আবরারকে যে কারণে জীবন দিতে হলো
আবরারকে যে কারণে জীবন দিতে হলো - ছবি : সংগ্রহ
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাগরিকের একটি মানবাধিকার। স্বাধীনভাবে এই অধিকার চর্চার জন্য কাউকে হয়রানি, নির্যাতন ও হত্যা করা গণতান্ত্রিক বিশ্বে অগ্রহণযোগ্য। বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান বাংলাদেশে ভিন্নমতের সুযোগ সীমিত হতে হতে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। স্বাধীন মতপ্রকাশের কারণে গত এক দশকে বহু নাগরিক ক্ষমতাসীন মহলের আগ্রাসী মানসিকতায় হেনস্তা হয়েছেন, এমন কি খুনের নজিরও আছে। এর সর্বশেষ শিকার আবরার ফাহাদ। ৬ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি হলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্যাতন, হত্যা, হামলার ধারা দীর্ঘদিন চলে আসছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে এসে লাশ হয়ে বাড়ি ফেরা আর কত দিন চলবে? এসব লাশের তালিকা ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছে। মানবজীবনের কী নির্মম অপচয়!
আবরার হত্যা নিয়ে দেশ-বিদেশে সর্বত্র তীব্র নিন্দা ক্ষোভের ঝড় বইছে। নজিরবিহীন এ নৃশংস ঘটনা শুধু আবরারের বাবা-মা, স্বজন কিংবা প্রতিবেশীদের বেদনাবিধুর করেনি; দেশবাসী সবার মনকে নাড়া দিয়েছে; সৃষ্টি করেছে গভীর ক্ষতের। এর প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। একটি সতেজ তরুণ আগামী দিনের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছিলেন, তাকে কেন পিটিয়ে হত্যা করা হলো? প্রশ্নটি এখন সবার।
খুনের বিষয়ে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে- ‘যে ব্যক্তি কোনো মানুষ হত্যার বিনিময় ছাড়া অথবা দুনিয়ায় যে বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হয়নি, তাকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কোনো মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন পুরো মানবতাকে বাঁচাল’ (সূরা-৫,আয়াত : ৩২)। অথচ মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে খুন-জখমের প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। এ ভূখণ্ডে এখন স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, মায়ের উপস্থিতিতে সন্তানকে হত্যা করা হচ্ছে। রাজধানীতে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনেই পথচারী তরুণকে কুপিয়ে মারা হয়েছে। নির্যাতিতের স্বজনের হাহাকার ও বিলাপে ভেসে যাচ্ছে এই মানবজমিন। ঘৃণা, দ্বেষ ও হিংস্রতার সাথে নিত্য বসবাস করতে হচ্ছে দেশবাসীকে।
জনসমর্থন হারিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে যেকোনো সরকার প্রথমে মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করে থাকে। ক্ষমতায় থাকার নৈতিক বৈধতা হারিয়ে মসনদ টিকিয়ে রাখতে দমন-নিপীড়ন, গুম, হত্যা ইত্যাদি তখন তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এসব অপকর্মে শাসক দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যও জড়িয়ে পড়েন। সর্বত্র গোষ্ঠীস্বার্থ প্রবলভাবে জেঁকে বসে। দলীয় অন্ধ অনুকরণ সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হয়ে ওঠে আরাধনা। আমাদের দেশে এই প্রবণতা চরম মাত্রায় বিদ্যমান। বিশেষ করে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনের পর দেশ এ বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছে।
মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক জীব। আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন চিন্তার স্বাধীনতা। তাই মানুষের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া যায় না। আদম সন্তান ভালো-মন্দ বিচার করে নিজের জ্ঞানের আলোকে। জ্ঞানের ভিত্তি হলো তথ্য। এর অবাধ প্রবাহ বা আদান-প্রদান জ্ঞান বিকাশে ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপরিহার্য। মতপ্রকাশের ব্যাপারে কুরআনে বলা হয়েছে- ‘তুমি উপদেশ দাও, উপদেশদাতা ভিন্ন তুমি কিছু নও। তুমি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নও’ (সূরা-৮৮, আয়াত : ২১, ২২)।
আবরার ভারতের সাথে সম্পাদিত সাম্প্রতিক চুক্তি নিয়ে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলেন। কোনো সমাজে সবাই একমত হয় না। এটি মানবজীবনে অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রবণতা। ভিন্নমতকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্বাগত জানাবে। স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে রাষ্ট্র। যখন রাষ্ট্র এই মানবিকতা থেকে বেরিয়ে আসে, তখনই জনগণ এ ধরনের লেখালেখি বাড়িয়ে দেন। রাষ্ট্র কিছু পছন্দ করবে, কিছু করবে না। তাই বলে মেরে ফেলতে পারে না। আবরার রাষ্ট্রবিরোধী কিছু করলে আইনসম্মত বিচারে তার সাজা হতে পারত, তার মতামতকে বুয়েট ছাত্রলীগের পছন্দ হয়নি। আবরার যে ভূখণ্ডের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠছিলেন, তার বিবেচনায়, সেই প্রিয় স্বদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি যদি সরকার করেছে বলে মনে হয়, অবশ্যই সে বিষয়ে মতপ্রকাশ করার অধিকার তার এবং তার মতো অন্যসব নাগরিকের রয়েছে। তবে কর্তৃত্ববাদী সমাজে এটি সহজ নয়। জীবন দিয়ে তাই মূল্য পরিশোধ করলেন আবরার। আসলে কায়েমি স্বার্থের কাছে দেশপ্রেম মূল্যহীন; অপরাধ হিসেবে গণ্য।
