৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল ও আমার কাশ্মিরের স্মৃতি
কাশ্মির - ছবি : সংগ্রহ
কাশ্মিরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। হঠাৎ করেই আমার ভ্রমণ কর্মসূচিতে কাশ্মির যুক্ত হয়েছিল। আমার গন্তব্য ছিল ইসলামাবাদ। সময় ও পরিস্থিতি কোনোটাই পাকিস্তান ভ্রমণের অনুকূল ছিল না। ১৯৯০ সালের মে মাস। পাকিস্তানে প্রচণ্ড গরমের মওসুমের সূচনার সময়। প্রকৃতির তাপদাহকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল সিন্ধু প্রদেশে চলমান মুহাজির-সিন্ধী দাঙ্গা এবং প্রবল হয়ে ওঠা কাশ্মিরের সশস্ত্র স্বাধীনতা অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম। দাঙ্গায় করাচিতে প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষ নিহত হচ্ছিল।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত। তবুও আমাকে যেতে হলো। অব্যবহৃত একটা এয়ার টিকিট ছিল আমার। মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিল টিকিটের। বাড়তি অর্থ যোগ না করে পাকিস্তান বা ভারতে ঘুরে আসা যায়। সাত বছর আগে জার্মানি থেকে দেশে ফেরার সময় করাচি বিমানবন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত গিয়ে পরিচিত কয়েকজনকে ফোন করে কাউকে না পেয়ে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। সে কারণে পাকিস্তান ভ্রমণ করতে না পারার অতৃপ্তি ছিল। স্কুলের ক্লাস শুরুর আগে অ্যাসেম্বলিতে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ‘পাক সার জমিন’ গেয়ে পাকিস্তানের চাঁদতারা খচিত পতাকাকে স্যালুট করেছি। ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস, ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উদযাপন করেছি। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় শহর, জেলা, ঐতিহাসিক নিদর্শন, খ্যাতিমান ব্যক্তি, নদী ইত্যাদির নাম পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। মনে আছে, পাটিগণিতের অঙ্ক কষতে পাকিস্তানের নামী ক্রিকেট খেলোয়াড়দের রান সংখ্যা নিয়েও অঙ্কের ফল মিলাতে হয়েছে। ১৯৬৮ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত সামার অলিম্পিক পাকিস্তান হকিতে স্বর্ণপদক লাভ করায় স্কুলে ছুটি পেয়েছি। আমাদের বৃহত্তর পরিবারের দু’জন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন, ছুটিতে তারা বাড়িতে এলে তাদের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানের গল্প শুনেছি। ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তান এক দেশ ছিল। হাজার মাইল ব্যবধানে আমরা পাকিস্তানের অংশ পূর্ব পাকিস্তান ছিলাম। দেশ বিভক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আবির্ভূত হলেও পাকিস্তান ভ্রমণের ইচ্ছার মৃত্যু ঘটেনি।
বাংলাদেশ বিমানের করাচি স্টেশন ম্যানেজার আনোয়ারুল হক এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করলেন তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। করাচি শহরে চলমান দাঙ্গা পরিস্থিতি বর্ণনা করে আমাকে সতর্ক করলেন এবং বিমানের গাড়ি দিয়ে ড্রাইভারকে বলে দিলেন আমার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে। জনমানবশূন্য রাস্তা, প্যারামিলিটারি সৈন্যদের টহল এবং যানবাহনের স্বল্পতা পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিল। গুরু মন্দির রোডের এক রেস্টহাউজে পৌঁছে দিলো ড্রাইভার। রেস্টহাউজে আমাকে স্বাগত জানানো হলো। আমার কাছে করাচির কয়েকজনের টেলিফোন নম্বর ছিল- ১৯৮৩ সালে বার্লিনে আমার স্বজন হয়ে ওঠা আজফার আলী খান, বিসিসিআই কম্পিউটার ইনস্টিটিউটের লেকচারার। আমার করাচি আগমণে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে রাতেই দেখা করতে চলে এলেন। তার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন। ইসলামাবাদ থেকে ফিরে তার বাড়ি যাব স্থির হলো। পরদিন সকালে কাছেই জিন্নাহর মাজার, আরো কিছুদূর গিয়ে করাচির ব্যস্ততম এলাকা সদর ঘুরলাম। বিকেলে আজফার আলী খান এলেন আমাকে করাচির দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। তার সাথে ক্লিফটন বিচ, জিন্নাহর বাড়ি, বাণিজ্যিক এলাকা ঘুরিয়ে দেখালেন। ভিউ কার্ডে দেখা ছবির কোনো কোনো জায়গার উল্লেখ করলে তিনি সেসব জায়গায় নিয়ে গেলেন।
