মুসলিমদের সমর্থন নিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হবেন সাজিথ প্রেমাদাসা!

অন্য দিগন্ত ডেস্ক | Oct 11, 2019 07:18 pm
সাজিথ প্রেমাদাসা

সাজিথ প্রেমাদাসা - ছবি : সংগৃহীত

 

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণ পুরোপুরি শুরু হয়েছৈ। ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) উপনেতা সাজিথ প্রেমাদাসা স্বাধীনতা, শান্তি, সাম্য, ও সমতা জোরদারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর শ্রীলঙ্কা পদুজনা পেরামুনার (এসএলপিপি) প্রার্থী গোটাবায়া রাজাপাকসা প্রায় ৩০০ জনকে হত্যাকারী আইএসআইএস-ধরনের ইস্টার সানডে বোমা হামলার ফলে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে উদ্ধার করে দেশকে নিরাপদ করার ওয়াদা করছেন।

সাজিথ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইউএনপির নেতৃত্বে মুসলিম ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত তামিল দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত নিউ ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (এনডিএফ) ব্যানারে। তিনি শ্রীলঙ্কার মুসলিম ও তামিলদের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন। আর গোটাবায়া বারাজাপাকসা সিংহলি সংখ্যাগরিষ্ঠ ও ইস্টার সানডে হামলার শিকার খ্রিস্টানদের সমর্থন পাচ্ছেন।

প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা সিরিসেনার নেতৃত্বাধীন এসএলএফপি বৃহস্পতিবার এসএলপিপির সাথে একটি সমঝোতায় উপনীত হয় দলটির প্রার্থী গোটাবায়াকে সমর্থন দিতে।
এসএলএফপির সমর্থনের ফলে গোটাবায়ার অবস্থান জোরদার হলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সিংহলি এবং সেইসাথে তামিল ও মুসলিমদের সমর্থনপুষ্ট সাজিথই ১৬ নভেম্বরের নির্বাচনে বিপুলভাবে জয় ছিনিয়ে নেবেন।
সাজিথকে যারা সমর্থন দিচ্ছেন তাদের খুব বেশি প্রয়োজন রাজাপাকসা পরিবারের স্বৈরাতান্ত্রিক শাসন থেকে একটি বিকল্প। এমনিতেই এসএলএফপি পরিণত হয়েছে রাজাপাকসা দলে। এখন গোটাবায়া যদি নির্বাচিত হন, তবে এবার পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে। উল্লেখ্য, সাবেক প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপাকসা এসএলএফপি ত্যাগ করার পর তিনি নতুন দল গঠন করেন।
এসএলপিপির মধ্যে রয়েছেন দলীয় প্রধান মহিন্দা রাজাপাকসা, গোটাবায়া রাজাপাকসা, বাসিল রাজাপাকসা, দলের সংগঠক ও কৌশলবিদ চমল রাজাপাকসা এবং মহিন্দা রাজাপাকসার তিন ছেলে। এই ছেলেদের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান নমল রাজাপাকসা। গত বছর ভারত সফরের সময় মহিন্দা রাজাপাকসা এই নির্বাচনে তার ছেলে নমলকেই প্রার্থী করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন।

গোটাবায়া যদি নাগরিকত্ব প্রশ্নে দুই নাগরিক সমাজের অ্যাক্টিভিস্টের দায়ের করা মামলায় হেরে যান, তবে তার বদলি হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন চমল রাজাপাকসা। তবে আপিল আদাল গোটাবায়াকে নির্বাচন করার ছাড়পত্র দিয়েছে। এরপর চমল তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
গোটাবায়ার জয় হবে সাবেক প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপাকসারই জয়। ২০২০ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠেয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে এসএলপিপি জয়ী হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন।
মজার ব্যাপার হলো, চলতি বছরে নেয়া এসএলপিপির একটি গ্রুপ ফটোতে রাজপাকসাদের সব ভাইকে বসে থাকতে এবং দলের অন্যান্য সদস্যদেরকে তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। এক সাংবাদিক সামাজিক মিডিয়ায় জানতে চেয়েছেন, কেন ‘অন্তত ছবি তোলার জন্য হলেও’ একজন অ-রাজাপাকসাকে তাদের পাশে বসানো হলো না?

সাজিথকে সমর্থনকারী বুদ্ধিজীবীরা রাজাপাকসা পরিবারে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব থেকে মুক্তি পেতে চান। উল্লেখ্য, রাজাপাকসাদের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ হলো, তাদের সরকারের আমলে তাদের সাথে একমত না হওয়া লোকদের হত্যা ও গুম করে দেয়া হতো। আর তা হলো ওই সময়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোটাবায়ার তদারকিতে।
সাজিথকে সমর্থনকারী সিনিয়র সমাজবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী ড. মাহিম মেন্ডিস সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, এই দেশের জনগণ আরেক দফা হত্যা ও গুম হতে দেবে না। সাজিথকে প্রেসিডেন্ট করার ক্ষেত্রে ড. মেন্ডিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ড. মেন্ডিস বলেন, সাজিথের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। তিনি আশা করেন, সাজিথ প্রেসিডেন্ট হলে তিনি তার বাবা রানাসিঙ্গে প্রেমাদাসার ( ১৯৮৯-১৯৯৩ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন) মতো মেধাবীদের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন, দারিদ্র দূরিকরণের কর্মসূচি হাতে নেবেন। সাজিথের সমর্থকেরা আত্মবিশ্বাসী যে প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা তার আছে।

