসলমানেরা দেয়াল ডিঙিয়ে বাবরি মসজিদে ঢুকে নামাজ আদায় করেন। হাশিম আনসারী ছিলেন তাদেরই একজন। নামাজরত অবস্থায় পুলিশ তার একটি পা ভেঙে দেয়। তা ছাড়া তাকে ছয় মাসের জেল দেয়া হয়। হাশিম আনসারী বাবরি মসজিদ মামলার একজন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ২০১৬ সালের ২০ জুলাই ইন্তেকাল করেন। তার স্থানে এ মামলায় সংশ্লিষ্ট হন তার ছেলে ইকরাল আনসারী।
ভারত ভাগের কাজটি সুকৌশলে এমনভাবে করা হয়েছিল, যা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যায়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে। ইন্ডিয়ার হিন্দুরা ভাগ হয়নি, আসলে মুসলমানদের ভাগ করা হলো তিনটি ভাগে। হিন্দু কমিউনিটি একত্রেই রয়ে গেল। ১৯৪৭-এর পর অসুবিধা যা হলো, তা মুসলমানদেরই হলো। মুসলমানদের জন্য থাকল না কোনো লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড। হিন্দুরা একের পর এক তীর ছুড়তে লাগল মুসলমানদের ওপর। তাদের রক্ষার জন্য দোহাই দেয়া হলো শুধু সাংবিধানিক গ্যারান্টির। কিন্তু বিগত সাত দশক ধরে হিন্দুরা বারবার ঘটিয়েছে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
মুসলমানদের ঘরবাড়ি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান আগুনে পুড়ে ধবংস করা হয়েছে। আগের অসংখ্য দাঙ্গার কথা বাদ দিলেও নিকটাতীতে ২০০২ সালে গুজরাটে নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে গুজরাটের ভয়ঙ্কর রায়ট ঘটানো ছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের ভয়ঙ্কর কাজ। এসবের শেকড় নিহিত বাবরি মসজিদের ঘটনায়। ১৯৯৩ সালের পর থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে ড্রাকোনিয়ান আইন ঞঅউঅ/চঙঞঅ/টঅচঅ। এসব আইনকে হাতিয়ার করা হয়েছে মুসলিম নির্যাতনের। অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, নির্দোষ ব্যক্তিদের বছরের পর বছর ও দশকের পর দশক ধরে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে এসব আইনের আওতায়।
ভারতের মুসলমানদের সে দেশে টিকে থাকতে হচ্ছে মুসলিমবিদ্বেষী শক্তিগুলোকে মোকাবেলা করে। প্রথমে তাদের লড়তে হয়েছে কংগ্রেসিদের বিরুদ্ধে, আর আজ লড়তে হচ্ছে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে। আজ অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সেখানে প্রতিটি মুসলমানকে বসবাস করতে হচ্ছে যেকোনো সময় রাস্তাঘাটে হত্যার শিকার কিংবা নির্যাতনের শিকার হওয়ার হুমকি মাথায় নিয়ে। ভারতের দুর্ভাগা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ শানা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। এ পরিস্থিতি এমনি এমনি আজকের পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়নি। কংগ্রেস সরকারের আমলেই অঘোষিত রাষ্ট্রীয়নীতি অবলম্বন করা হয় : মুসলমানদের কৌশলে যথাসম্ভব সরকারি চাকরির বাইরে রাখতে হবে। ধীরে ধীরে সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। এর ফলে বলতে গেলে আজকে দেশটিতে মুসলমান চাকুরের সংখ্যা প্রায় নিঃশেষিত হওয়ার পথে। চাকরি ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের একটা সম্যক চিত্র আমরা দেখতে পাই কয়েক বছর আগে প্রকাশিত সাচার কমিটির রিপোর্টে। নিশ্চিতভাবেই সে পরিস্থিতি এখন আরো খারাপের দিকে গেছে। সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আজকের ভারতে একটিও মসজিদ, দরগাহ, খানকাহ ও ইমাবাড়াও নিরাপদ নয়। হিন্দু রিয়েল এস্টেট মার্চেন্টরা নোংরা দৃষ্টি ফেলেছে এসবের সম্পত্তির