১৯৮৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসি ফরেন মিনিস্টার্স কনফারেন্স কভার করতে এসেছিলেন পাকিস্তানের জনপ্রিয় উর্দু দৈনিক জংয়ের চিফ রিপোর্টার আরিফুল ইসলাম ও জংয়ের সাপ্তাহিক প্রকাশনা আখবার-এ-জাঁহার সম্পাদক ও করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রফেসর নিসার জুবেরী। ঢাকায় তাদের থাকার ব্যবস্থা ও দেখভাল করা এবং একদিন বাসায় নিয়ে আপ্যায়ন করার কারণে তাদের সাথে আমার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নিসার জুবেরীকে পাওয়া গেল না। আরিফুল ইসলাম দৈনিক জং অফিসে আমন্ত্রণ জানালেন। পরদিনই করাচি ছাড়ব জানার পর তিনি আমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকের নাম, ফোন নম্বর দিয়ে বললেন ইসলামাদে গিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। রেস্টহাউজে এক পাঞ্জাবি ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় হলো। আমিরুল আজিম। তিনি আমাকে বললেন, ইসলামাবাদের আগে লাহোর হয়ে যেতে। উর্দুতে একটি ঠিকানা লিখে দিয়ে বললেন লাহোর স্টেশনে নেমে কোনো ট্যাক্সি বা স্কুটার ড্রাইভারকে ঠিকানাটি দিলেই জায়গামতো পৌঁছে দেবে। সেখানে তিনি থাকবেন। তিনদিন করাচিতে কাটিয়ে লাহোরগামী ট্রেনে উঠলাম। লাহোরে ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে গেলাম। সেটিও একটি রেস্টহাউজ। আমিরুল আজিম অভ্যর্থনা জানালেন। আমাকে বললেন, আজাদ কাশ্মিরের রাজধানী মুজাফফরাবাদ যেতে। সাংবাদিক হিসেবে কাশ্মির পরিস্থিতি দেখার জন্য আমার যাওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বললেন, তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন।
পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র আবদুল্লাহ ফারুক ভাট্টিকে ডেকে গাড়ির চাবি দিয়ে বললেন, আমাকে লাহোর নগরী ঘুরিয়ে সন্ধ্যায় সেজান রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে। ভাট্টি আমাকে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ঘুরিয়ে দেখাল। মনোরম সবুজে ভরা ক্যাম্পাস। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল। রাভি নদীর পানি দূরে কৃষিজমিতে চলে যাচ্ছে। রাভি নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করে ভারত। দিনে ছয় ঘণ্টা করে দু’বার পানি পায় পাকিস্তান, দু’বার পানি পায় ভারত। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৯৬০ সালে যে পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, উভয় দেশ তা পালন করে চলেছে। ভাট্টির কাছেই জানতে পারলাম পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে বেশ কিছু বাংলাদেশী ছাত্র আছে, ইচ্ছা করলে আমি তাদের সাথে দেখা করতে পারি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমার বন্ধু তারিক পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করত। সে এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, একপর্যায়ে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিল। সে পাকিস্তান ছেড়েছে বহু বছর আগে। ১৯৮৯ সালের এপ্রিলে নিউ ইয়র্কে তার সাথে আমার শেষ সাক্ষাত হয়েছে। বাংলাদেশী ছাত্রদের সাথে দেখা করার আগে ভাট্টি আমাকে শাহী কিল্লা, শাহী মসজিদ, কবি ইকবালের মাজার, লাহোর প্রস্তাবের স্মৃতিবিজড়িত মাঠে মিনার-ই-পাকিস্তান, বিশাল বুকস্টোর ফিরোজ অ্যান্ড সন্সসহ আরো কিছু ঐতিহাসিক জায়গা ঘুরিয়ে আবার পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এসে একটি ছাত্রাবাসে নিয়ে গেল।
