কাশ্মির গেঁড়োতে ফাঁস নাগায়
কাশ্মির গেঁড়োতে ফাঁস নাগায় - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের প্রাচীনতম সশস্ত্র বিদ্রোহ সমাপ্তির উচ্চাশা এখন একটি ক্রুদ্ধ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পরিণত হওয়া শুরু করেছে। ভারত সরকার ও বৃহত্তম নাগা বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট সই হওয়া ঐতিহাসিক কাঠামো শান্তিচুক্তিটি ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।
দুই পক্ষের চূড়ান্ত শান্তিচুক্তিতে উপনীত হতে ১০ দিন বাকি থাকার প্রেক্ষাপটে ভারত সরকার সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছে বৃহত্তম বিদ্রোহী গ্রুপ এনএসসিএন (আইএম)-কে চেপে ধরতে। এনএসসিএন (আইএম) ও ভারত সরকার ২২ বছর ধরে নাগাদের একটি সার্বভৌম সমাজের স্বীকৃতি দিয়ে এক শান্তিচুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
কিন্তু ভারত সরকার তার নিজের তৈরী ফাঁদেই পড়ে গেছে। গত ৫ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মিরকে ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে দেয়া বিশেষ মর্যাদা-সংবলিত সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলুপ্ত করে ফেলেছে। এই অনুচ্ছেদটি কাশ্মির অঞ্চলকে আলাদা আইন ও অধিকার এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশি স্বায়াত্তশাসন দিয়েছিল।
এই বিলুপ্ত করার বিষয়টি এখন নাগা শান্তিপ্রক্রিয়ায় অনুভূত হচ্ছে। এতে করে পুরো উত্তর-পূর্ব ভারত অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার হুমকির মুখে পড়েছে। অথচ চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সীমান্তে হওয়ায় এটি একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত উত্তর-পূর্ব ভারত। কয়েক শ’ বছর আগে চীন থেকে আগত হামলাকারীরা উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে এসে সেখানেই বসতি স্থাপন করে স্থানীয়দের সাথে মিশে যায়। স্বাধীনতার পর ভারতের উত্তর-পূর্বের অনেক বিদ্রোহী গ্রুপ চীনের কাছ থেকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় লাভ করে। ভারতকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চীন এসব গ্রুপের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে।
বিপুলভাবে অস্ত্রে সজ্জিত
কাশ্মিরে যেখানে মাত্র কয়েক শ’ সশস্ত্র যোদ্ধা আছে, সেখানে এনএসসিএনের (আইএম) রয়েছে প্রায় সাত হাজার সৈন্য। এরা বিপুলভাবে অস্ত্রে সজ্জিত। ভারত সরকার তাদের সাথে চুক্তিতে উপনীত হতে ব্যর্থ হলে পুরো অঞ্চলটি অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। এমনটাই অভিমত ভারতের উত্তর-পূর্ব এলাকার দীর্ঘ দিনের এক পর্যবেক্ষকের।
এই ইস্যুর সাথে পরিচিত অনেক শীর্ষ ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাও এই মূল্যায়নের সাথে একমত। এক সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, নাগাদের দাবি হলো, যেখানেই তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ আছে, সেই সব এলাকাকে নিয়ে একটি আলাদা রাজ্য গঠন করা। এনএসসিএন (আইএম) তার প্রধান দাবিগুলোতে ছাড় দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, এগুলো পূরণ না হলে চুক্তি থেকে সরে যেতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। এর মানে হলো, এই অঞ্চলের অন্য রাজ্যগুলোও অস্ত্র হাতে তুলে নেবে যদি ভারত সরকার এনএসসিএনের (আইএম) প্রধান দাবিগুলো মেনে না নেয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার এই যুক্তিতে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলুপ্ত করেছে যে এটি ভারতের বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলো একীভূত করার জন্য অনিবার্য। কিন্তু এনএসসিএনের (আইএম) প্রধান দাবিগুলোর মধ্যেই ওইসব দাবি রয়েছে যেগুলো গত আগস্টে কাশ্মিরের জন্য বিলুপ্ত করা হয়েছে।
