সিরিয়ায় যে খেলা খেললেন এরদোগান
সিরিয়ায় যে খেলা খেললেন এরদোগান - ছবি : সংগ্রহ
কুর্দিস ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি) এবং তাদের সামরিক শাখা পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটস (ওয়াইপিজি)-কে লক্ষ্য করে তুরস্ক সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তার সর্বশেষ সামরিক অভিযান অপারেশন স্প্রিং অব পিস পরিচালনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই এলাকা থেকে মার্কিন সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়ার পরই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এই অভিযান শুরু করেন। সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তুরস্কের প্রস্তাবিত ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই দেশটি এই অভিযান শুরু করে। অভিযান শুরু করার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবার ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করেন। তিনি অভিযান বন্ধ করার জন্য তুরস্কের প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। এরদোগান ট্রাম্পের আহ্বানে সাড়া না দেয়ায় তিনি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পম্পেওকে তুরস্কে পাঠান। পরে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট পম্পেওর মধ্যে দীর্ঘ বৈঠকের পর তুরস্ক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
সিরিয়ার ওই অঞ্চলে একটি সেফ জোন বা নিরাপদ এলাকা গড়ে তোলার জন্য গত ৯ অক্টোবর থেকে তুরস্ক সামরিক অভিযান শুরু করে। এরদোগান প্রস্তাবিত নিরাপদ এলাকায় তুরস্কে বসবাসরত প্রায় ৩৫ লাখ সিরিয়ান শরণার্থীর বড় একটি অংশকে পুনর্বাসিত করা হবে। অভিযান শুরু করার আগে এলাকাটি সশস্ত্র কুর্দি গোষ্ঠী ওয়াইপিজির অধীনে ছিল। তুরস্ক এ গোষ্ঠীটিকে সন্ত্রাসী গ্রুপ পিকেকে’র সহযোগী মনে করে।
ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি) বা পিপলস প্রোটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি) ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর কুর্দি এ গ্রুপটি দেশটির উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। গ্রুপটি পিকেকে’র প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ ওসালানের আদর্শে অনুপ্রাণিত। উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সাল থেকে পিকেকে সন্ত্রাসী গ্রুপটি তুরস্কের সাথে গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। তারা একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীকালে অবশ্য তারা স্বায়ত্তশাসন ও আঞ্চলিক ফেডারিলিজম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছে বলে জানায়। পিওয়াইডি নিজেদের পিকেকে থেকে স্বাধীন ও পৃথক বলে দাবি করে। কিন্তু তাদের অনেক কার্যক্রম ও অভিযান ইরাকের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ে অবস্থিত একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় বলে জানা যায়। এদের সাথে আরো কয়েকটি গ্রুপ সম্পৃক্ত রয়েছে। গ্রুপগুলো হলো- সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস, মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিডম ব্যাটালিয়নস।
তুরস্কের সামরিক বাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী। তুর্কি সামরিক বাহিনী ন্যাটো জোটের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী। পিওয়াইডির গঠন ও সম্প্রসারণে তুরস্ক গভীরভাগে উদ্বিগ্ন। তুরস্ক এবং পিকেকে’র মধ্যে ২০১৩ সাল থেকে একটি শান্তি প্রক্রিয়া চলমান ছিল। কিন্তু পিওয়াইডি বিস্তৃত লাভ করার কারণে ২০১৫ সালে দুই পক্ষের মধ্যকার শান্তি প্রক্রিয়া ভেঙে যায়। তখন থেকে এরদগোন সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে একটি কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাকে কখনোই অনুমোদন করবেন না বলে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
২০১৬ সালে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে আইএসকে দমন করার লক্ষ্য নিয়ে অপারেশন ইউফ্রেটিস শিল্ড পরিচালনা করে তুরস্ক। আবার ২০১৮ সালে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আফরিন থেকে ওয়াইপিজিকে বের করে দেয়ার জন্য দেশটি অপারেশন অলিভ ব্রাঞ্চ পরিচালনা করে। তখন থেকে উত্তরাঞ্চলের অবশিষ্টাংশ থেকে ওয়াইপিজিকে নির্মূল করার জন্য পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের একটি আবহ সৃষ্টি হয়। তুরস্কের সাথে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি নামক গ্রুপটিও কুর্দিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এ গ্রুপটি তুরস্কের আফরিন অপারেশন ও আল-বাব এবং অন্যান্য এলাকায়ও তুর্কি বাহিনীকে সহায়তা করে।