ওপর। রেলওয়ের সম্পদের পরই এগুলোর ভূমি-সম্পদের পরিমাণ সে দেশে সবচেয়ে বেশি। তা ছাড়া ভারতীয় মুসলমানদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে বিদেশী তথা পাকিস্তানি হিসেবে। মুসলিম এমপি আসাদ-উদ-দিন ওয়ায়েইসিকে বিজেপি এমপি সুব্রামনিয়াম স্বামী অভিযুক্ত করেছেন ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হিসেবে। অন্য দিকে শত শত হিন্দু সংগঠন ও অগণিত হিন্দু ব্যক্তিত্ব হিন্দুদের উদ্বুদ্ধ করছে অস্ত্র কেনার জন্য। আরএসএসের হাজার হাজার সদস্য ও তাদের সমর্থকেরা ইতোমধ্যেই অস্ত্র-প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আর তা অবাধে প্রকাশ্যে চলছে তিন দশক ধরে। সামাজিক গণমাধ্যমে তা তুলে ধরা হচ্ছে।
১৯৪৭ সালের আগে ও পরে ভারত ভুগেছে একই ধরনের জেনোফোবিয়া তথা বিদেশভীতিতে। সম্প্রতি ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা বাতিলের পর বিজেপির মন্ত্রীরা কাশ্মির ভূমির ওপর দৃষ্টি ফেলেছে। উত্তর প্রদেশের যোগী আদিত্য নাথের ইতিহাস রয়েছে মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্যের। সেখানে তিনি বলেছেন, ভারতে একজন হিন্দু মারা গেলে কোনো এফআইআর নেয়া হবে না। বরং এর বদলে ১০ জন মুসলমান হত্যা করা হবে। সেখানে তিনি এমন একটি অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছিলেন, যেখানে হিন্দুদের উচ্চ প্রশংসা করা হয় মুসলমান নারীকে কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করার জন্য। এ তথ্য জানা যায় ইউটিউবের একটি স্যাফরন ওয়ার ডকুমেন্টারি থেকে। এর পেছনে যুক্তি এরা খুঁজে পেয়েছে সাভারকারের কাছ থেকে, যিনি ধর্ষণকে বিবেচনা করতেন একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে। নিকটাতীতে জম্মুর কাঠুয়ায় ছোট্ট বালিকা আয়েশাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, আর সেখানে ধর্ষকের সমর্থনে শত শত হিন্দু র্যালি বের করেছিল।
এটি হচ্ছে সাভারকারের নীতি বাস্তবায়নের সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ। আর তাকেই নাকি এখন বিজেপি সরকার দিচ্ছে সর্বোচ্চ ভারতীয় বেসামরিক পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’। সমান্তরালভাবে বিজেপি প্রচার চালাচ্ছে জওয়াহেরলাল নেহরুর বিপরীতে সুভাষচন্দ্র বোস, সরদার প্যাটেল ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে এবং গান্ধীর বিপরীতে সাভারকার ও নথুরাম গডসেকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে। এমনও শোনা যাচ্ছে, ভারতীয় রুপিতে গান্ধীর ছবি সরিয়ে ছাপা হবে সাভারকারের ছবি। আর নথুরাম গডসেকেও দেয়া হবে ভারতরত্ম পুরস্কার। আর তা নাকি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের পর থেকেই। তখন থেকেই ভারতীয় মুসলমানরা উগ্র হিন্দুদের আগ্রাসনের শিকার। বাবরি মসজিদ সমস্যাটির শুরু ১৯৫০ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
তখন রামমূর্তি বাবরি মসজিদে রেখে গোপাল সিং বিশারদ সেখানে পূজা করার জন্য হিন্দুদের প্রতি আহ্বান জানান। তখন ২২ জন মুসলমান ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৪৫ ধারার আওতায় ফয়েজাবাদের সিটি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে একটি এফিডেভিট দাখিল করেন। এই এফিডেভিটে বলা হয়- বাবরি মসজিদ হিন্দুদের দিয়ে দেয়া হোক। এমনকি যারা বাবরি মসজিদে নামাজ আদায় করেছিলেন, তারাও এই এফিডেভিডে স্বাক্ষর করেছিলেন। এবং বলা হয়, এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বাবরি মসজিদ সারেন্ডার করাই একমাত্র উপায়। কিন্তু এই এফিডেভিড যথাযথভাবে ড্রাফট করা হয়নি, যথাযথভাবে পরীক্ষা করা হয়নি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয়ও শনাক্ত করা হয়নি। ফলে এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষেèৗ বেঞ্চের ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের রায়ে এটি পালনে বাধ্যবাধকতার কথা ছিল না।