বাংলাদেশী দু’জন ছাত্র। আতিক ও আলো। দুই ভাই। (দু’জনই এখন যুক্তরাষ্ট্রে)। একজন ফার্মেসির ছাত্র, আরেকজন ইকোনমিকসের এবং ওরা আমার বন্ধু তারিকের ছোটভাই। আমার পাশের উপজেলার। ওরা আরেক দফা আমাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে গেল। আরো ছাত্রের সাথে কথা হলো। সন্ধ্যায় ভাট্টি এসে আমাকে নিয়ে গেল সেজান রেস্টুুরেন্টে। আমিরুল আজিম আমার সম্মানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন এবং তার ঘনিষ্ঠ নবীন-প্রবীণ জনাবিশেক সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি রীতিমতো বিব্রত। সাংবাদিকদের মধ্যে দু’জন আশির দশকে পেশাগত কাজে ঢাকায় গেছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে সবার অনেক কৌতূহল। অনুষ্ঠানে আমাকে বক্তব্য দিতে হলো, কিছু প্রশ্নের উত্তরও দিতে হলো। তখন আমি ভালোই উর্দু বলতে পারতাম (এখন কোনোমতে বলতে পারি)। ইংরেজিতে না বলে উর্দুতেই কথা বললাম। আমার উর্দু জানা তাদের কাছে বিস্ময়ের মতো। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে উর্দু নিয়েই পূর্ব পাকিস্তানের সাথে প্রথম রক্তাক্ত সঙ্ঘাতের সূচনা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানিরা উর্দুকে ঘৃণা করে, তাদের ধারণায় এটাই বদ্ধমূল ছিল। আমি বললাম, ভাষার সাথে বিরোধ ছিল না, চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতাই বিরোধের কারণ। আমার বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের প্রায় সবাই প্রশ্ন করলেন। ভাষার প্রশ্নে তাদের বক্তব্য হলো, আমরা পাঞ্জাবি, উর্দু আমাদের কারো ভাষা নয়। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে আমরা উর্দুকে গ্রহণ করেছি। আমি বলি, ভাষার রাজনৈতিক দিক নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি উর্দু কবিতা-গান আমাকে মুগ্ধ করে এবং সেই মুগ্ধতা থেকেই সামান্য উর্দু চর্চা করতে চেষ্টা করেছি। পরদিন আমার আপ্যায়নকারী আমার হাতে লাহোর-রাওয়ালপিণ্ডির বিমান টিকিট ধরিয়ে জোর করে পকেটে বেশ কিছু রুপি গুঁজে দিলেন। রাওয়ালপিণ্ডির কয়েকজনের নাম ও টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললেন, যে কাউকে ফোন করলেই তারা আমাকে মুজাফফরাবাদ পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।
রাওয়ালপিণ্ডির চাকলালা বিমানবন্দরের নাম কত শুনেছি। সেই বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। ওআইসি পরিচালিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী ছাত্র ফজলু বিমানবন্দরে আমাকে রিসিভ করে ১০ মাইল দূরে ইসলামাবাদে তার ক্যাম্পাসে নিয়ে গেল। দু’দিন ইসলামাবাদে কাটিয়ে আমাকে দেয়া একটি নম্বরে ফোন করলে রাতে এক যুবক এসে মোটরসাইকেলে তুলে আমাকে রাওয়ালপিণ্ডিতে এক বহুতল ভবনের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দিলো। একটি কাশ্মিরি সশস্ত্র গ্রুপের রাজনৈতিক সদর দফতর।
