ভয়ে মুখও খুলতে পারেনি ক্রিকেটাররা, ধর্মঘটের নেপথ্য কারণ

মাসউদুর রহমান | Oct 22, 2019 06:14 am
ধর্মঘটের কথা ঘোষণা করছেন ক্রিকেটাররা

ধর্মঘটের কথা ঘোষণা করছেন ক্রিকেটাররা - ছবি : সংগৃহীত

 

ক্রিকেটারদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নতুন না। দীর্ঘদিন থেকেই কথিত শোষণনীতির কষাঘাতে তারা। এটা ধীরে ধীরে বেড়ে গতকাল প্রকাশ পেল, তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। এর বছর পাঁচেক আগেও একবার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন ক্রিকেটারেরা। সেটা ছিল প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেটে সাধারণ দলবদলের প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে ক্লাবগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থে ‘প্লেয়ার বাই চয়েজ’ এর বিপক্ষে। কিন্তু বেশি দূর যায়নি সেটা। বিসিবির বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সেবার ক্রিকেটারদের বুঝিয়ে ক্লাবগুলোর আর্থিক সঙ্কটের কথা তুলে খেলোয়াড়দের এক বছরের জন্য নতুন প্রথা বলে সেটা মেনে নেয়ার আহ্বান জানালে কোমলমতি ক্রিকেটারেরা তা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সে বছরের পর একবারই ঐতিহ্য অনুসারে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার দলবদল হয়েছিল।

এরপর আবার ক্লাবের স্বার্থ রক্ষা করে এবং খেলোয়াড়দের রুটি-রুজির ওপর কষাঘাত করে বিসিবি। এবং ফেরানো হয় ‘প্লেয়ার বাই চয়েজ’। কিন্তু ক্রিকেটারেরা রাগে-ক্ষোভে ফুসলেও বিসিবির ‘ক্রিকেটারদের মুখ বন্ধের যে গোপন চুক্তি’ সে ভয়ে মুখ খোলেননি কখনো। এবার তা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ নেয় আগামী বিপিএলে ‘ফ্রাঞ্চাইজি’ প্রথা বাতিলের পরপরই। ফ্রাঞ্চাইজিগুলোকে নতুন চুক্তি করে বিপিএল খেলতে হবে এমন ঘোষণা দেয়ার পর ফ্রাঞ্চাইজিগুলো নড়ে চড়ে বসে।

কিন্তু হঠাৎ করে বিসিসি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়ে বসেন, আগামী বিপিএল (যেটা আসছে ডিসেম্বর মাঠে গড়াবে) হবে বিসিবির অধীনে। সেখানে থাকবে না কোনো ফ্রাঞ্চাইজি। বিসিবিই পেমেন্ট দেবে ক্রিকেটারদের। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে এ বিপিএল অনুষ্ঠানের কথা বলা হলে এ নিয়ে আর কেউ মুখ খোলেননি। সবাই মেনে নেন। কিন্তু খেলোয়াড়েরা এটা প্লেয়ার বাই চয়েজের মতোই কিছু হতে যায় কি না সে শঙ্কার কথা ভেবে, ফুঁসে ওঠেন। কারণ ফ্রাঞ্চাইজি থেকে যে অর্থপ্রাপ্তি যোগ ঘটত ক্রিকেটারদের, বিসিবি যে তার সিকিভাগও দেবে না, তা তাদের জানা। কারণ প্লেয়ার বাই চয়েজেও ক্লাবগুলো অনেক ক্রিকেটারের বকেয়া দেয় না; করে নানা টালবাহানা। বিসিবি এ অর্থ উদ্ধারের দায়িত্ব নিলেও অজ্ঞাত কারণে সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। ফলে ক্রিকেটারেরা আর্থিক কষ্টে দিনযাপন করে কেউ কেউ ক্রিকেটে মনোযোগ না দিয়ে জীবন রক্ষার তাগিদে ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোনিবেশও করেন। এ ছাড়াও ঘরোয়া ক্রিকেট, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের ম্যাচ ফিসহ নানান অনিয়ম তুলে ধরে সেগুলো দূরীকরণের দাবি তুলে এ ধর্মঘটের ডাক দেন জাতীয় ক্রিকেটারেরা। যাতে গতকাল মিরপুর শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদসহ সিনিয়র ও জুনিয়র ক্রিকেটার মিলে প্রায় ৬০ জন। তাদের ১১ দফা দাবি এক-একজন করে উপস্থাপন করেন। ক্রিকেটারদের এ দাবিগুলো যে যৌক্তিক তা প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।