দয়াল খান্না ও নির্মল দাসের মতো কংগ্রেস নেতারা ১৯৮৪ সালে রামমন্দির লিবারেশন রথযাত্রা শুরু করেন বিহারের সীতামহরি থেকে। এর পর থেকে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন প্রায় সব হিন্দুই দাবি তোলে, বাবরি মসজিদ পুরোটাই রাম জন্মভূমি থেকে সরিয়ে নিতে হবে। এ ধরনের দ্বিতীয় রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে। এতে সারা দেশে রক্তাক্ত দাঙ্গা সংঘটিত হয়। কানপুরের মুসলমানেরা এ সমস্যা সমাধানকল্পে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের এক সভা ডাকে। এম এ সিদ্দিকী ছিলেন বাবরি মসজিদ আন্দোলনের অন্যতম এক স্তম্ভ।
তিনি এই বৈঠকে ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি। মওলানা আবদুল করিম পারেখসহ মওলানা সাজ্জাদ নোমানীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তর্কবিতর্ক চলছিল, মুসলমানেরা বাবরি মসজিদের দাবি ছেড়ে দেবে কি দেবে না। এমনি পরিস্থিতেতে মওলানা সাজ্জাদ নোমানী তার অভিমত দেন : ‘Halaat ke jabr se Musalman Babri Masjid ka difa na kar sakein to shayad Allah unhein Muaaf kar de lekin Masjid ke baare mein koi muhaida nahi kiya ja sakta (Allah may forgive Muslims for not defending Babri Masjid under atrocious circumstances but a compromise on a mosque cannot be forged')।
এই অভিমতের পর এই বোর্ড এক প্রস্তাব পাস করে। এর মাধ্যমেই বাবরি মসজিদ নিয়ে আন্দোলনের কবর দেয়া হয়। কিন্তু মওলানা ওয়াহিদ উদ্দিন খান এবং আরো পরে মওলানা কালবি সাদিক সালমান নদভী (উভয়ই উল্লিখিত মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের) ‘শিয়া অ্যান্ড সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, চেয়ারম্যান ওয়াসিম রিজভী ও জাফর ফারুকির সাথে মিলে মত দেন বাবরি মসজিদ হিন্দুদের দিয়ে দেয়া হবে, সেখানে রামমন্দির নির্মাণের জন্য। এ যেন বাবরি মসজিদ বিক্রি করা হলো কারো ব্যক্তিগত স্বার্থের বিনিময়ে।
বাবরি মসজিদের ওপর মুসলমানদের দাবি ত্যাগের এই অনুশীলন নতুন কিছু নয়।
কংগ্রেস ইউনিয়ন মিনিস্টার বুতা সিং অল ইন্ডয়া শিয়া কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট আনজুম কাদের, বাবরি মসজিদের সর্বশেষ মোতওয়াল্লি (ট্রাস্টি) জাওয়াদ হোসেনকে এ ব্যাপারে রাজি করান। শিয়া ওয়াকফ বোর্ড ১৯৮৯ সালে লক্ষেèৗ হাইকোর্টে বাবরি মসজিদের দাবি পরিত্যাগের কথা পেশ করার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা এগোয়নি।
পরবর্তী সময়ে যখন এনডিএ নামের জোট ক্ষমতায় (১৯৯৯-২০০৪) তখন আসগর আব্বাস ও ক্যাপ্টেন সিকান্দর রিজভী এতে সংশ্লিষ্ট হন। ২০১০ সালে ৩০ সেপ্টেম্বরের পর কালবি জাওয়াদের জ্ঞাতি ভাই শামিল শামসি রামমন্দির নির্মাণের জন্য ১৫ লাখ রুপি দেয়ার প্রস্তাব দেন। এমনকি বুক্কাল নওয়াব বিজেপিতে যোগ দেয়ার আগে লর্ড রামের জন্য ১০ লাখ গোল্ডেন ক্রাউন দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
