মোদি-শি বৈঠকে কাশ্মির সমীকরণ
মোদি-শি - ছবি : সংগৃহীত
একটি প্রধান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে চীন সাধারণভাবে একই সময়ে অনেক বলের খেলা দেখাতে পারে। বর্তমানে বেইজিংয়ের বড় উদ্বেগ হলো তার সবসময়ের অংশীদার পাক্সিতানের মধ্যে কোনো ধরনের সংশয়ের সৃষ্টি না করেই ১১ অক্টোবর শুরু হওয়া চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের ভারতসফরটি সফল করা।
সভাটিতে রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর দিকে নজর দেয়া হবে। অবশ্য, উভয় দেশই বিনিয়োগ বিনিময়ে আগ্রহী। সতর্কভাবে প্রণীত ব্যবসায়িক পরিকল্পনাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে রাজনীতি ও অহং প্রবণতা। আজকে তা হলো কাশ্মির ইস্যু।
মঙ্গলবার চীন ইঙ্গিত দিয়েছে যে সে কাশ্মির প্রশ্নে তার অবস্থান সংশোধন এবং অনুচ্ছেদ ৩৭০ স্থগিত করা এবং লাদাখসহ জম্মু ও কাশ্মিরকে কেন্দ্রশাসিত এলাকায় পরিণত করার ভারত সরকারের ৫ আগস্টের সিদ্ধান্তের আগের অবস্থানে ফিরে যেতে প্রস্তুত।
এর আগে চীন সাধারণত জোর দিয়ে বলত যে কাশ্মির প্রশ্নে সে নিরপেক্ষ এবং এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ‘ঐতিহাসিক’ ইস্যু এবং তা তাদেরই সমাধান করা উচিত। কিন্তু ৫ আগস্টের পর বেইজিং পাকিস্তানের অনুকূলে কথা বলেছে, চেষ্টা করেছে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মির ইস্যুটি উত্থাপন করতে। ভারত জোরালোভাবে প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু বেইজিং তার ‘লৌহ ভ্রাতা’ পাকিস্তানের সাথে অটল থেকেছে।
এখন চীন এই ধারণা দিতে চাচ্ছে যে সে নমনীয় হতে পারে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেঙ শুঙ মঙ্গলবার বেইজিংয়ে বলেছেন, আমরা ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি কাশ্মির ইস্যুসহ সব বিষয়ে সংলাপে বসতে এবং পারস্পরিক আস্থা সুসংহত করতে। এটি উভয় দেশের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বিশ্বের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা।
এটিকে বড় ধরনের ছাড় মনে হতে পারে। কারণ পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বেইজিং সফর করছেন এবং শি ও প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াঙের সাথে তার বৈঠকের কথা রয়েছৈ। ইমরান খান কাশ্মিরের দিকে নজর দিলেও তিনি সেইসাথে আর্থিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য বেপরোয়াভাবে তহবিলও কামনা করছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করসহ (তিনি একসময় বেইজিংয়ে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন) ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত প্রণয়নকারীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা মনের পরিবর্তন হওয়াটা তারা বিশ্বাস করতে চান কিনা।
চীন কি কাশ্মিরকে দরকষাকষির বস্তু হিসেবে ব্যবহার করে তার অবস্থান নমনীয় করার বিনিময়ে কিছু দাবি করছে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শির মধ্যকার অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠকের লক্ষ্য ছিল দুই দেশেরমধ্যকার সম্পর্কের কঠোরতা হ্রাস করা।
উভয় পক্ষই ২০১৮ সালে ওহানে এই প্রয়াসটি সফল করার চেষ্টা করেছিলেন কোনো সহায়তাকারী ছাড়াই বৈঠক করে। এ ধরনের পরবর্তী বৈঠকটি হবে মামালাপুরমে। তামিল নাড়ুর এই শহরে হওয়া বৈঠকে পারস্পরিক সমঝোতার দিকেই বেশি নজর দেয়া হবে।
চীন যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার মধ্যস্ততাকারী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করে তবে তা ভারতীয় পক্ষ শুনবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই সে তার অবস্থান নমনীয় করেছে।
অন্য দুটি ইস্যুতেও মোদিকে রাজি করানো কঠিন হবে মোদির জন্য। চীন কাশ্মির ইস্যুটি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করায় বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নিয়ে ভারতের অবস্থান আরো কঠোর হয়েছে।
সীমান্তের কাছাকাছি যেকোনো স্থানে চীনা অবকাঠমো গ্রহণ করে নেয়ার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও ভারত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবে না।
বেইজিং অনেক দিন ধরেই উদ্বিগ্ন এ কারণে যে পাকিস্তানের সাথে তার সম্পর্কের কারণেই তার বৈশ্বিক ভাবমূর্তি ও ভারতের সাথে তার সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। চীনে এই আওয়াজ উঠছে যে আগামী কয়েক দশকে কোনো ধরনের মুনাফা পাওয়ার সম্ভাবনা ছাড়াই চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে (সিপিইসি) টাকা ঢালছে।
সিপিইসি বিনিয়োগ অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠবে যদি প্যারিসভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) পাকিস্তানের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। অথচ সিপিইসি হবে শির প্রিয় বিআরআই পরিকল্পনার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ শোকেস। পাকিস্তানভিত্তিক প্রকল্পটিতে কোনো ধরনের বিপর্যয় কয়েক ডজন দেশকে নিয়ে করা পুরো পরিকল্পনাটিই সমস্যায় পড়ে যাবে।
কিন্তু ভারত অব্যাহতভাবে বিআরআইকে প্রতিরোধ করতে থাকায় এবং সীমান্ত-সম্পর্কিত সন্দেহ উভয় পক্ষে বিরাজমান থাকায় পাকিস্তানে বিনিয়োগ হ্রাস করাও চীনের জন্য কঠিন। মুসলিমবিশ্ব ও আফগানিস্তানে চীনের প্রভাব বাড়ানোর কাজেও পাকিস্তান সহায়তা করছে।
মামালাপুরামে নেয়া-দেয়ার অবকাশ খুবই কম। উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা সফল বলে কিছু পাওয়ার জন্য কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করার প্রয়োজন নেই। উভয় পক্ষের প্রয়োজন মুখ রক্ষা করা।
চীন ইঙ্গিত দিতে পারে যে সে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিনিয়োগ বাড়াবে। চীনা বিনিয়োগের জন্য ভারত তার বাজার আরো খুলে দিতে পারে। এই বিনিয়োগ ভারতের ব্যাপকভাবে প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো উভয় দেশ কিভাব তাদের নিজ নিজ জনগণের কাছে শীর্ষ বৈঠকটি বিক্রি করবে এবং একে সফল হিসেবে প্রচার করবে।
ইকোনমিক টাইমস