নেপালে চীনা হুঙ্কার : টার্গেট কে?
নেপালে চীনা হুঙ্কার : টার্গেট কে? - ছবি : সংগৃহীত
যেকোনো হিসেবেই এটি ছিল বিশ্বের বৃহত্তম প্রজাতন্ত্রটির নির্বাহী প্রধানকে রাজকীয় অভ্যর্ত্থনা। শনিবার বিকেলে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে বহনকারী এয়ার চায়নার বিমানটি অবতরণের সময় রাষ্ট্রপতি বিদ্যা ভান্ডারি থেকে প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি এবং তাদের পুরো মন্ত্রিসভা ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিলেন।
দীর্ঘ ২৩ বছর পর কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের নেপালে যাওয়াটাই একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক ঘটনা। কিন্তু এটি আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ হয়ে পড়ে যখন ১৯৯৬ সালে জিয়াঙ জেমিনের নেপাল সফরের সাথে দক্ষিণ এশিয়াসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীন-সম্পর্কিত বর্তমান ধারণা ও বাস্তবতার তুলনা করা হয়।
অধিকন্তু, সেই ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন সংবিধান ঘোষণা স্থগিত করার জন্য ভারতীয় চাপ প্রতিরোধ করার প্রেক্ষাপটে ভারত প্রায় ৫ মাস ধরে নেপালের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার পর কাঠমান্ডু তার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও ট্রানজিটের জন্য উত্তর দিকে মুখ ফেরানোর প্রেক্ষাপটে এই সফরটি অনুষ্ঠিত হলো।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে তামিলনাড়ুতে দু’দিনের অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠকের পর সেখান থেকে সরাসরি নেপাল রওনা হন। মোদির সাথে শি নেপালের দীর্ঘ পরিবর্তন পরিক্রমতাসহ গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ইস্যুগুলো আলোচনা করেন।
তবে নেপাল ও বিশ্বকে চীন একেবারে পরিষ্কার একটি বার্তা দিয়েছে। তা হলো সে নেপালকে আলাদাভাবে দেখে এবং নেপালের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও নিজের প্রকৃত প্রয়োজনের আলোকে উন্নয়ন ধারা বাছাই করে নেয়ার অধিকারকে সমর্থন করে। কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে ভারত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থনে ২০০৬ সালে হিন্দু রাজতন্ত্র থেকে সেক্যুলার প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়ার পর থেকে চীন দেশটিতে তার স্বার্থ ও বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। চীন মনে করে, ওই দেশ বা শক্তিগুলো নেপালে বসবাসরত তিব্বতিদের উস্কানি দিয়ে তার নাজুক অংশ তিব্বতে গোলযোগ পাকাতে পারে।
শির নেপালে অবস্থানের সময় ‘ফ্রি তিব্বত’-এর প্রায় ৫০ জন অ্যাক্টিভিস্টকে আটক করা হয়, তিব্বতি জনসংখ্যার বসবাসপূর্ণ এলাকা বৌদ্ধা, স্বাম্ভু ও জাওয়ালাখেল এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বিমানবন্দর থেকে সোয়ালতি হোটেল পর্যন্ত পুরো সাত কিলোমিটার এলাকা নিরাপত্তা সংস্থাগুলো টহল দেয়। নেপাল সরকার চীনা কর্তৃপক্ষের স্পর্শকাতরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার কোনোই সুযোগ রাখেনি।
সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, স্বাগত জানানোর আনুষ্ঠানিকতা ছিল নজিরবিহীন। তবে চীনা প্রেসিডেন্ট দৃশ্যমানভাবেই তোষামোদ পেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, আগামী বছরগুলোতে চীন ও নেপালের সম্পর্ক কোথায় থাকবে। তাছাড়া তিনি তার নেপালি কমরেডদেরকেও সূক্ষ্ম হুঁশিয়ারি করে দিয়ে বলেন যে তাদের জীবনযাত্রা হতে হবে স্বচ্ছ এবং তাদের কাজ করতে হবে জনগণের জন্য। বিশেষ করে চীনা ঋণ নিয়ে যাতে কোনো নয়-ছয় করা না হয়, সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাদের সতর্ক করে দেন।
জ্বালানি, অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তা, রেল ও বিমান কানেকটিভিটি, চীনা ভাষা কেন্দ্রসহ বৃহত্তর সহযোগিতার জন্য দুই পক্ষ প্রায় ২০টি সমঝোতা স্মারকে সই করে। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল মিউচুয়াল লেগাল অ্যাসিস্ট্যান্স (এমএলএ) অন ক্রিমিনালবিষয়ক চুক্তি। অনেকে মনে করছেন, এর ফলে দুই দেশ অপরাধীদের অন্য দেশে পাঠাতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলির সাথে সংক্ষিপ্ত বৈঠককালে শি জোর দিয়ে বলেন যে চীনকে বিভক্ত করা বা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাওয়া যেকোনো শক্তিকে চীন গুঁড়িয়ে দেবে। ওলির সামনে তিনি এমন কথা কেন বললেন?
