হংকং নিয়ে আরেক খেলা
হংকং নিয়ে আরেক খেলা - ছবি : সংগ্রহ
কারো সর্বনাশে কারো পৌষমাস আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবেই পরিচিত হংকংয়ের সাম্প্রতিক সেই সর্বনাশে পৌষমাস এসেছে সিঙ্গাপুরে। পূর্ব এশিয়ায় সেরা দুই বাণিজ্যিক হাব বিবেচনা করা হয় হংকং ও সিঙ্গাপুর এ দুটি অঞ্চলকে। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, বন্দর, যোগাযোগ সব দিক দিয়ে ব্যবসায় বাণিজ্যের জন্য এ দুটি আকর্ষণীয় অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত।
দুটি অঞ্চলের মধ্যে অনেক বিষয় রয়েছে কমন। উভয়টিই বাণিজ্যবান্ধব। ব্যবসায় করার ক্ষেত্রে উভয় জায়গাতেই আইন-কানুন বেশ সোজা। আমলাতান্ত্রিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি বা লাল ফিতার দৌরাত্ম্য নেই বললেই চলে। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংক বিশ্বের ১৯০টি দেশ নিয়ে যে ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স বা ব্যবসায় সহজ সূচক তৈরি করেছে, তার মধ্যে হংকংয়ের স্থান চতুর্থ। আর সিঙ্গাপুরের স্থান দ্বিতীয়। উভয় অঞ্চলই নিজের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বেশ গর্বিত। উভয় স্থানেই সার্বিক পরিস্থিতি যেকোনো দেশের জন্য গর্ব করার মতো।
উপরি উক্ত তথ্যগুলো প্রায় চার-পাঁচ মাস আগের। এ মুহূর্তে ওই তথ্যগুলো কেবল একটি জায়গা অর্থাৎ সিঙ্গাপুরের জন্যই ব্যবহার করা যাচ্ছে। কারণ গত তিন-চার মাসে হংকংয়ে যে অস্থিতিশীলতা চলছে, তাতে সেখানে সার্বিক পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে।
রাজপথে অব্যাহত বিক্ষোভ, ভাঙচুর, মেট্রো ও বিমান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা, পুলিশের পাল্টা ব্যবস্থা- হংকংয়ে ব্যবসায়িক পরিবেশের দীর্ঘ দিনের সুনামকে একেবারে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে। ব্যবসায়িক কাজ হোক কিংবা পর্যটন এক ধাক্কায় সব দিক দিয়েই বেশ অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছে হংকং। আর এর ফলে সুবিধা হয়েছে সিঙ্গাপুরের। অলৌকিক কোনো কিছু নয়। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতিতে যা হয়, প্রত্যাশিতভাবে ঠিক তাই ঘটেছে। সমমর্যাদা বা সব সুবিধাসম্পন্ন দুটি এলাকার একটিতে যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে এর সুবিধাভোগীরা তেমন কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই বিকল্পটি গ্রহণ করে। এ দুটি অঞ্চল বা দেশের ক্ষেত্রেও সে ঘটনাই ঘটেছে। যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো হংকংয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল, এ কয়েক মাসের অস্থিরতায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। এ অবস্থায় তারা হংকংয়ে তাদের ব্যবসায় গুটিয়ে পাড়ি জমাতে শুরু করেছে সিঙ্গাপুরে। একই অবস্থা পর্যটনেও। পর্যটকদের কাছে একই ধরনের মর্যাদা পেয়ে থাকে এ দুটি অঞ্চল। সুতরাং এ অবস্থায় কোনো ঝুঁকি না নিয়ে সিঙ্গাপুরকেই তাদের গন্তব্য বানিয়ে নিয়েছেন পর্যটকরা। সর্বসাম্প্রতিক পর্যটকদের যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেছে, গত বছরের আগস্টের তুলনায় এ বছরের আগস্টে হংকংয়ের পর্যটক কমেছে ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে মূল ভূখণ্ড চীনের পর্যটক কমেছে ৪২ শতাংশ। পক্ষান্তরে এই আগস্টেই সিঙ্গাপুরে গত বছরের একই মাসের তুলনায় চীনা পর্যটক বেড়েছে চার শতাংশ। সব মিলিয়ে ২১ শতাংশ চীনা পর্যটক আগস্টে বেড়াতে গেছে সিঙ্গাপুরে, যাদের ৮০ শতাংশেরই যাওয়ার কথা ছিল হংকংয়ে।
