ভারতের সামরিক শিল্প যে কারণে পিছিয়ে পড়ছে
ভারতের সামরিক শিল্প যে কারণে পিছিয়ে পড়ছে - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের প্রথম দেশীয় বিমানবাহী রণতরী বিক্রান্তর নির্মাণকাজ চলছিল কোচিন শিপিয়াড লিমিটেডে (সিএসএল)। কাজে বিরতি দিতে হয়েছিল। রণতরীটির চারটি কম্পিউারের হার্ড ডিস্ক, মেমোরি চিপস আর প্রসেসর খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্থানীয় পুলিশ ঘটনাটি তদন্তের জন্য একটি দল গঠন করা হয়।
ভারতীয় নৌবাহিনী দাবি করেছিল যে চুরি হওয়া কম্পিউটারগুলোর মালিক শিপিয়ার্ডের। রণতরীটি এখনো নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর না করায় তাদের কোনো তথ্য চুরি হয়নি। ফলে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কোনো হুমকি সৃষ্টি হয়নি। তবে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তায় কোনো প্রভাব পড়ুক বা না পড়ুক, ভারতীয় সামরিক শিল্পে দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকা সমস্যার আবারো বিশ্বের সামনে চলে এসেছে। এ তথ্য জানিয়েছে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) একমাত্র ইংরেজি ভাষাভাষী নিউজ ওয়েবসাইট চায়না মিলিটারি অনলাইন।
বিমানবাহী রণতরী বিক্রান্তে চুরিটি হয়েছিল ২০০৮ সালে নির্মাণকাজের শুরুতেই। এটি ২০১০ সালে চালু করার কথা ছিল। কিন্তু অভিজ্ঞতা ও শিল্প দক্ষতার অভাবে ২০১৩ সালের আগে তা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২১ সালে এটি সরবরাহ করা হবে।
রণতরীটি ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হলেও ওই সময় এর মাত্র ৩০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এছাড়া একে দুবার ড্রাই ডক থেকে পানিতে সরাতে হয়েছিল। একবার ২০১১ সালে অন্যান্য প্রকল্পের জন্য শিপিয়ার্ডটির প্রয়োজন পড়েছিল। আরেকবার ২০১৫ সালে। ওইবার নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখার জন্য আবার ড্রাই ডকে ফিরিয়ে আনা হয়।
২০১৮ সালে সিএসএলে নির্মাণাধীন একটি ড্রিল জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটে। সৌভাগ্যবশত বিক্রান্ত তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এসব ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে সিএসএলের উৎপাদন পরিকল্পনা, সংগঠন, ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা নিয়ে মারাত্মক সমস্যা রয়েছে এবং বিক্রান্তের নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ করার সম্ভাবনা খুবই কম।
এ ধরনের সমস্যা ভারতীয় সামরিক উদ্যোগে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। ভারতের একমাত্র বিমান নির্মাণ কারখানা হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লি. (এইচএএল) ব্যাপক মাত্রায় দুর্ঘটনার জন্য পরিচিত। এখানে সংযোজিত বা মেরামত করা অনেক বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। ১৯৯৪ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত এখানে দুটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান ও আটটি বিমান ওভারহোলিং করা হয়। এগুলোর মধ্যে আটটি বিধ্বস্ত হয়েছে। আর তিনটি সেপেক্যাট জাগুয়ার অ্যাটাকার সংযোজন ও ৫টি ওভার হোলিং করা হয়। এগুলোর ছয়টি বিধ্বস্ত হয়। এছাড়া চারটি মিরেজ ২০০ জঙ্গিবিমান ও তিনটি মিগ-২৯ বিমান ওভারহোলিং করা হয়। সবগুলোই বিধ্বস্ত হয়েছে।
ভারতীয় সামরিক শিল্পে বারবার মারাত্মক সমস্যায় পড়ার মূল কারণ হলো অব্যাহতভাবে অস্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা ও স্বাধীন আর অ্যান্ড ডির প্রতি অবহেলা। ভারত সরকার সাম্প্রতিক সময়ে তার সামরিক শিল্পের স্বাধীনতা জোরদার করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও গভীরে থাকা সমস্যাগুলো রাতারাতি নিরসন করা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় কারণ হলো, ভারতের দুর্বল শিল্প ভিত্তি। দেশটির জাতীয় শিল্প স্বাধীনতার হার অনেক বছর ধরেই ১৫ ভাগ। তাছাড়া পশ্চাদপদ শিল্প সামর্থ্য সামরিক শিল্পের মানসম্পন্ন কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ যোগান দিতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বিক্রান্ত হলো ভারতে তৈরি স্টিলে নির্মিত রণতরী। কিন্তু সিএসএল পর্যাপ্ত পরিমাণে স্টিল না পাওয়ায় কয়েকবারই নির্মাণকাজ বন্ধ করতে হয়েছিল।
এদিকে ভারতে সামরিক-শিল্প প্রতিভার অভাব রয়েছে। মান ও গুণ কোনো দিক থেকেই চাহিদা মেটানোর মতো সামরিক-শিল্প বিকশিত হয়নি। ফলে ভারতের সামরিক-শিল্প কয়েক দশক পিছিয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৮০-এর দশকে নাগ ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ শুরু হলেও তা ব্যাপক উৎপাদনে যেতে সক্ষম হয়েছে মাত্র চলতি বছর। দুটি শতাব্দীর তিনটির বেশি বছর লেগেছে সাফল্য পেতে।
সর্বশেষে বলা যায়, ভারতের সামরিক বাহিনী দেশটির অস্ত্র ও সরঞ্জামের যে টার্গেট নির্ধারণ করেছে, তা বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি। এই টার্গেট কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়।
অধিকন্তু, ভারতের সামরিক ক্রয়ে দুর্নীতি ও অসাধুতা মারাত্মক পর্যায়ে বিদ্যমান এবং দেশীয়ভাবে তৈরী সরঞ্জামের যেকোনো বিক্রিতে ঘুষের লেনদেন থাকে।
চায়নামিল.কম.সিএন