নেতাদের সাথে পরিচয় হলো। শীর্ষ নেতা প্রফেসর আশরাফ শরফ। শ্রীনগরের এক সরকারি কলেজের শিক্ষক। ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের পক্ষে রাজনৈতিক পর্যায়ে কাজ করছেন। রাতে আরো বেশ ক’জন নেতার সাথে খেতে বসে তারা কাশ্মির পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন। আমাকে অনেক জেরা করলেন, আমি যে যথার্থই একজন সাংবাদিক এবং সন্দেহভাজন কেউ নই তা নিশ্চিত হতে চাইছিলেন তারা। তাদের সাথেই রাত কাটালাম। সকালে নাশতা সেরে প্রফেসর আশরাফ শরফের সাক্ষাতকার নিলাম। ১০টার দিকে একজন আমাকে চাকলালা বিমানবন্দরে নিয়ে মুজাফফরাবাদের টিকিট হাতে দিলো। ১৪ আসনের ছোট বিমান। আধা ঘণ্টা পর মুজাফফরাবাদে পৌঁছলাম। ছোট্ট বিমানবন্দরের অল্প দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খর¯্রােতা এক নদী। সেখানে একটি গাড়ি নিয়ে আমার অপেক্ষায় ছিল তিনজন। প্রথমে তারা আমাকে একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। সেখানে আরো কয়েকজন কাশ্মিরি যুবক। তারা পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র। তাদের মধ্যে একজন তার বন্ধুর বিয়েতে রাজশাহী গিয়েছিল। বাংলাদেশের আতিথেয়তায় সে মুগ্ধ। এরপর তারা পাহাড়ি পথে চারদিকে উঁচু পর্বতশ্রেণীর মাঝে খোলা প্রান্তরে বড় ধরনের একটি তাঁবুতে নিয়ে গেল আমাকে। তাঁবুতে শ’খানেক যুবক।
তাদের কাছে আমার পরিচয় দেয়া হলো। এসব যুবক ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির থেকে আজাদ কাশ্মিরে এসেছে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ নিতে এবং প্রশিক্ষণ শেষে কাশ্মিরে গিয়ে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। ইতোমধ্যে বেশ ক’টি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এমন ক’জন যুবকও ছিল সেখানে। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তুলতেই তারা ঘাড়ে ঝুলানো স্কার্ফে মুখ ঢাকল। তারা যা বলার জন্য নির্দেশিত এর বাইরে কোনো কিছু নিয়ে মুখ খুলল না। আমি যেহেতু দীর্ঘ সময়ের জন্য আসিনি, সে জন্য আমি খুব পীড়াপীড়ি করলাম না, বা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানার চেষ্টা করলাম। আমাকে বলল তাদের সাথে যুদ্ধে গিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে। এবার তাদের অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে দুঃখ প্রকাশ করলাম। তাঁবুতে বিশাল ডেকচি ভর্তি চা। আমাকে চায়ে আপ্যায়ন করল। মশলা ও লবণ মিশ্রিত চা, ওরা বলে ‘কাওয়া’। প্রচণ্ড গরমে পানিশূন্যতা কাটাতে ওরা দিনভর এই চা পান করে। সেখান থেকে আরেকটি ক্যাম্পে গেলাম। অসংখ্য কাশ্মিরি যুবক। তারাও ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদে জয়ী হওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করলো। এরপর মুজাফফরাবাদে কাশ্মিরি নেতাদের মূল অপারেশনাল হেডকোয়ার্টারে গিয়ে নেতৃস্থানীয় কাশ্মিরিদের সাথে সাক্ষাত হলো। তারা জিহাদে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করলেন। সন্ধ্যায় আমি একটি বাসে উঠে বেশ রাতে ইসলামাবাদে ফিরে এলাম।
আমার পাকিস্তান অবস্থানকালেই ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে দুটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটে। একটি হলো কাশ্মিরের প্রভাবশালী ও শ্রদ্ধেয় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা মিরওয়াইজ এবং অল পার্টি হুররিয়াত কমিটির চেয়ারম্যান মৌলভি ফারুককে শ্রীনগরে তার প্রতিপক্ষ সশস্ত্র গ্রুপ কর্তৃক গুলি করে হত্যা। তার শবযাত্রায় অংশগ্রহকারীরা তাদের ধর্র্মীয় নেতার হত্যাকাণ্ডে উত্তেজিত ও বিশৃঙ্খল হয়ে উঠলে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করলে চার মহিলাসহ ৭২ জন লোক নিহত হয়। মিরওয়াইজ বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের একটি প্রতিষ্ঠান এবং নিহত মৌলভি ফারুক ছিলেন ত্রয়োদশ মিরওয়াইজ। তাঁর ১৭ বছর বয়স্ক ছেলে ওমর ফারুক চতুর্দশ মিরওয়াইজ হিসেবে দায়িত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অপর ঘটনাটি ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইংয়ের (র) সাবেক পরিচালক গিরিশ চন্দ্র সাকসেনাকে জম্মু ও কাশ্মিরের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দান। আমি রাওয়ালপিণ্ডিতে বিদ্রোহী নেতাদের সাথে অবস্থানের সময়ই সাকসেনার নিয়োগে তাদের মধ্যে অস্বস্তির ভাব লক্ষ্য করেছি। (হিসেবে সাকসেনা তার প্রথম মেয়াদে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মিরের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন)।