ড. মেন্ডিস বলেন, সজিথ ২০ বছর ধরে পার্লামেন্ট সদস্য। গৃহায়ন মন্ত্রী হিসেবে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। আর গোটাবায়া কখনো পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন একটি স্বৈরতন্ত্রের অংশবিশেষ।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে মৈত্রিপালা সিরিসেনা ছিলেন ইউএনপির যৌথ প্রার্থী। তিনি সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপুলভাবে সাড়া জাগিয়েছিলেন। কিন্তু সিরিসেনা এখন ইতিহাস মাত্র। তিনি কেবল মহিন্দা রাজাপাকসা ও তার ভাইদের রাজনৈতিক সম্ভাবনা বাড়ানোর কাজ করছেন। ২০১৫ সালে তিনি মহিন্দা রাজাপাকসাকে হারিয়েছিলেন।
দুই প্রেসিডেন্ট প্রাথীর মধ্যে তাদের অবস্থানগত প্রার্থক্যের পাশাপাশি ভোট ব্যাংকের মধ্যেই ভিন্নতা দেখা গেছে।
সাজিথ নাগরিক সমাজের সদস্যদের বলেছেন, বর্তমান সরকার যে স্বাধীনতা দিয়েছে, তিনি তা আরো মজবুত করবেন। গোটাবায়া ২০০৯ সালে এলটিটিইর সন্ত্রাস নির্মূলের কথা বলছেন। তিনি বলছেন, তিনি জয়ী হলে জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করবেন। তার এই প্রতিশ্রুতির ফলে অনেকে আশঙ্কা করছেন যে তিনি তার ভাইয়ের আমলের মতো আবার ভীতিকর শাসন কায়েম করবেন।

সাজিথ জোর দিয়ে বলছেন যে তিনি শ্রীলঙ্কার তামিল ও মুসলিমদের ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে বিবেচনা করতে চান না, তিনি সব শ্রীলঙ্কান নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে চান।
অন্যদিকে এসএলপিপি প্রার্থী সিংহলি সংখ্যাগুরুদের অবস্থান আরো জোরদার করতে চান। তারাই দেশটির ৭০ ভাগ লোক। আর তামিল ও মুসলিমরা হচ্ছে ২২ ভাগ।
তবে সিংহলিদের মধ্যে উভয় প্রার্থীরই সমর্থন রয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ মনে করছেন, সিংহলি বৌদ্ধদের মধ্যে গোটাবায়ার সমর্থন আছে একটু বেশিই।

অবশ্য শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তামিল, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের ভোট বড় ধরনের পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। ২০১০ সাল পর্যন্ত তামিল ভোটই পার্থক্য সৃষ্টি করত। কিন্তু ২০১০ সালের নির্বাচনে মহিন্দা রাজাপাকসা সহজেই জয়ী হয়েছিলেন। এর কারণ ছিল এলটিটিইকে হারানোর কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা (এবং মুসলিমরাও) তাকে বিপুলভাবে ভোট দিয়েছিল।

কিন্তু যুদ্ধ জয়ের আবেদন সময়ের পরিক্রমায় শেষ হয়ে গেছে। তবে ২১ এপ্রিলের হামলাটি নতুন করে ভয়ের সৃষ্টি করেছে। ওই হামলার রেশ ধরেই খ্রিস্টানদের সমর্থন পাচ্ছেন গোটাবায়া। শ্রীলঙ্কায় খ্রিস্টান সংখ্যা ৮ ভাগ। তারা সাধারণত ইউএনপিকে ভোট দিত। কিন্তু ইস্টার সানডের হামলার পর তারা এসএলপিপির দিকে ঝুঁকেছে।
তবে ইউএনপির গত ৫ বছরের আমলে অর্থনীতির খারাপ অবস্থা সাজিথের জন্য কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি করেছে। রাজাপাকসার পর নতুন কোনো বড় অর্থনৈতিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়নি। ইউএনপি সরকার সরকারি কর্মীদের বেতন দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। অবশ্য এর জন্য দায়ী করা হয় রাজাপাকসার আমলকে। ওই সময় বিপুল ঋণ গ্রহণ করার ফলে সুদ পরিশোধ করতেই বিপুল ব্যয় হচ্ছে। বিশেষ করে অপ্রয়োজনীয় মাত্তালা বিমানবন্দর ও হাম্বানতোতা বন্দর নির্মাণের প্রকল্পগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়।

দুই পক্ষই অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের কথা বললেও কিভাবে তারা তা করবেন, তা প্রকাশ করছেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে, সরকারের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২০১৮ সালের শেষভাগে ছিল ৩২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪ সালে তা ছিল ২৪ বিলিয়ন ডলার।

বৃহত্তম তামিল গ্রুপ তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স খুব সম্ভবত সাজিথকে সমর্থন দেবে। অবশ্য তারা বলছে যে ইউএনপির নতুন সংবিধান প্রণয়নের সময় তাদের কথা শোনা হয়নি, তারা গত নির্বাচনের সময় তামিলদের হাতে আরো ক্ষমতা প্রদানসহ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পূরণ করেনি।
শ্রীলঙ্কা মুসলিম কংগ্রেসের মতো দলগুলো ইউএনপি জোটের অংশ হওয়া সত্ত্বেও এই আমলে তিনবার মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা হয়েছে। ২০১৮ সালে আম্পারা ও ক্যান্ডিতে দুবার, ২০১৯ সালে কয়েকটি স্থানে। এতে মুসলিমদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
ইস্টার সান হামলার পর মুসলিমদের সাথে সরকার যে আচরণ করছে, তাতেও এই সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us