এনএসসিএনের (আইএম) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা থুইঙ্গালেঙ মুইভাব উল্লেখ করেছেন যে তারা দাবিগুলো পরিত্যাগ করা তো দূরের কথা, ছাড় দেয়ারও কোনো অবস্থায় নেই। নাগারা সবসময় দাবি করে আসছে যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা খনো তাদেকে বশীভূত করতে পারেনি বা ব্রিটিশ ভারতের অংশে পরিণত করতে পারেনি। বস্তুত, তারা ১৯৪৭ সালে যেদিন ভারতকে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল, ঠিক তার এক দিন আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
মুইভা আরো পরিষ্কার করে বলেন যে তিনি নাগারা ভালো সংখ্যায় আছে, এমন অংশগুলেসহ নাগাদের জন্য আলাদা একটি রাজ্য না দেয়া হলে তিনি কোনো সমাধানে রাজি হবেন না।কিন্তু এটা করা হলে কেবল বিদ্যমান রাজ্যগুলোই ভাঙবে না, সেইসাথে উত্তর-পূর্ব এলাকার অন্যান্য রাজ্যের উপজাতীয়দেরকেও তাদের পরিচিত ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য প্ররোচিত করবে।
শান্তির সময়সীমা
তবে ভারত সরকারের মধ্যস্ততাকারী আর এন রবি (এই ক্যারিয়ার ইন্টিলিজেন্স অফিসার কয়েক দশক ধরে এই ইস্যুটিতে নিয়োজিত রয়েছেন) এসব দাবি গ্রহণ করতে নারাজ। তিনি তার নিজস্ব কয়েকটি আলটিমেটাম দিয়েছেন।
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই শুভক্ষণে এন্সসিএন (আইএম) মীমাংসা বিলম্বিত করার নীতি গ্রহণ করেছে আলাদা পতাকা ও সংবিধানের দাবি জানিয়ে। অথচ এসব ব্যাপারে তারা ভারত সরকারের অবস্থান জানে। ভারত সরকার আর বিলম্ব ছাড়াই শান্তিপ্রক্রিয়া সমাপ্ত করতে চায়।
এর মানে হলো এই যে ভারত সরকার ৩১ অক্টোবরের মধ্যেই চুক্তি করতে চায়। এখন এনএসসিএন (আইএম) যদি তাতে রাজি না হয়, তবে ভারত সরকার অন্যান্য নাগা গ্রুপকে নিয়ে নাগা ন্যাশনাল পলিটিক্যাল গ্রুপ গঠন করার উদ্যোগ নেবে।
কিন্তু বাস্তবে অনেক নাগা গভীরভাবে সন্দীহান ও অসন্তুষ্ট। তারা বলছে যে ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট, ২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বরসহ এখন পর্যন্ত যত কাঠামো চুক্তি হয়েছে, সেগুলোর কোনোই প্রকাশ করা হয়নি। ফলে কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা জানি না। এ মন্তব্য প্রখ্যাত এক নাগা নাগরিক সমাজের সদস্য। তিনি এশিয়া টাইমসকে টেলিফোনে একথা বলেন।
ভারতের আলোচকেরা এই সুবিধা গ্রহণের আশা করছেন যে কয়েক বছর ধরে শান্তিতে থাকার ফলে এনএসসিএনের (আইএম) ক্যাডাররা আর জঙ্গলে ফিরে গিয়ে যুদ্ধ করতে চাইবে না।
তবে নাগা শান্তিপ্রক্রিয়া ফলপ্রসূ না হলে তা হবে মোদি সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের বিপর্যয়। এটি ১৯৯৮ সালে যুদ্ধবিরতির পর শান্ত থাকা সশস্ত্র বিদ্রোহটি আবার চাঙ্গা হতে পারে। তা ঘটলে ভারতকে কাশ্মিরের পাশাপাশি উত্তরপূর্বেও শসস্ত্র বিদ্রোহ মোকাবিলা করতে হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। কারণ এই এলাকা প্রায়ই ভারতীয় বাহিনী ও এনএসসিনের (আইএম) বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবেই কাজ করে।
এশিয়া টাইমস