একই অবস্থা দেখা গেছে ব্যাংকিং খাতেও। হংকংয়ের ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ তুলে নেয়ার হিড়িক পড়েছে। যার বেশির ভাগই আবার গিয়ে জমা হচ্ছে সিঙ্গাপুরের ব্যাংকগুলোতে। একই অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি এত বড় আকার ধারণ করেছে যে, হংকংয়ের ডলারের মান নিম্নমুখী হওয়ার পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। আনুমানিক যে হিসাব করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, ৪০০ কোটি ডলারের তহবিল হংকং থেকে উড়ে গেছে সিঙ্গাপুরে।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত গত বছরের তুলনায় দেশটিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। হংকংয়ের খুচরা ব্যবসায়ের প্রধান ক্রেতা ছিল চীনারা। প্রতিদিন ট্রেনে, বিমানে, ফেরিতে করে চীন থেকে হাজার হাজার লোক আসত হংকংয়ে কেনাকাটা করতে। কারণ বিদেশী ব্র্যান্ডের অনেক পণ্য চীনের চেয়ে এখানে সস্তা। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতির জেরে চীনাদের আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হংকংয়ের খুচরা ব্যবসায়ের অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে যায়।
এমনিতে হংকংসহ চীনের অন্যান্য অংশের ধনী গোষ্ঠীর পছন্দের তালিকায় আগে থেকেই শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর। যেখানে সম্পত্তি গড়ে তোলার প্রবণতা তাদের অনেক আগে থেকেই। ২০১৭ সাল থেকে এই অল্প সময়ের মধ্যে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকেই এক হাজারের বেশি মানুষ সিঙ্গাপুরে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ে তুলেছেন, কলেবর বৃদ্ধি করেছেন। বিদেশীদের জন্য সম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ স্ট্যাম্প শুল্ক দিয়েই তারা এ সম্পদ জমা করেছেন সিঙ্গাপুরে।
সাম্প্রতিক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি হংকংকে অনেকখানি বিপদে ফেলেছে। কিন্তু এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেও হংকং থেকে বেশ কিছু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসায় গোটাতে শুরু করেছিল। কারণ এ হংকংকে যেমন চীনা নিয়ন্ত্রণের চাপ সইতে হয়, তেমনি সাংহাই ও শেনজেনের মতো চীনা অঞ্চলগুলোর সাথেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে টিকে থাকতে হয়। অথচ হংকংয়ের মতো চাপ ওই দুটি চীনা প্রদেশে একেবারেই নেই। আবার আন্তর্জাতিকভাবে হংকংকে একই সাথে সিডনি, সিঙ্গাপুর ও টোকিওর মতো উন্নত শহরগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। প্রতিযোগিতার বিচারে সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে এ ধরনের চাপ অনেক কম।
চীনের ধনীদের মধ্যে যারা দেশের বাইরে সম্পত্তি গড়তে চাইছে, বিনিয়োগ করতে চাইছে, তাদের কাছে হংকংয়ের চেয়ে সিঙ্গাপুর অনেক বেশি পছন্দের। ব্যবসায় বাণিজ্যসহ সামগ্রিক বিষয়ে চীনের প্রভাব থাকায় তারা এ ক্ষেত্রে ভীতি অনুভব করে। যদি হংকংয়ের বর্তমান অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে হংকং তার ব্যবসায় বাণিজ্য, প্রবৃদ্ধি, সুনাম সবই হারাবে। আর সে কারণে অবধারিতভাবে আরো লাভবান হবে সিঙ্গাপুর।