তুরস্ক আশঙ্কা করছে, তাদের দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্তে পিকেকেপন্থী কুর্দিদের অবস্থান তুরস্কের ওপর হামলা চালানোর লাঞ্চপ্যাড হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তাই তুরস্ক এটাকে একটি চলমান হুমকি হিসেবেই মনে করে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তুরস্ক ও পিকেকে’র মধ্যকার সঙ্ঘাতে ৪০ হাজার লোক নিহত হয়েছে। তুরস্কের বর্তমান সেনা অভিযানের অপর একটি কারণ হচ্ছে, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে একটি ‘সেফ জোন’ বা ‘নিরাপদ এলাকা গড়ে তুলে সেখানে তুরস্কে আশ্রয় গ্রহণকারী সিরীয় শরণার্থীদের পুনর্বাসিত করা। বিশ্বের মধ্যে তুরস্কই হচ্ছে সর্বাধিক শরণার্থীকে আশ্রয়দানকারী দেশ। এসব শরণার্থী তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকার কারণে তুরস্ককেও নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এরদোগান ওয়াইপিজির কাছ থেকে উদ্ধার করা জায়গায় সিরীয় শরণার্থীকে পুনর্বাসিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কুর্দিদের ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টির (পিওয়াইডি) দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো ওসালানের আদর্শ ভিত্তিক একটি বিকেন্দ্রীকরণকৃত কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। পিওয়াইডি নিয়ন্ত্রিত এলাকাকে তাদের অনেকেই রোজাভা নামে ডেকে থাকে। এটি একটি কুর্দি শব্দ। এর অর্থ হলো স্থানীয় কাউন্সিল এবং ফোরামের মাধ্যমে তারা একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করবে। তবে পিওয়াইডিকে তাদের পরিচালিত রোজাভার স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসন চালাতে গিয়ে একদলীয় শাসন চালানোর জন্য দায়ী করা হয়। বিশেষভাবে কুর্দিরা সিরিয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে বৈষম্যের শিকার। সিরীয় সরকার কুর্দি এলাকাগুলোতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে সেখানকার জনমিতিতে পরিবর্তন আনার প্রয়াস চালায়।
যুক্তরাষ্ট্র একসময় আইএস-বিরোধী যুদ্ধে সিরিয়ার কুর্দি এবং কয়েকটি আবর গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। তখন অবশ্য তারা জানত তাদের ন্যাটো মিত্র তুরস্ক কুর্দিদের সন্ত্রাসী বিবেচনা করে। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত সংখ্যক সেনা উপস্থিতিকে সিরীয় কুর্দিদের নিরাপত্তা সুরক্ষা হিসেবে দেখা হতো। আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারা আমেরিকার মিত্র হয়ে উঠেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর ন্যাটো মিত্র ব্রিটেন ও তাদের সৈন্যদের সেখান থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়ায় নিজ দল রিপাবলিকান পার্টি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তবে তিনি তাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার এবং ন্যাটো মিত্র। যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করায় কুর্দিরা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণা দেয়। চুক্তিকে ২০১২ সালের পর থেকে হাতছাড়া হওয়া তুর্কি সীমান্তের দিকে দামেস্কের সেনাবাহিনীকে অগ্রসর হতে দিতে একমত হয় তারা। আসাদের সাথে চুক্তির ঘোষণা দিয়েও কুর্দিরা আবার ইসরাইলেরও সমর্থন চেয়েছে। এ দিকে তুরস্কের সীমান্ত এলাকা থেকে সরে যেতে রাজি হয়েছে কুর্দি যোদ্ধারা। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে তারা এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে কুর্দিদের এক সিনিয়র নেতা আলজাজিরাকে জানিয়েছেন। মার্কিন মধ্যস্থতায় পাঁচ দিনের যুদ্ধবিরতির পর তুরস্ক আবার অভিযান শুরু করবে বলে বানিয়েছে।
সিরিয়া যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্ক কয়েক বছর ধরে সেফ জোন প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছিল। কিন্তু কেউ তাতে সমর্থন দেয়নি। প্রেসিডেন্ট এরদোগান সম্প্রতি শেষ হওয়া জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও তার বক্তব্যে বিষয়টি তুলে ধরেন। তুরস্ক সামরিক অভিযান শুরু করার পর আমেরিকা, ব্রিটেন জার্মানিসহ কয়েকটি দেশ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ইসরাইল ও ফ্রান্স কঠোর হুমকি দেয়। মিত্র দেশগুলোও এই অভিযানের প্রতি সমর্থন জানায়নি। কিন্তু এরদোগান তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। শেষ পর্যন্ত কুর্দি বাহিনী পিছু হটে এবং আমেরিকা ও ব্রিটেনও সৈন্য সরানোর ঘোষণা দেয়। অবশেষে তুরস্কের সেফ জোন প্রতিষ্ঠা সফল হতে যাচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এরদোগানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে তুরস্ক এগিয়ে যাচ্ছে- এটা দেশটির বড় সাফল্য।