কঠিন মনোভাব! বদলে যাচ্ছে ভারতের সাথে বিএনপির সমীকরণ
২০১২ সালে ভারত সফরকালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথে বেগম খালেদা জিয়া - ছবি : সংগৃহীত
‘ভারতের দালালরা, হুঁশিয়ার-সাবধান’। গত চার দিন আগে বিএনপির একটি সমাবেশ ছিল এ ধরনের স্লোগানে মুখর। গত এক দশকে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে এ ধরনের সেন্টিমেন্ট প্রকাশ্যে খুব একটা দেখা যায়নি। সম্প্রতি ভারতের সাথে সম্পাদিত চারটি চুক্তিকে দেশের ‘স্বার্থবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে ওই সমাবেশটি করে বিএনপি। তাহলে কি ভারতের সাথে বিদ্যমান ‘অনাস্থার’ সম্পর্কের কৌশলগত দিকটি বিএনপি পুনর্মূল্যায়ন করছে?
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে তোষামোদির সম্পর্ক চায় না তারা। গত দু’টি জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে একটি সুনির্দিষ্ট দলের পক্ষে দেশটির ভূমিকাও বিএনপি নেতাদের মধ্যে দাগ কেটেছে। এই সময়ে দলটি নানামুখী চেষ্টা করেও ভারতের সাথে ‘ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক’ তৈরি করতে পারেনি। নেতারা বলছেন, দেশটি বিএনপিকে অহেতুক ‘আস্থায়’ নেয়নি। বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারত ইচ্ছা করলে প্রতিবেশী দেশেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারত।
ভারতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই ভারতের সাথে বিএনপির সম্পর্কের সূচনা হয়। এই সম্পর্কের উৎস ছিল ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি। ভারতীয় এই নেতার সাথে জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। ১৯৭৭ সালে বাজপেয়ি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৮০ সালে তিনি বিজেপির প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই সূত্র ধরে বিএনপির সাথে বিজেপির একটি ‘দার্শনিক’ সম্পর্ক তৈরি হয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল কংগ্রেসের সাথেও জিয়াউর রহমানের ভালো সম্পর্ক ছিল। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথেও তিনি ঘনিষ্ঠ ছিলেন। জিয়াউর রহমান ফারাক্কা চুক্তিকে গ্যারান্টি ক্লজের আওতায় এনেছিলেন। একই সাথে তিনি ছিলেন সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা। বিএনপির নেতারা বলেছেন, ভারত সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় ছিল বলেই জিয়াউর রহমান ফারাক্কা চুক্তি ও সার্ককে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলেন।
পরবর্তীতে বিএনপি দুইবার ১৯৯১ ও ২০০১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ক্ষমতার মধ্য-মেয়াদের দিকে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান আটকের ঘটনা ঘটে। এই ইস্যুতে ভারতের সাথে বিএনপির সম্পর্কে ফাটল তৈরি হয়। ভারত এবং বিএনপি বিরোধীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়-অস্ত্রের চালানটি সরকারের ছত্রছায়ায় আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী দল উলফার কাছে পাঠানোই ছিল উদ্দেশ্য। যদিও বিএনপি সরকার এ ধরনের কোনো সংযোগ থাকার কথা উড়িয়ে দেয়। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়- ‘যদি এটি সরকারের পরিকল্পনাই হতো, তাহলে কেন অস্ত্রের চালান আটক হবে। সেটি যেখানে পাঠানোর কথা সেখানেই চলে যেত। অথচ সরকারই ওই চালান আটক করেছে।’ যদিও বিএনপির এই বক্তব্য ভারত সরকার আর আমলে নেয়নি।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে, এখনো রেফারেন্স হিসেবে এই ইস্যুটি সামনে আনেন ভারতীয় কর্তাব্যক্তিরা।’
তবে সম্পর্কের এমন অবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখা যায় ২০১২ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের দিকে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া তখন ভারত সফর করেন। ওই সফরে বেগম জিয়াকে অভূতপূর্ব সম্মানের সাথে গ্রহণ করে ভারত সরকার। তখন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস সরকার। সেই সফরে তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, বিরোধীদলীয় নেত্রী সুষমা স্বরাজ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, পররাষ্ট্রসচিব রঞ্জন মাথাই, জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা শিবশংকর মেননের সাথে বৈঠক করেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথেও সাক্ষাৎ হয় তার। এসব বৈঠকে বাংলাদেশের মাটিকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহার করতে না দেয়ার কথা বলেন খালেদা জিয়া। এক সপ্তাহের ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে তিনি বলেছিলেন- ‘সফর সফল হয়েছে।’
