আবরারের মার আর্তনাদে কাঁপছে খোদার আরশ
আবরারের মার আর্তনাদে কাঁপছে খোদার আরশ - ছবি : সংগ্রহ
‘পোস্টমর্টেম’ শব্দের বাংলা অর্থ, মৃত্যুপরবর্তী। একজন ব্যক্তির মৃত্যু নানাভাবে হতে পারে। স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যু।
রোগ-ব্যাধি থেকে অথবা বার্ধক্যজনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো পোস্টমর্টেম সাধারণত করা হয় না। তবে ইউরোপ, আমেরিকায় সব মৃত্যুর জন্য পোস্টমর্টেম বাধ্যতামূলক। মৃত্যু নিয়ে তারা গবেষণা করে থাকেন। মৃত্যুর কারণ পাশ্চাত্যের খুব বড় বিষয়। কী কারণে মৃত্যু হলো- খাদ্যের ঘাটতি, চিকিৎসার অব্যবস্থা, ভেজাল বা নকল ওষুধ, পরিবেশে প্রতিকূলতা যেমন বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ইত্যাদি। সর্বোপরি তারা গবেষণা করেন কোন রোগ, ব্যাধি বা পীড়ায়, কোন এলাকায় কিভাবে কত লোক মৃত্যুবরণ করে তার বিস্তারিত কারণ নির্ণয় এবং তা বন্ধের বা কমানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করার জন্য।
পাশ্চাত্যের এই ব্যাপক গবেষণার মধ্য থেকে ক. খাদ্যের ঘাটতি; খ. চিকিৎসার ব্যবস্থা, ভেজাল বা নকল ওষুধ; গ. পানিদূষণ, সুপেয় পানির অভাব; ঘ. বায়ুদূষণ ইত্যাদি। বিষয়গুলো নিয়ে নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা করতে চাই। দীর্ঘকাল লন্ডনে থাকাকালে কলকারখানা, হোটেল, হাসপাতালে কাজে লিপ্ত ছিলাম। ব্রিটিশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ ও পরিবহন দফতরে নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেছি। ক. সুষম খাদ্য গ্রহণ করে বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠ ও পেনশনারেরা। মাছ, গোশত, সবজি, ফলমূল রুটিন মতো খেয়ে থাকেন। খাদ্যের মান ও বিশুদ্ধতা সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। খাদ্যে ভেজাল দেয়া বা বাসি খাদ্য সরবরাহ ও বিক্রির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। খ. সব নাগরিকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সর্ব প্রকার চিকিৎসা সেবা রাষ্ট্র দিয়ে থাকে। শিশু, বৃদ্ধ, সার্বক্ষণিক অসুস্থ ডায়াবেটিস রোগী ও সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বিনামূল্যে সর্ব প্রকার ওষুধ স্বাস্থ্য দফতর সরবরাহ করে থাকে। অন্যান্য ক্ষেত্রে আংশিক মূল্যে রাষ্ট্র ওষুধ দেয়। ওষুধ প্রস্তুত ও সরবরাহকারীদের অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ওষুধে ভেজাল, নিম্নমান পরিহার অথবা সময়সীমা রক্ষা করা সব ফার্মাসিস্টের দায়িত্ব। নকল ওষুধ ও প্রস্তুতকারীদের কঠোর শাস্তি হয়ে থাকে- মোটা দাগে জরিমানা, এমনকি ফার্মেসির লাইসেন্স বাতিল করা হয়ে থাকে।
নির্দিষ্ট লাইসেন্সপ্রাপ্ত ছাড়া এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট ব্যতীত কোনো ফার্মেসি চলতে দেয়া হয় না। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার জিপির (জেনারেল প্র্যাকটিশনার) লিখিত ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কাউকে ওষুধ সরবরাহ করা আইনত নিষিদ্ধ। যত্রতত্র ফার্মেসি থাকার প্রশ্নই আসে না। শিশুদের কাছে ওষুধ বিক্রয় একেবারেই নিষিদ্ধ।