মুজাফফরাবাদ থেকে ফিরে পরদিন সকালে কিং ফয়সাল মসজিদে গেলাম। মারগালা হিলসের পাদদেশে মসজিদের মূল এবং চারপাশের উদ্যান মিলে ৩৩ একর জায়গার ওপর বেদুইনদের তাবু সদৃশ বিশাল মসজিদ। মসজিদের পাশেই মরহুম প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের মাজার। ইসলামাবাদের প্রধান ল্যান্ডমার্ক। মসজিদের মূল ইবাদত কক্ষ, আশপাশের চত্বর মিলে দুই লাখ মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক মসজিদ পরিদর্শন ও জিয়ার মাজার জিয়ারত করতে আসে। ওই সময় ওআইসি পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস ছিল মসজিদ কমপ্লেক্স্রে। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আমার সিনিয়র বন্ধু কামরান ভাই। একসময় একই স্কুল এবং একই কলেজে পড়াশোনা করেছি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি আমেরিকান নাগরিক। তার সাথে সাক্ষাত করতেই ক্যাম্পাসে গেছি। ক্লাস শেষ করে তিনি বের হলেন। তার সাথে বের হলেন ইউনিফর্ম পরিহিত জনা ত্রিশেক সেনা অফিসার।
মেজর থেকে কর্নেল পর্যন্ত। পরিচিত হলেন। দু’জনকে পাওয়া গেল, যারা ঢাকার মীরপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত আর্মি স্টাফ কলেজে অ্যাটেন্ড করেছেন। তারা অন্য ক্লাসে চলে যাওয়ার পর কামরান ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, এরাই কী আপনার ছাত্র? উনি বললেন পাকিস্তানের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক বাহিনীর অফিসাররা ছাত্র হিসেবে আসে এবং তারা ক্লাস খুব এনজয় করে। ফলাফলও ভালো করে। দিনের অবশিষ্টাংশ কাটালাম কিছু শপিং এরিয়ায় এবং বিকেলে গেলাম মারগালা হিলসের সবচেয়ে উঁচু জায়গা ‘দামন-এ-কোহ’ (পাহাড়ের আঁচল) এ। সেখান থেকে পুরো ইসলামাবাদ শহর এবং অনতিদূরে রাওয়াল লেকের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়।
পরদিন সকালে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে করাচিগামী ট্রেনে উঠে ২৭ ঘণ্টায় প্রায় এক হাজার মাইল অতিক্রম করে করাচি পৌঁছলাম। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে রেস্টহাউজের কাছেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মাজার জিয়ারত করে ফেরার পর আজফার আলী খান আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বার্লিনে তার একটি মাত্র মেয়ে ছিল, আসমা। সাত বছরের ব্যবধানে তার সংসারে আরো তিনটি ছেলে যোগ হয়েছে। আমাকে আপ্যায়ন করার জন্য তাঁর স্ত্রী অনেক খাবার রান্না করেছেন। আরো ক’জন বন্ধুকে আমন্ত্রণ করেছেন। বার্লিনেও আমাকে অনেক খাওয়াতেন। আমি যেহেতু একা থাকতাম, সে জন্য প্রায়ই দাওয়াত করতেন। ফেরার সময় কয়েক বেলার খাবার দিয়ে দিতেন, যাতে আমাকে রান্না করতে না হয়। খেতে খেতে অনেক আলাপ হলো। বার্লিনের স্মৃতি রোমন্থন করলাম।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আজফার খান হতাশ, ব্যথিত। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশে আর থাকবেন না। কানাডায় চলে যাবেন। (এখন তিনি কানাডায় বসবাস করেন)। আমাকে রেস্টহাউজে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। পরদিন ১ জুন আমার ফিরতি ফ্লাইট। সকালে বিমানের করাচি স্টেশন ম্যানেজারকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, আপনি তো ফ্লাইট মিস করেছেন। কাল রাত ১টায় ফ্লাইট ছিল। আপনাকে খুঁজে পাইনি। আমার হুশ হলো, তাইতো। ১ জুন রাত একটা মানে ৩১ মে রাত ১২টার পর। এমন ভুল আগে কখনো হয়নি। সেদিন বিমানের ফ্লাইট ছিল না। পরবর্তী ফ্লাইট ৩ জুন। আনোয়ার সাহেব আমাকে বিমানের অফিস হোটেল মেহরানে যেতে বললেন। আমি গিয়ে টিকিট বদলে আনলাম। পরিচিত কেউ না থাকলে আমাকে নতুন করে টিকিট কিনতে হতো। অতিরিক্ত সময়ে করাচি শহরের আরো কিছু জায়গা একা ঘুরে কাটিয়ে দিলাম।