কিন্তু এই সফরের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ২০১৩ সালের মার্চে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তার তিন দিনের সফরের দ্বিতীয় দিনে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাতের শিডিউল ছিল। কিন্তু হরতাল থাকায় ওই দিন ‘নিরাপত্তার’ কারণে সাক্ষাৎ বাতিল করেন বিএনপি প্রধান। প্রণব মুখার্জির সাথে এই সাক্ষাৎ বাতিল করার বিষয়টিও ভালোভাবে নেয়নি ভারত। তখন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকেও এই নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হয়। প্রণব মুখার্জির সাথে সাক্ষাৎ বাতিল করার সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল বলেও বিএনপির কেউ কেউ মনে করেন। নির্বাচনের আগের বছরে এই ঘটনাটি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনেও প্রভাব ফেলেছে বলে অনেকের মত। ওই নির্বাচনের আগে ভারত সরকার তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে অনেকটা প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করে। বিএনপির বর্জনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের রক্তক্ষয়ী ওই নির্বাচনের পরেও ভারত সরকার কোনো সমালোচনা না করে নতুন সরকারকে স্বাগত জানায়।
বিএনপির কূটনৈতিক তৎপরতার সাথে যুক্ত এক নেতা নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘১০ ট্রাক অস্ত্র ও প্রণব মুখার্জির সাথে সাক্ষাৎ বাতিলের ইস্যুটি ভারত সরকার রহস্যজনকভাবে এখনো জিইয়ে রেখেছে। এমনকি বিএনপির নেতৃত্ব ও তাদের নির্বাচনী জোটের কোনো কোনো শরিক দল নিয়েও তাদের পর্যবেক্ষণ রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি দেশের জনগণের স্বার্থে যেখানে ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নতি চাচ্ছে, কিন্তু তাতে তারা সায় না দিয়ে একটি দলের সাথেই সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে।’
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপি ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছে। ২০১৮ সালে দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দিল্লি সফর করে ক্ষমতাসীন বিজেপির বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা এবং দিল্লির বিভিন্ন থিংকট্যাংকের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন। ওই সফরে দিল্লির কাছে বিএনপির অনুরোধ ছিল- ‘নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে খোলাখুলি সমর্থন না করে ভারত অন্তত একটা নিরপেক্ষতা বজায় রাখুক।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতের ভূমিকায় এমন কিছুই দেখতে না পেয়ে চরম অখুশি হয় বিএনপি। এর ফলে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপির অভ্যন্তরে ভারতের সাথে ‘উপযাচকসুলভ’ সম্পর্কের বিদ্যমান ধারা পুনর্মূল্যায়নের চিন্তা শুরু হয় বলে জানা গেছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক তৈরি না করে ভারত একটি দলের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। যার কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে ‘ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট’ প্রবলভাবে কাজ করছে।
বিএনপি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী হত্যার বিরুদ্ধে আবারো সরব হতে দেখা যায়। সম্প্রতি ভারতের সাথে সম্পাদিত চারটি চুক্তিকে ‘দেশবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি।
দলটির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন নয়া দিগন্তকে সাম্প্রতিক চুক্তি প্রসঙ্গে বলেন, চারটি চুক্তিই একতরফা। কোনো দেশ তাদের নিজেদের প্রয়োজনে কিছু চাইতে পারে, কিন্তু তা অবশ্যই হতে হবে পারস্পরিক প্রাধান্যের ভিত্তিতে। কিন্তু সরকার সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি এবং ভারত তোষণের নীতি হিসেবে এসব চুক্তি করা হয়েছে। তাই ভোট ডাকাতির এই সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছেন। এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার আছে এসব চুক্তির প্রতিবাদ করার।