গ. সুপেয় স্বচ্ছ নির্মল পানি সরবরাহ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ১৮ বছর লন্ডনে বাসকালে সরবরাহকৃত পানিতে কোনো ময়লা আবর্জনা বা ভাসমান কোনো কিছু দেখিনি। জনগণ ট্যাংকের পানি সরাসরি পান করে থাকে কর্মস্থলে, কী কলকারখানায়, কী স্কুল বা হাসপাতালে। পানি ফুটাতে হয় না বা ছাঁকতে হয় না। ঘ. বায়ুদূষণ তথা বাতাসে ধূলিকণা, পেট্রলের গন্ধ, অতিরিক্ত কার্বন একটি বড় সমস্যা। উত্তর লন্ডনের দিকে কলকারখানার এলাকায় যেমন ম্যানচেস্টার, উলভারহ্যাম্পটন, বার্মিংহাম এলাকায় বাতাসে এবং শীতের সময় কুয়াশার সাথে কারখানার নির্গত গ্যাস মিশে গিয়ে যে ঘন কুয়াশার সৃষ্টি হয়, তাকে স্মোগ বলা হয় এবং স্মোগ নিঃশ্বাসের সাথে ফুসফুসে ঢুকে না যায়, তার জন্য সরকার সতর্ক করে দেয়। অধিকসড়ম গ্রহণের ফলে অসুস্থ, ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
কোনো কিছু ঘটার আগেই তা প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা অবলম্বন করে থাকে পাশ্চাত্য। তারা বলে Prevention is better than cure। টেমস নদীর পানির একই রঙ দেখেছি। আমাদের রাজধানীর পাশের বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ইত্যাদি নদীর মতো নর্দমার, সুয়ারেজ বা কলকারখানা থেকে নির্গত কালো ও বিষাক্ত পানি দেখিনি।
কোন রোগে কত লোক মারা যায়, কোন এলাকায় কোন ব্যাধি মহামারী আকার ধারণ করে, তা নির্ধারণ করা এবং কষ্ট বা ভোগান্তির থেকে জনগণের রক্ষার জন্য তাদের দেশে Post Mortem (PM) বাধ্যতামূলক এবং তাদের পরীক্ষা নির্ভুল। কোনো ভাবে কোনো ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার জন্য কারো নির্দেশে চগ করা হয় না। বাংলাদেশে চগ করা হয় কেবল অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে এবং প্রায় ক্ষেত্রে ওপরে নির্দেশমতো মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করা হয়। অস্বাভাবিক মৃত্যু- যেমন পানিতে ডুবে, গলায় ফাঁস দিয়ে, মারামারিতে বা দাঙ্গায়, রাজনৈতিক প্রতিবাদকালে কিংবা ডাকাতিকালে মৃত্যু ইত্যাদি। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করা হয় না পাশ্চাত্যে। কিন্তু এ দেশে দেখা যায়, সারা গায়ে মারধরের চিহ্ন, আঘাতের চিহ্ন অথচ চগ রিপোর্টে বলে দিচ্ছে ‘শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।’ গণধর্ষিত নারীর শরীরে ধর্ষণের ‘কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।’
বাংলাদেশে সবকিছুই গধহধমবধনষব। অথচ এই চগ রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা তার রিপোর্ট তৈরি এবং এর ওপর ভিত্তি করে মামলার নথিপত্র ও অভিযোগপত্র প্রস্তুত করেন। আর সেই অভিযোগপত্র অনুসরণ করে বিচারিক আদালত, ম্যাজিস্ট্রেট থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়। তাকে আমরা ‘ন্যায়বিচার’ হিসেবে প্রতিবাদসহকারে গ্রহণ করে থাকি। কয়েক দিন আগে এক লম্পট ধর্ষিতার মাকে ধমক দিয়ে বলেছে- পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে মামলা উঠিয়ে নাও। এখন কিন্তু চগ অনেক ক্ষেত্রেই অনুসরণ করা হয়। যেমন খেলাধুলায় পরাজিত হওয়ায় পর বিশেষ করে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলায় কর্তৃপক্ষ খেলার ফিল্মটি বারবার ঘুরিয়ে দেখে এবং পরাজয়ের কারণ নির্ধারণ ও ভবিষ্যতে ওইসব ভুল না করার জন্য সতর্ক অবলম্বন করে থাকেন। রাজনীতিকেরা নির্বাচনে পরাজয়ের পর তারা নির্বাচন নিয়ে চগ করে থাকেন।
আমরা ক্যাসিনোর অপকর্ম নিয়ে চগ শুরু করেছি। গত ৩ অক্টোবর একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে রাজনীতিক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিচারহীনতার যে ছোট্ট তালিকা দিয়েছেন, তার দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দু’একটি ঘটনার চগ করে কিংবা কিছু মধ্যম স্তরের ব্যক্তিকে লোক দেখানো শাস্তি দিয়ে এই পচা দুর্গন্ধময় জাতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সারা শরীরে ঘা; মলম লাগাবেন কোথায়?