পাকিস্তানে আমার অবশিষ্ট দিনগুলোতে আমি কাশ্মির পরিস্থিতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্দেশ্য এক ছিল না। দল-উপদলে বিভক্ত কাশ্মিরিরা অভিন্ন লক্ষ্য স্থির করতে ব্যর্থ হয়েছে। সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল কাশ্মিরের একসময়ে সবচয়ে জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল কনফারেন্স, দ্বিতীয় বৃহত্তম দল কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি) কাশ্মিরকে ভারতভুক্ত রাখার পক্ষে এবং পিডিপি ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপির সাথে মিত্রতায় জড়িত। ন্যাশনাল কংগ্রেস বরাবর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের মিত্র ছিল। (চলতি বছর অনুষ্ঠিত সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে এই মৈত্রী জোট লোকসভার ছয়টি আসনের মধ্যে তিনটিতে জয়ী হয়েছে)। ১৯৪৭ সালে মহারাজা হরি কাশ্মিরের ভারতভুক্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে শেখ আবদুল্লাহ তা সমর্থন করেন। কারণ, তিনি ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে যোগ দিতে চাননি। কাশ্মিরে সরকার গঠনকারী দুটি বড় দলই যদি ভারতভুক্ত থাকতে চায়, সে ক্ষেত্রে কাশ্মিরের স্বাধীনতা অর্জন বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার যুদ্ধ কতটা সফল হবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
ছোটখাটো বিদ্রোহী দলগুলোর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিল তাদের মধ্যেও ছিল নানামুখী স্বার্থ হাসিলের প্রতিযোগিতা। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে বিশ্বাস করত না, বরং সুযোগ পেলে পরস্পরের ওপর অস্ত্র প্রয়োগ করত। এসব গ্রুপের একটি লড়াই করছিল কাশ্মিরের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য। আরেকটি গ্রুপ চাইছিল কাশ্মিরকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করতে। ভারতের একটি রাজ্য হিসেবে ভারতভুক্ত হওয়ার পক্ষে কাশ্মিরের পণ্ডিতরা ছাড়াও অনেক কাশ্মিরি ছিল তা আগেই উল্লেখ করেছি। অনেক কাশ্মিরি ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহে নিয়োজিত ছিল। এ ধরনের বিপরীতমুখী ও পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত সশস্ত্র গ্রুপের সংঘর্ষে বহু লোক নিহত হয়েছিল। বহুধা-বিভক্ত কাশ্মিরিদের অনৈক্য ও চিন্তাধারার বৈপরীত্যকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী কয়েক বছরের ব্যবধানেই কাশ্মিরিদের মধ্য থেকে প্রতি-বিপ্লবী গ্রুপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোকে অকার্যকর করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এমন একটি পরিস্থিতির অপেক্ষায় ছিল। অন্যান্য দলের সরকার ক্ষমতায় এসে কাশ্মির প্রশ্নকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ভাবলেও উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি- বিজেপির কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের ব্যাপারে আপসহীন ছিল এবং এবার তারা বিশেষ মর্যাদার গ্যারান্টি দানকারী সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং ৩৫ ধারা বিলোপ করে জম্মু ও কাশ্মিরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেছে।