পাস্তুরিত দুধ এখন কতটা নিরাপদ
পাস্তুরিত দুধ - ছবি : সংগৃহীত
শিশুর মুখে প্রাস্তুরিত নিরাপদ দুধ তুলে দিতে চার ধাপের সতর্কতা জারি করেছে দুগ্ধ উৎপাদনকারী বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। একইসাথে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আগামী মাসেই এ বিষয়ে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাড়তি সতর্কতার নির্দেশনাও জারি করবে। সম্প্রতি দেশব্যাপী গরুর প্রাস্তুরিত দুধে উচ্চ মাত্রায় ব্যাকটেরিয়া, অ্যান্টিবায়োটিক ও সীসার উপস্থিতি পাওয়ার খবরে অসংখ্য বাবা মায়ের মনে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে সেটি কমাতে ইতোমধ্যে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। গত কয়েক দিনে নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে প্রাস্তুরিত দুধ উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান, গবেষণা সংস্থা এবং প্রান্তিক পর্যায়ে দুধ উৎপাদনের সাথে জড়িত খামারি ও কর্মকর্তাদের সাথে কথা জানা গেছে এসব তথ্য।
রাজধানীর ইস্কাটনস্থ বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র জানায়, প্রাস্তুরিত দুধের উপর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের গবেষণাকে কেন্দ্র করেই মূলত সারা দেশে দুধের অণুজীবীয় ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। অনেক মা-বাবা ভয়ে দুধ কেনাও বন্ধ করে দেন। কিন্তু প্রাস্তুরিত দুধের বিকল্প না পেয়ে তারা শহরের গোয়ালা বা গ্রাম থেকে প্রক্রিয়া করে দুধ সংগ্রহেরও চেষ্টা করেন। কিন্তু এভাবে তারা শিশুদের প্রতিদিনের দুধের চাহিদা মেটাতে পারছেন না। অনেকে আবার গুড়ো দুধের ওপরও ভরসা করতে পারেন না। ২০১৩ সালে আমদানিকৃত গুড়া দুধে মেলামাইন ও তেজস্ক্রিয়ার উপাদান পাওয়ার খবর প্রচারিত হওয়ার পর প্যাকেট বা গুড়া দুধেও আস্থা হারান অনেকে। সেই ঘটনার পর নতুন করে এখন প্রাস্তুরিত দুধে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও সীসা পাওয়ার খবরেও আতঙ্কিত অনেক পরিবার। ইতোমধ্যে শিশু খাদ্য নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন শহুরে অনেক মা-বাবা।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক এ এস এম জুবেরী নয়া জানান, মূলত চারটি বিষয়ে সতর্ক থাকলে প্রাস্তুরিত দুধে কোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া কিংবা ক্ষতিকর কোনো উপাদানের সংমিশ্রিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। বিষয়েগুলো হলো, প্রথমত প্রান্তিক পর্যায়ে দুধ দোহনের সময়ে গাভীকে ভালোভাবে পরিস্কার করাতে হবে। কেননা গাভীর ওলানে গোবর কিংবা মূত্র লেগে থাকলে দোহনের সময়ে ওই দুধে ই কোলাই নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংমিশ্রণ হতে পারে। তাই প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষক বা খামারিকে সতর্ক করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শীতলীকরণ কেন্দ্রে দুধ সংগ্রহ করার আগে পরীক্ষা করে পরিদর্শকের উপস্থিতিতে দুধ সংগ্রহ করতে হবে। তৃতীয়ত, দুধ শীতলীকরণের পর পরিবহনের সময়েও দেখতে হবে পরিবহন ভ্যানের তাপমাত্রা চার ডিগ্রির নিচে রাখা হয়েছে কিনা। চতুর্থত, বিপনী বিতানে প্রান্তুরিত দুধ সংরক্ষণের সময়ে রেফ্রিজারেটরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও এর ধারণ ক্ষমতার বেশি যাতে কোনো ক্রমেই দুধ না রাখা হয়।
এই গবেষক আরো জানান, সব ধরনের প্রাস্তুরিত দুধ আমরা ভালোভাবে ফুটিয়ে পান করার জন্য সবাইকে পরামর্শ দেই।