এ দিকে ক্রিকেটারদের দাবির উল্লেখযোগ্য হলো : ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (কোয়াব) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যেহেতু বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়িত, তাই তারা ক্রিকেটারদের উন্নতি বা বৈষম্যে কাজ করেন না। ফলে তাদের পদত্যাগ করতে হবে। এবং ক্রিকেটারেরা গণতান্ত্রিকভাবে ভোট দিয়ে তাদের নেতা নির্বাচন করবেন। এ ছাড়াও জাতীয় ক্রিকেটের (প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট) মান বৃদ্ধিতে কিছু দাবি ও খেলোয়াড়দের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ। বিপিএল পরের বছর থেকে ফ্রাঞ্চাইজি পুনর্বহাল; প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেটসহ সব ঘরোয়া ক্রিকেট যেহেতু সাধারণ ক্রিকেটারদের রুটি-রুজির অবলম্বন, তাই এখানে আগের মতো দলবদল প্রথা চালু; যেহেতু দেশের সবকিছুর দাম বৃদ্ধি, সব সেক্টরেই বেতন-ভাতা বাড়াচ্ছেন সরকার, তাই এখানেও ভাতা বৃদ্ধি ও মানসম্মতকরণ; খেলোয়াড়দের যথার্থ সম্মান প্রদান; খেলোয়াড়দের ক্লাব থেকে বকেয়া আদায়ে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ; প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট, যেটাকে বলা হয় ক্রিকেটার বের হওয়ার পাইপলাইন, সেটা থেকে দুর্নীতি দূরীকরণ (বিসিবি কর্তাদের কারো কারো পছন্দের ক্লাবকে অনৈতিকভাবে সুবিধা দিয়ে অ্যাডভান্টেজ প্রদান); গ্রাউন্ডসম্যান, আম্পায়ারসহ ক্রিকেটের সাথে জড়িতদের ভাতা বৃদ্ধিসহ অনেক কিছুরই সমন্বয়।


ক্রিকেটারদের এ ধর্মঘট দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। গতকাল দুপুরের পরপর মিরপুর শেরেবাংলায় মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে এ ধর্মঘটের ডাক দেন জাতীয় দলের টেস্ট ও টি-২০ ক্রিকেটের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। তবে যেহেতু অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপ সামনে, তাই তাদের এর আওতামুক্ত রাখা হয়। এতে চলমান জাতীয় ক্রিকেট লিগ পড়ল অনিশ্চয়তার মধ্যে। যে ক্রিকেটের তৃতীয় রাউন্ড শুরু হওয়ার কথা ২৪ অক্টোবর থেকে। এবং ২৫ অক্টোরব থেকে জাতীয় দলের ক্যাম্পও পড়ল অনিশ্চয়তায়। এতে জাতীয় দলের আসন্ন ভারত সফরও হুমকির মধ্যে পড়েছে এতে। ইতোমধ্যে ১৫ সদস্যের দলও ঘোষণা দিয়েছিল বিসিবি। যার অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। এবং এ সফরে রয়েছে তিন ম্যাচের টি-২০ ও দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ, যা আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অন্তর্গত। এ ধর্মঘটে এ সফর এখন হুমকির মধ্যে। আগামী ৩ নভেম্বর প্রথম টি-২০ ম্যাচ হওয়ার কথা দিল্লিতে। গতকাল মিরপুর শেরেবাংলায় ক্রিকেটারদের সংবাদ সম্মেলনে সিনিয়র ক্রিকেটারদের মধ্যে নাইম ইসলাম, মুশফিকুর রহীম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ প্রমুখ ক্রিকেটার কথা বলেন। তামিম ইকবালও উপস্থিত ছিলেন এতে। তবে ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা এমপি, অসুস্থতার জন্য বাবাকে নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন।


এ সময় সাকিব বলেন, ‘আমরা জানি, দেশের সব ক্রিকেটার আমাদের সাথে আছেন। যত দিন পর্যন্ত আমাদের এই দাবি পূরণ না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত আমরা ক্রিকেটের কোনো কার্যক্রমে জড়িত থাকতে চাচ্ছি না। জাতীয় দল, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটারসহ সবাই এই ধর্মঘটের অন্তর্ভুক্ত এবং সেটা আজ (গতকাল) থেকেই। জাতীয় লিগ থেকে শুরু করে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট বলেন, জাতীয় দলের প্রস্তুতি বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বলেন সবই এর অন্তর্ভুক্ত।’ সাকিবের এই ঘোষণার সময় তুমুল করতালি দিয়ে স্বাগত জানান উপস্থিত ক্রিকেটারেরা। তিনি বলেন,‘অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সামনে যেহেতু বিশ্বকাপ আছে, তাদের তাই এই ধর্মঘটের আওতায় রাখা হয়নি। আর খুব বেশি সময় হাতে ছিল না বলে নারী ক্রিকেটারদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি বলে জানিয়েছেন সাকিব। তবে নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করলে তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন জাতীয় দলের এ অলরাউন্ডার।

একই সাথে এসব দাবি-দাওয়া বোর্ডের সাথে আলোচনা করে সমাধানযোগ্য বলেও জানিয়ে রেখেছেন সাকিব। তিনি বলেন, ‘আলোচনা সাপেক্ষে অবশ্যই সবকিছুর সমাধান হবে। দাবিগুলো যখন মানা হবে তখন আমরা স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে যাব। আমরাও চাই ক্রিকেটের উন্নতি হোক। এখানে ক্রিকেটারদের কেউ তিন-চার বছর খেলবেন, কেউ দশ বছর আছেন। যারা ভবিষ্যতে আসবেন, তাদের জন্য আমরা একটা ভালো পরিবেশ রেখে যেতে চাই, যেখান থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট সামনে এগিয়ে যাবে।’


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us