ধারণা করা হয়ে থাকে নেপালকে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির আওতায় নিয়ে যেতে চান ওলি। তিনি অতীতে প্রত্যাবাসন চুক্তিতে সই করতে অস্বীকৃতি জানালেও ওই বৈঠকের পর এবার তাতে রাজি হয়ে যান। প্রত্যাবাসন চুক্তি ও এমএলএর ফলে ফ্রি তিব্বত বা চীনবিরোধী তৎপরতায় জড়িত যেকোনো লোককে যদি চীন মনে করে তার স্বার্থের প্রতি ক্ষতিকর, তবে তাকে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হবে নেপাল। এত দিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের চাপে এই চুক্তিতে সই করতে রাজি ছিল না নেপাল। এখন চুক্তির পর পাশ্চাত্য অবশ্যই চাপ দেবে। আর ওই চাপ নিশ্চিতভাবেই নেপালের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে না।
এর মানে হলো, রাজনৈতিক ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারত, চীন ও পাশ্চাত্যের সাথে এখন আরো ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করতে হবে নেপালকে। তবে শির সফরের পর নেপালে চীনের উপস্থিতি বাড়বে, বিনিয়োগও বাড়বে। তবে নেপালি কমিউনিস্ট পার্টিতে যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে, তা কোন দিকে যায়, তা বলা কঠিন। প্রধানমন্ত্রী ওলি ও রাষ্ট্রপতি বিদ্যা ভান্ডারির মধ্যে বেশ টানাপোড়েন চলছে। আবার ক্ষমতাসীন দলের কো-চেয়ারম্যান পুস্প কমল দহল প্রচন্ডও আলাদাভাবে শির সাথে সাক্ষাত করার সুযোগ পাননি। তিনি পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য শির সাথে কথা বলতে পেরেছিলেন।
যাই হোক, শি এমন এক সময় নেপাল সফর করলেন, যখন নেপালে ভারতের অবস্থান ও প্রভাব নজিরবিহীন নিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। তবে নেপালে চীনের বৃহত্তর উপস্থিতি যে নেপালে গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন প্রদান করার নামে (যদিও চীন মনে করে, আসলে তাদের উপস্থিতির নেপথ্যে রয়েছে তিব্বতে গোলযোগ সৃষ্টি) যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ব্যাপক উপস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় হয়েছে, তাতে সংশয় নেই।
শি তার অবতরণের আগে সরকারি মালিকানাধীন দি রাইজিং নেপালের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘হিমালয়জুড়ে চীন-নেপাল বন্ধুত্বের বৃহত্তর অগ্রগতি’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে স্পষ্টভাবে বলেছেন, নেপালে কেবল চারটি ক্ষেত্রে (বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, জ্বালানি, দুর্যোগ-পরবর্তী নির্মাণ, পর্যটন) সহযোগিতাই নয় বরং দেশটির সাথে চীন নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করতে চায়।
সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি কেবল শি যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনভাবেই হয়নি, সেইসাথে সীমান্তজুড়ে প্রতিরক্ষা চুক্তি বাড়াতেও দুই পক্ষ সম্মত হয়েছে।
অতীতে যখন বাণিজ্য ও সরবরাহ নিয়ে ভারতের সাথে নেপালের সমস্যার সৃষ্টি হতো, তখন চীন দেশটিকে পরামর্শ দিত যে তারা তাদের কাছে ভারতের বিকল্প হওয়ার মতো অবস্থানে নেই এবং নেপালকে অবশ্যই দক্ষিণের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
কিন্তু ভারত এখন পাশ্চাত্যের সাথে জোট বাঁধায়, পাশ্চাত্যের কাছে প্রায় একতরফাভাবে তার প্রভাব ছেড়ে দেয়ায় চীন আর আগের মতো চিন্তা করতে পারছে না। শির সফরটি ওই ধারণার আলোকে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। তবে সামনের দিনগুলোতে দেখার বিষয় হবে, কিভাবে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক এজেন্ডা নির্ধারণে নেপালি জনগণের চেয়ে অনেক বেশি সিদ্ধান্তসূচক শক্তির অধিকারী আন্তর্জাতিক শক্তির সাথে ভারসাম্য বিধান করে।