আবরার হত্যাকাণ্ডকে যারা ‘অতি উৎসাহী’ কয়েকজনের কাজ বলে চালাতে তৎপর, তাদের অজানা থাকার কথা নয়, গত এক দশকে হেন অপকর্ম নেই যার সাথে সরকারের মদদপুষ্ট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত ছিলেন না। তাদের না করা অপকর্মের তালিকা করাই বরং সহজ। ‘২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের নিজেদের কোন্দলে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন। এ সময় ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্য সংগঠনের ১৫ জন’ (৮ অক্টোবর, ২০১৯, প্রথম আলো)।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘শিবিরকর্মী’ মনে করে নির্মমভাবে পেটানোর পরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা বহু। এ কাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সহযোগিতা করে এসেছে। অথচ দেশে ‘ছাত্রশিবির’ নিষিদ্ধ কোনো সংগঠন নয়। ‘শিবির’ ট্যাগ দিয়ে কাউকে হত্যার সনদ কে কাকে কিভাবে দিয়েছে? এ অধিকার প্রকারান্তরে রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীন দলই নিজেদের নেতাকর্মীর হাতে তুলে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার এ ধারা তৈরি করে উস্কে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলকেও। যেখানে দল, সরকার ও রাষ্ট্র একাকার হয়ে যায়, সেখানে এমনই হওয়ার কথা।
বছর ১১ ধরে শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো কাজে খুঁজে পাওয়া না গেলেও বারবার তাদের ন্যায্য আন্দোলনে হামলা চালিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের মতো জনস্বার্থ সম্পৃক্ত আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ এখন যা করছে, এটা কোনোভাবেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, স্রেফ সন্ত্রাস। ভালো কাজে ছাত্রলীগ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে, এমন নজির নিকট অতীতে খুঁজে পাওয়া যায় না। অপর দিকে, কোনো কিছুতেই থামছে না ছাত্রলীগ। চাঁদাবাজি আর নির্মাণকাজ থেকে কমিশন দাবিসহ বহু অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে সম্প্রতি সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বাদ দিতে হয়েছে। দেশের প্রায় সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একচেটিয়া প্রভাব রয়েছে। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ভাড়ায় খাটার অভিযোগ উঠছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছেও এ সংগঠনের কিছু নেতা এখন আতঙ্কের কারণ।
সবচেয়ে পীড়াদায়ক ব্যাপার, এমন সব জঘন্য অপরাধে অভিযুক্তদের বছরের পর বছর ধরে বিচার না হওয়ায় বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে সহিংসতায় নির্দোষ অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। অভিযুক্তদের ধরার জন্য কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিলে এবং স্বাধীন তদন্তকারীরা একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষ পথে যেতে পারলে এ ধরনের সহিংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যেতে পারত। কিন্তু ‘দলকানা’ প্রশাসনের কাছে ন্যায্য আচরণ পাওয়াটা এখন সোনার পাথর বাটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেন বাংলাদেশে এমন বর্বর ঘটনা ঘটছে? যে সমাজ ও রাষ্ট্রে মানবিক মূল্যবোধ লোপ পায়; সেখানে সাধারণ নাগরিকের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। সামষ্টিক জীবন হয় বিপর্যস্ত। এ থেকে উত্তরণের পথ কি খোলা নেই? আছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। সম্মিলিতভাবে গর্জে উঠতে হবে। নিজের ও পরিবারের ক্ষতি হতে পারে- এ ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নির্বাক বসে থাকলে চলবে না। এমন মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে অবশ্যই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। কাপুরুষদের সম্পর্কে আল কুরআনে বলা হয়েছে- ‘তুমি কি (তাদের পরিণতি) দেখনি যারা মৃত্যু ভয়ে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, অথচ তারা ছিল হাজারে হাজার। আল্লাহ তাদের বললেন, তোমরা মরো’ (সূরা-২, আয়াত-২৪৩)। মানবিক সমাজ নির্মাণে তাই সব অন্যায়ের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করার ব্যাপারে পিছু হটা এবং পিছপা হওয়ার অবকাশ নেই। ঐক্য, সৎ সাহস ও সঠিক পদক্ষেপই এমন অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায়।
camirhamza@yahoo.com