৫. এতদিন কি কোনো দলপতি বা দলনেতা নিঃস্বার্থভাবে নিরপেক্ষতা ও সাহসের সাথে, দেশের স্বার্থে, জনগণের মঙ্গলের জন্য দেশের সঠিক উন্নয়ন- যথা : শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য, বাসস্থান, কর্মস্থান, অর্থনীতি এবং সামাজিক, চরিত্রবান, নিষ্ঠাবান, শিক্ষিত, মেধাবী, দক্ষ, অভিযোগ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, দেশপ্রেমিক গড়ে তোলার, দীর্ঘমেয়াদি স্বনির্ভর জাতি গঠনের চেষ্টা করেছেন? আমাদের দলপতি ও দলনেতারা, দলসেবা, গোষ্ঠীসেবা, পরিবাররক্ষা, ফিতা কাটা, ভিত্তিপ্রস্তর বসানো, হাততালি, ফুলের মালা, লুণ্ঠন, অর্থপাচার, মিডিয়ায় ছবি ছাপানো ইত্যাদির রাজনীতি করেছেন। কেউ আসলে দেশ শাসন করেননি। ৬. দেশে দুর্নীতিবাজদের রক্ষার শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটের উদাহরণ দিচ্ছি।
নৌ-পরিবহন অধিদফতরের জাহাজ জরিপকারক ও পরীক্ষকের বিরুদ্ধে ত্রুটিপূর্ণ নৌযান নিবন্ধন এবং অবৈধভাবে সার্ভে সনদ দিয়ে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত। চার দশকের পুরনো দু’টি জাহাজ স্ক্র্যাপ করার পরিবর্তে নাম বদল করে বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নতুন হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। জাহাজের সার্ভে সনদ এবং পরীক্ষায় পাস করিয়ে দিয়ে অবৈধ সুবিধা গ্রহণসহ দুই লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদকালে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে দুদক। জানা গেছে নৌ অধিদফতরের মহাপরিচালক মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং অন্যান্য হোমরা চোমরা কর্মকর্তা তার পক্ষে সাফাই গাইছেন। এই দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দুদক ছয় বছর আগে তদন্ত শুরু করলেও মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের অসহযোগিতার কারণে তা শেষ করে মামলা দায়ের করা যায়নি। মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেটের সহায়তায় তিনি পদোন্নতি পেয়েছেন।
একজন কমডোরও সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত (নয়া দিগন্ত ০১-১০-২০১৯)। একইভাবে একজন ব্রিগেডিয়ারকে কারা মহাপরিদর্শক এবং একজন ব্রিগেডিয়ারকে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাইরেক্টর নিযুক্ত করা সত্ত্বেও তারা দুর্নীতি ঘুষ অনিয়ম বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা সিন্ডিকেটের দাপটের সামান্য উদাহরণ। সিবিএ নেতাদের দাপটে ব্যাংক/ বিমান এবং বিভিন্ন অধিদফতর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বিগত সব সরকার ওইসব সিন্ডিকেটের সাথে আপস করে ক্ষমতায় থেকেছে এবং রাষ্ট্রের সম্পদ লুট, ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে ৭০ শতাংশ এবং ৩০ শতাংশ হিসাবে, কখনো কখনো ৬০ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ হিসাবে।
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যায় তার মার আর্তনাদে আল্লাহ্ আরশ কেঁপে উঠেছে। অসহায় ও অত্যাচারিত মানুষ আল্লাহর বিচারের আশায় তার দিকে হাত তুলে অর্তনাদ করছে। আল্লাহ্ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করে না।
সরকার ক্যাসিনো, জুয়া, মদ ও দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে কঠোর ও সাহসী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। Better late than never. কিন্তু এক্ষেত্রে জনগণের আশা পূরণ হবে কি?
লেখক : প্রবীণ আইনজীবী