দীর্ঘদিন ধরে ফার্ম ফ্রেস নামে প্রাস্তুরিত তরল দুধ বাজারজাত করছে আকিজ গ্রুপ। কোম্পানির এই শাখার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেজর (অব.) মোসলেম উদ্দিন এই প্রতিবেদককে জানান, খামারি পর্যায় থেকে শুরু করে দুধ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিপননেও আমরা একটি ষ্ট্যান্ডার্ড বা মান নিয়ন্ত্রণ করি। যে কারণে আমাদের দুধের গুণাগুণ রক্ষা হয়। বর্তমানে শহরের বাজারে কিংবা অলিগলিতে এমন অনেক প্যাকেট দুধ আছে যেগুলোতে কোনো নাম থাকে না, তাতে এই দুধ কোন কোম্পানির, তাও নেই। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে এগুলোর নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশে প্রাস্তুরিত দুধের সবচেয়ে বড় বাজারই দখল করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা। পাবনা ও সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীঘাটে রয়েছে মিল্কভিটার বড় সংগ্রহশালা। এখান থেকে মিল্কভিটা প্রতিদিন দুই লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। ঢাকার মিরপুরে মিল্কভিটার প্রধান কার্যালয়ে গত ২১ অক্টোবর সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল এখান থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার প্রধান প্রধান বিপনী বিতান কেন্দ্রে নিজস্ব পরিবহনে চলে যাচ্ছে প্রাস্তুরিত দুধ।
গবেষণায় প্রাস্তুরিত দুধে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া পাওয়ার পর এ নিয়ে দেশব্যাপী মানুষের মনে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিল্কভিটার সহকারি মহা ব্যবস্থাপক ড. খন্দকার মো: আমিনুল ইসলাস নয়া দিগন্তকে জানান, মিল্কভিটা আমাদের নিজস্ব গবেষণায় শতভাগ নিরাপদ দুধ। কেননা আমরা নিজস্বভাবে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে এই দুধ পরীক্ষা করেছি।
জানান, দুধে ব্যাকটেরিয়ার থাকবে এটা স্বাভাবিক। তবে এর পরিমিত মাত্রা হলো দশমিক শূন্য ৫ ভাগ (০.০৫)। কিন্তু আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি আমাদের দুধে এই মাত্রা হলো ০.০০০০৫ ভাগ।
ছোট বড় খামারি বা কৃষকের পর্যায় থেকে কিভাবে দুধ সংগ্রহ করা হয় এবং সেই দুধ কিভাবে শীতলীকেন্দ্রে এনে পরীক্ষা করা তা জানতে নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন সিরাজগঞ্জের গ্রাম পর্যায়ের কৃষক ও কর্মকর্তার সাথে।
সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক শহিদুল ইসলাম রন্টু নয়া দিগন্তকে জানান, উল্লাপাড়া উপজেলায় ব্যাপকভাবে প্রান্তিক পর্যায় থেকে দুধ সংগ্রহ করে দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্রে রাখা হয়। খামারি ও ঘোষের কাছ থেকে সরাসরি এখানে দুধ সংগ্রহ করা হয়। অন্যদিকে মিল্কভিটা শুধু তাদের সমরায় সমিতির মাধ্যমে দুধ সংগ্রহ করে।
তিনি আরো জানান, উল্লাপড়া উপজেলায় চারটি কোম্পানির বেশ কিছু দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রাণের চারটি, ব্র্যাক কোম্পানির তথা আড়ৎ দুধের দুটি, আকিজ কোম্পানির ফার্ম ফ্রেসের একটি ও নতুন জিসান নামের একটি কোম্পনির একটি দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এছাড়া মোহনপুরে উল্লেখিত প্রত্যেকটি কোম্পানির একটি করে দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।
আবদুল কাদের নামের একজন দুধ কালেক্টর (আড়ং কোম্পানির দুধ সংগ্রহকারী) এই প্রতিবেদককে জানান, আমরা খামারি কিংবা ঘোষদের কাছ থেকে যখন দুধ সংগ্রহ করি তখন তিনটি বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেই। এক. এই দুধের সিএলআর বা লেকটো’র পরিমাণ কতটুকু, দুই. দুধের ফ্যাটের পরিমাণ এবং তিন. দুধের ক্ষার বা এসিড পরিমাপ করি। এতে দুই কত সময় আগে দোহন করা হয়েছে বা দুধ টক হয়ে গেছে কিনা সেটি সহজেই পরিমাপ করা যায়। আমাদের পরীক্ষায় কোনো একটি বিষয়ের মানের কোনো ঘাটতি থাকলে ওই দুধ আমরা গ্রহণ করি না। সাথে সাথেই ফেরত দেয়া হয়।