শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রের সমাপ্তি!
গোতাবায়া রাজাপাকসা - ছবি : সংগৃহীত
এশিয়ার অন্যতম গণতন্ত্রটি সম্ভবত বিপর্যয়ে পড়েছে। আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্ভবত রাজাপাকসা পরিবারের আরেক সদস্যকে ক্ষমতায় আনবে। এই লোকটির স্বৈরতান্ত্রিকতা, সহিংসতা ও দুর্নীতির প্রতি আসক্তির কথা সবার জানা। গত পরীক্ষায় (এক বছর আগে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা সাংবিধানিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন ) শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্র টিকে গেলেও গোতাবায়া রাজাপাকসার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তা সম্ভবত টিকে থাকবে না।
সিরিসেনার উত্তরসূরী হওয়ার লড়াইয়ে গোতাবায়াই এগিয়ে রয়েছেন। তার বড় ভাইয় মহিন্দা রাজাপাকসার আমলে তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ২০১৫ সালে শেষ হওয়া মহিন্দার দশক-দীর্ঘ আমলটি ব্যাপক স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ছিল। এ সময় চার রাজাপাকসা ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা মন্ত্রণালয়গুলোতে মোট সরকারি ব্যয়ের প্রায় ৮০ ভাগ হতো। আর প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়তে বাড়তে তা প্রায় স্বৈরতন্ত্রের কাছাকাছি চলে এসেছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘন আর যুদ্ধাপরাধের ব্যাপক অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছিল।
অধিকন্তু, মহিন্দার চীনামুখী পররাষ্ট্রনীতির ফলে শ্রীলঙ্কায় চীনা পভাব দ্রুত বাড়ছিল, চীনের কাছে শ্রীলঙ্কার ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায়। রাজাপাকসার আমলের ঋণের কারণেই ২০১৭ সালে সিরিসেনাকে ভারত মহাসাগরের কৌশলগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হাম্বানতোতা ও এর আশপাশের ১৫ হাজার হেক্টর এলাকা চীনের হাতে তুলে দিতে হয়েছিল। ঊনিশ শতকে এই পদ্ধতিতেই হংকংকে তুলে দিয়ে চীনের ওপর ব্রিটিশ উপনিবেশের পথ তৈরি হয়েছিল।
গোতাবায়া যে তার ভাইয়ের দমননীতিগুলো আবার ফিরিয়ে আনবেন না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে সামান্যই। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ামাত্র প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়কার যুদ্ধাপরাধের মামলা থেকে সুরক্ষা পেয়ে যাবেন।
মহিন্দার আমলে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার ২৫ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। কিন্তু তিনি শান্তির বার্তাবাহক ছিলেন না। যুদ্ধের শেষ দিকে হাজার হাজার সাহায্যকর্মী, তামিল বেসামরিক নাগরিক এবং এমনকি রাজাপাকসা পরিবারের সমালোচক গুম হয় কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়। আর জাতিসঙ্ঘের ভাষায় তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সামরিক অভিযানটি ছিল আন্তর্জাতিক আইনের পুরো ব্যবস্থার ওপর চরম আঘাত। এতে ৪০ হাজারের মতো বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিল। যুদ্ধকালীন সামরিক কমান্ডার সরথ ফনসেকার মতে, আত্মসমর্পণকারী বিদ্রোহী নেতাদের গণহারে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন গোতাবায়া।
শ্রীলঙ্কার তামিল সংখ্যালঘুদের (প্রধানত হিন্দু) ওপর নৃশংসতা চালানো সত্ত্বেও রাজাপাকসা ভাইয়ের দেশটির বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের কাছে বীর হিসেবে পরিচিতি পায়। এতে বহুজাতিক দেশটিকে একক জাতিগত দেশে পরিণত করতে আরো সাহসী হয়ে ওঠেন মহিন্দা।
গোতাবায়া বিভক্তি তো বাড়িয়ে দেবেনই, সেইসাথে সিংহলি ও শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনা তীব্র করবেন। উল্লেখ্য, গত এপ্রিলে ইস্টার সানডে বোমা হামলায় ২৫৩ জনের নিহত হওয়ার ঘটনার পর ওই উত্তেজনা বেড়ে গেছে।
শ্রীলঙ্কায় এটিই ছিল প্রথম ইসলামপন্থীদের হামলা। এরপর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা দেশটির মুসলিমরা (তারা মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশ) তেমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েনি।
রাজাপাকসারা ইতোমধ্যেই ওই হামলাকে ব্যবহার করে সিংহলি জাতীয়তাবাদ উস্কে দিয়েছেন। আর গোতাবায়া তার সমর্থকদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে নির্বাচিত হলে তিনি ইসলামি চরমপন্থীদের দমন করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা বাড়াবেন, নজরদারির ওপর জোর দেবেন। ফলে সংখ্যালঘু, মিডিয়া ও নাগরিক মুক্তি আন্দোলনে জড়িতরা বিপদে পড়বেন।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট