কাশ্মির প্রশ্নে যে কারণে আরব দেশগুলো নীরব

কাশ্মিরর প্রশ্নে যে কারণে আরব দেশগুলো নীরব - ছবি : সংগৃহীত
গত ৫ আগস্টের ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিলের মাধ্যমে অধিকৃত কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা ও সীমিত স্বায়ত্তশাসন বাতিল করেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ এলাকা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই অঞ্চলটিকে ভারতীয় ভূখণ্ডে পরিণত করেছে নয়াদিল্লি। স্বভাবতই পাকিস্তান এতে ক্ষুব্ধ। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দাবিদার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া তেমন উৎসাহব্যঞ্জক নয়। উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর বেশির ভাগই নীরব রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব সংযমের আহ্বান জানিয়েছে এবং ঘনীভূত সঙ্কটের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অন্যান্য উপসাগরীয় দেশ কুয়েত, কাতার, বাহরাইন এবং ওমান কাশ্মির ইস্যুতে কোনো বিবৃতি দেয়নি।
ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ অধিকারের মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, এটি একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে দেশটি জানিয়েছে, রাজ্যের পুনর্গঠন স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, এটা মূলত করা হচ্ছে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করে উন্নতির লক্ষ্যে। এর মাধ্যমে ভারতের পক্ষ নিয়ে একধাপ এগিয়ে গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
বলা হচ্ছে, আরব বিশ্বের এই নীরবতার পেছনের কারণ ভারতের সাথে বার্ষিক ১০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি বাণিজ্য, যা ভারতকে আরব উপদ্বীপের অন্যতম মূল্যবান অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে পরিণত করেছে। এমনকি ভারতের এই পদক্ষেপের পরই আরব বিশ্বের নীরবতার কারণ হিসেবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি ভারতের সাথে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথাই উল্লেখ করেছিলেন।
পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য পুরোপুরি অবাস্তব নয়। কেননা উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে ৭০ লাখেরও বেশি ভারতীয় প্রবাসী রয়েছে যারা এই অঞ্চলের অর্থনীতি পরিচালনায় সহায়তা করে এবং শহরগুলো চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, চালক, নির্মাণশ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমিকে পরিপূর্ণ।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের তুলনায় এই অঞ্চলে কোথাও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশি স্পষ্ট হয় না, যেখানে আমিরাতের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন ভারতীয়। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০১৮ সালে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, যা ভারতকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভারতীয় বিনিয়োগের পরিমাণ ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেটের বাজারে ভারতীয়রা হলো বৃহত্তম বিদেশী বিনিয়োগকারী। এদিকে ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে দুবাইয়ের বৈশ্বিক বন্দর অপারেটর ডিপি ওয়ার্ল্ডের একটি লজিস্টিক নৌকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
কিন্তু এটাই পুরো বাস্তবতা নয়। কাশ্মির ইস্যুতে যেসব দেশ, বিশেষ করে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন করে আসছেÑ মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও ইরান। ভারতের সাথে এই তিন দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো বেশি। পাকিস্তানের সাথে এই তিন দেশের বাণিজ্যের পরিমাণের চেয়ে ভারতের সাথে তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ গুণের বেশি। তবুও তারা কেন পাকিস্তানকে সমর্থন করছে?
বস্তুত কাশ্মির ইস্যুতে উপসাগরীয় দেশগুলোর নীরবতার পেছনে রয়েছে অন্যান্য কারণ। প্রথমেই আসে কাশ্মির সমস্যা সমাধানে পাকিস্তানের অবস্থান। পাকিস্তান সব সময় বলে আসছে কাশ্মিরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে কাশ্মিরের জনগণ। এ জন্য জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব অনুযায়ী সেখানে একটি গণভোটের আয়োজন করতে হবে। ভারতের পক্ষে এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন ঝুঁকিপূর্ণ। ভারত জানে, গণভোট হলে কাশ্মিরের জনগণ একচেটিয়া রায় দেবে স্বাধীনতার পক্ষে, যেটা সমর্থন করে পাকিস্তান। আর গণভোটের সমর্থন করা উপসাগরীয় দেশগুলোর পক্ষে অসম্ভব। কেননা, তারা ভোট বা গণতন্ত্রের সমর্থন করলে তাদের নিজেদেরই অস্তিত্ব ঝুঁকিতে পড়বে। তারা রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। এ জন্যই তো ২০১১ সালে তিউনিসিয়া থেকে শুরু হওয়া আরব বসন্তের প্রবাহ যখন আরব বিশ্বে প্রবেশ করেছিল, তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন এসব আমির ও বাদশাহ। তিউনিসিয়ায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয় আন নাহদা দল। কিন্তু এই ইসলামপন্থী দলটিকে ব্যর্থ করার জন্য বিরোধী পক্ষগুলোকে বিপুল অর্থ সহায়তা দিয়েছিল আরব আমিরাত। গাদ্দাফির পতনের পর দেশটিতে গণতান্ত্রিক উপায়ে পরবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তা হতে দেয়া হয়নি এ জন্য যে, এতে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোই জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকারে আসার সম্ভানা জোরালো ছিল। লিবিয়াতে বর্তমানে যে অশান্তি বিরাজ করছে, তার পেছনেও যে উপসাগরীয় দেশগুলোর ইন্ধন আছে, তাও কারো অজানা নয়। মিসরের উদাহরণ তো আরো স্পষ্ট। দেশটির ইতিহাসে প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হন মুমলিম ব্রাদারহুড সমর্থিত মুহাম্মদ মুরসি। মাত্র এক বছরের মাথায় সেনা অভ্যুত্থান। তাতে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। মিসরে ক্ষমতা দল করে রেখেছেন জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি। তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আর্থিকসহ সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশ।
এদিকে সৌদি-আমিরাতকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তুলেছে নতুন কৌশলগত জোট। এই জোটকে টিকিয়ে রাখতে সৌদি-আমিরাতের সব কর্মকাণ্ডে সমর্থন জোগাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যা, ইয়েমেনে সামরিক অভিযান ইত্যাদি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের জোর সমালোচনার মুখে সৌদির পক্ষে পাহাড় হয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। আর সে কারণে ইরানের সাথে বিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে রয়েছে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত। আবার চীনকে সামাল দিতে ভারতের সাথে কৌশলগত সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য পাকিস্তানের মাওলানা মাসউদ আজহারকে জাতিসঙ্ঘের সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করার ভারতীয় চেষ্টায় সমর্থন দেয় ওয়াশিংটন। তেমনি দুই দেশের মধ্যে ১৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য আরো সম্প্রসারণের উপায় নিয়ে আলোচনা চলছে মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠকে। জ্বালানি, প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতার উপায় বের করার চেষ্টা চলছে। যে দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এমন সম্পর্ক, সেই ভারতের বিপক্ষে জোরাল ভূমিকা বা অবস্থান নেয়া কিভাবে সম্ভব যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরব, আমিরাত ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের? হ