সর্বশেষ স্যালভো হিসেবে জাফর ফারুকি গত ১৭ অক্টোবর মামলার শুনানির ৪০তম দিনে তিন-সদস্যের মেডিয়েটেশন প্যানেলের (সুপ্রিম কোর্টের আদেশে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল গত ৮ মার্চ) কাছে পেশ করেছেন এই মর্মে একটি ‘নো-অবজেকশন’ যে, বাবরি মসজিদ সাইট সরকার অধিগ্রহণ করতে পারে এবং এরপর তা সারেন্ডার করতে পারে জনসমক্ষে প্রকাশিত সুনির্দিষ্ট শর্তের আওতায়, যা সুপ্রিম কোর্টে আদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সুপ্রিম কোট বলেছে, ‘অ্যাটমোস্ট কনফিডেন্সিয়ালিটির’ কথা। এ মামলাটি নিয়ে লড়ছেন এমন সব মুসলিম পার্টি ফারুকির অবস্থানের সাথে একমত নয়। মজার ব্যাপার হলো, এর মাত্র তিন দিন আগে ১৪ অক্টোবর আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর জমির-উদ-দিন শাহ, রিটায়ার্ড আইএএস আনিস আনসারি, পদ্মশ্রী মনসুর হাসান ও সাবেক আইপিস প্রমুখ ব্যক্তি সমবেত হয়েছিলেন লক্ষেৌর হায়াত রিজেন্সি হোটেলে। তারা ‘ইন্ডিয়ান মুসলিমস ফর পিস’ হিসেবে শুভেচ্ছাস্বরূপ বাবরি মসজিদ সাইট হিন্দুদের দিতে চান। তাদের বিরোধিতা করে ‘মুসলিম মজলিস’।
এর সদস্যরা বৈঠকস্থলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা বলেন- বাবরি মসজিদের এই বিক্রি করে দেয়া আমরা মানি না, সুপ্রিম কোর্টের রায়ই মুসলমানদের কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য। ১৯৪৭ সালের পর মুসলিম মজলিস ছিল মুসলমানদের প্রথম সুষ্ঠু ও সুসংগঠিত পলিটিক্যাল ভয়েস। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবদুল জলিল ফরিদি। এটি উত্তর প্রদেশের অনেক অ্যাসেম্বলি সিটে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম মজলিস ১৯৮৪ সালের পর আর এগিয়ে যেতে পারেনি, তখন এর সর্বশেষ এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন ফজলুর বারী। ১৯৮৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারির বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির একজন ছিলেন ফজলুল বারী। এর ৫ দিন আগে রাজিব গান্ধী বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেন। এখন যারা বাবরি মসজিদ হিন্দুদের দিয়ে দেয়ার কাজে অতি উৎসাহী, এর আগে তাদের কেউ জীবনে বাবরি মসজিদের জন্য কোনো অর্থসহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসেননি।
মুসলমানরা সবসময় বলে আসছে তারা সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নেবে। আর হিন্দুরা এমনকি সুপ্রিম কোর্টকে হুমকি দিয়ে বলেছে, রায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সেন্টিমেন্ট অনুযায়ী হতে হবে। এটি দেশটির আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের জন্য আদালতের কাছে একটি বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন জনমনে এমন একটি ধারণার জন্ম হয়েছে যে, হিন্দুরা শুধু অযোধ্যার বাবরি মসজিদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে না। বরং কাশি ও মথুরার বিতর্কিত সাইট ছাড়াও এরা চাইবে তাজমহল, কুতুবমিনার, লালকিল্লা, বড় ইমামবাড়া, গোল গম্বুজ, চার্মিনার ইত্যাদি সবকিছু। এমনকি ভারতের হাজার হাজার মসজিদও। এই সবকিছুই এরা দখলে নেবে, আগে কিংবা পরে। সে কারণেই ভারতের পার্লামেন্টে ইউনিফর্ম সিভিল কোড পাস করে এসব থামাতে হবে। কাশ্মিরকে ইতোমধ্যেই বগলদাবা করেছে ভারত। বাবরি মসজিদও রামমন্দির হওয়ার পথে এবং সর্বশেষ কাজটি হবে ভারতকে একটি হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা, যেখানে মনুসংহিতা হবে দেশটির সংবিধান। এসব ঠেকাতে আসন্ন সুপ্রিম কোর্টের রায় কাজে লাগাতে হবে নিয়ামক হিসেবে।