হংকং ও সিঙ্গাপুরে ভিন্ন রকম রাষ্ট্রব্যবস্থা বিদ্যমান। সিঙ্গাপুরে রয়েছে অনুদার গণতন্ত্র।
অন্য দিকে হংকংয়ে উদার স্বৈরতন্ত্র বিদ্যমান। প্রথমটির ক্ষেত্রে সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়, তবে গণবিক্ষোভ বা রাজনৈতিক বিতর্ক ইত্যাদি আইন করে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। অপর দিকে, হংকংয়ে কিছু লোকের ভোটে নির্বাচিত হন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী। সেখানকার এ নির্বাচন পক্ষপাতমূলক হয় বলে অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। পাশাপাশি আইনসভাও হয় দুর্বল। তবে সেখানে বাক স্বাধীনতা ও বিক্ষোভের দীর্ঘ ঐতিহ্যও রয়েছে। সিঙ্গাপুরে এ বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রিত থাকায় সেখানে অপেক্ষাকৃত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করে।
সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি ঐতিহাসিকভাবে সর্বাপেক্ষা উন্নত মুক্তবাজার অর্থনীতির ফসল রূপে গড়ে উঠেছে। হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুর- এ চারটি এশিয়ার অর্থনীতিতে বাঘ হিসেবে পরিচিতি পেলেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক থেকে সিঙ্গাপুর বেশ এগিয়ে।
১৯৬৫ থেকে মালয়েশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি বেশ ছোট আকারের ছিল। পাশাপাশি বেকারত্ব ও দারিদ্র্যতাও ছিল উচ্চপর্যায়ের। ৭০ শতাংশ নাগরিক জনবহুল পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করত। শহরের বস্তিগুলোয় এক-তৃতীয়াংশ লোকের বাসস্থান ছিল। মোট জনসংখ্যার অর্ধেক লোক ছিল অশিক্ষিত। কিন্তু এ অবস্থা থেকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায় দেশটি। ১৯৯২ সালের মধ্যে দেশের মূলধন ৩৩ গুণ বৃদ্ধি পায়। জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং নিম্ন শ্রেণীর পরিবারগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে পরিণত হয়। পরবর্তী ২৭ বছরে দেশটি সামনে এগিয়েছে আরো অনেকখানি। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি উন্নত হওয়ায় স্থিতিশীলতা আসে দেশের সার্বিক ক্ষেত্রে।
তবে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বাদ দিয়ে এমন স্থিতিশীলতা সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করলেও সেখানে যে সবাই এ ব্যবস্থাটিকে পছন্দ করেন, তা নয়। হংকংয়ে বিক্ষোভের সমর্থনে সিঙ্গাপুরে বিক্ষোভ-সমাবেশ-র্যালিসহ কোনো ধরনের কর্মসূচি পালন করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হংকংয়ে আন্দোলন চলাকালে এক বিক্ষোভকারী (ধারণা করা হচ্ছে সে সিঙ্গাপুরের নাগরিক) দাবি জানায়, হংকংকে সিঙ্গাপুরে পরিণত হতে দেবেন না। সেখানে মানুষ ভয়ের মধ্যে বাস করে। সিঙ্গাপুরে জরিপ করে জনমত বের করাও কঠিন কাজ। তবুও গত জুলাইয়ে যে জনমত প্রকাশ পেয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিলÑ সিঙ্গাপুরের অন্তত ৭৫ শতাংশ লোক হংকংয়ের এ আন্দোলনের সাথে সহানুভূতি প্রকাশ করে।
ফলে হংকংয়ের এ অস্থিতিশীলতায় সিঙ্গাপুর যে কেবল লাভের গুড়ই খাবে, তা না-ও হতে পারে। হয়তো হংকংয়ের সাম্প্রতিক অবস্থার আঁচ লাগতে পারে সিঙ্গাপুরেও। আর সে ক্ষেত্রে পরিণতিও হতে পারে অভিন্ন।