মেজর (অব:) হাফিজকে আটক কতটা যৌক্তিক ছিল?
মেজর (অব:) হাফিজ - ছবি : সংগ্রহ
ই-মেইলে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ভূমিকা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যমূলক কথাবার্তা আদান-প্রদানের মিথ্যা অভিযোগে মেজর (অব:) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৭/৩১/৩৫ ধারায় মামলা করেছে সরকার। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে, বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা নামক কালো আইনের ২৭/৩১/৩৫ ধারায় কোনো নাগরিকের ই-মেইলে আড়িপাতার কোনো বিধানই নেই; মামলা, গ্রেফতার, বিচার কিংবা দণ্ডদান তো অনেক পরের কথা।
বিতর্কিত এই আইনের ২৭ নং ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন এবং জনগণের মধ্যে ভীতিসঞ্চারের জন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে বৈধ প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বা করায়, তাহলে সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর কারাদণ্ড; জরিমানা এক কোটি টাকা। ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ অরাজকতা সৃষ্টি করলে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
৩৫ ধারায় অপরাধে সহায়তায় দণ্ডের বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার, মেজর (অব:) হাফিজউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামক আইনের ২৭/৩১/৩৫ ধারায় যে মামলা করা হয়েছে, সেই ধারায় ই-মেইলের কোনো উল্লেখই নেই! অনিয়মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ‘মিডনাইট সরকার’ জনগণের টেলিফোনের পর এবার ই-মেইলেও আড়িপাতা শুরু করেছে, যা বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা’ এবং সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘নাগরিকের যোগাযোগের রক্ষণ’ সম্পর্কিত মৌলিক অধিকারের পুরোপুরি লঙ্ঘন। আসলে সরকার এসব কালো আইনের অধীনে জনগণকে জেল-জুলুমের ভয় দেখিয়ে, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন-সংক্রান্ত জনগণের তথ্য জানার আইনি অধিকার এবং দেশবিশেষকে ‘আজীবন মনে রাখার মতো’ সব কিছু উজাড় করে দেয়ার গোপন চুক্তি, যাতে জনগণ জানতে না পারে, তার সুরক্ষার বিধান দৃশ্যত তৈরি করেছে।
সরকারের দুর্নীতি এবং জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী চুক্তির বিরুদ্ধে মুখ খুললেই এখন যাতে বানোয়াট অভিযোগ দিয়ে যে কাউকে ঘায়েল করা যায়, সেটাই মেজর (অব:) হাফিজউদ্দিনকে মামলায় গ্রেফতার করে প্রতিবাদী জনগণকে জানিয়ে দিলো বর্তমান সরকার। বাংলাদেশের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে তা নস্যাৎ করে স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে নতজানু করে সরকার দেশের সাংবাদিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে জনগণের চোখে হলুদ, চাটুকার ও আস্থাহীন করে তুলেছে।
ক্ষমতাশালীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিংবা দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো সাংবাদিক যদি কিছু বলতে যায় তাহলে সরকারের চোখে তিনি হবেন ‘অপরাধী’! তাহলে কি যারা লজ্জাকর চুক্তি করবে তারা ‘দেশপ্রেমিক’! দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কার্যত হারিয়ে গেছে। এবার বিরোধী নেতাদের সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার অধিকার কেড়ে নেয়ার শঙ্কা প্রবল হয়ে উঠল। ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার যেন নাগরিকদের রইল না।
লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