যেভাবে বদলে গেল তালেবান
যেভাবে বদলে গেল তালেবান - ছবি : সংগৃহীত
আল-কায়েদার চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন আফগান তালেবান। তারা ১৯৯০-এর দশকে বিন লাদেন ও তার বাহিনীকে আশ্রয় দিলেও তালেবান কখনোই বৈশ্বিক জিহাদের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি, তারা আফগানিস্তানেই সীমিত থেকেছে। তাদের কোনো সদস্য ৯/১১-এর সাথে যুক্ত ছিল না, তারা বিদেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে সাধারণভাবে বিরত থেকেছে।
বস্তুত, ১৯৯০-এর দশকে তাদের শাসনকালে তারা অনেক দিক থেকেই বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। মাত্র তিনটি সরকার তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল- পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। আর আফগানিস্তানে দূতাবাস ছিল কেবল পাকিস্তানের। অন্যদিকে ১৯৯৮ সালে আল-কায়েদার দূতাবাসে বোমা হামলা চালানোর কারণে তালেবান চিল জাতিসঙ্ঘ অবরোধের মুখে।
তালেবানের মূল নেতৃত্ব এসেছিল প্রধানত আফগান গ্রামীণ এলাকা থেকে। তারা বহির্বিশ্বকে জানত সামান্যই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মোল্লা ওমর তার পুরো জীবনে বিদেশে গিয়েছিলেন মাত্র দুবার। ১৯৮০-এর দশকে তার এই দুটি সফরই হয়েছিল সোভিয়েতবিরোধী জিহাদের সময় পাকিস্তানে।
সবকিছুই বদলে যেতে থাকে ৯/১১-এর পর। আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানে তালেবান উৎখাত হয়, অনেক সদস্য পালিয়ে পাকিস্তান, উপসাগরীয় দেশগুলো, ইরান ও তুরস্কে চলে যায়। এটা তালেবানের দিগন্ত প্রসারিত করে, নতুন নতুন ধারণার সাথে তারা পরিচিত হন।
আন্দোলনটি নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি কসমোপলিটান হয়ে পড়ে। এর কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে ইংরেজিতে বিদেশী মিডিয়ার সামনে হাজির হন। এর ওয়েবসাইটে ইংরেজিসহ নানা ভাষায় তথ্য পাওয়া যায়। টুইটার, ফেসবুকের মতো সামাজিক মিডিয়ায় তারা খুবই সক্রিয়, তাদের মুখপাত্র হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন।
অধিকন্তু, এর সদস্যরা ব্যাপকভাবে বিশ্বসফরের জন্য পরিচিত হয়ে পড়েন। দোহায় রাজনৈতিক অফিস খোলার পর থেকে তালেবান প্রতিনিধিরা ইরান, চীন ও রাশিয়া সফ করেছে, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কথা নাই বা বলা হলো। অতি সম্প্রতি তারা উজবেকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়াও গেছে।
অধিকন্তু তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও সাংহাই সহযেগিতা সংস্থার মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও সম্পৃক্ত। তারা বেসামরিক নৃশংসতা নিয়ে জাতিসঙ্ঘের সাথে সংলাপে বসেছে, তাদের কর্মকর্তারা বিদেশে বিভিন্ন সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে।
তালেবান নিজে বিদেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত হওয়ার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ না দেখালেও তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষাকারী হাক্কানি নেটওয়ার্ক সিরিয়ায় কিছু যোদ্ধা পাঠিয়েছে।
এটি একটি প্রান্তিক বিষয়। তালেবান তাদের যোদ্ধাদের বিদেশে পাঠায় না। বরং বিদেশীদের আকৃষ্ট করে তাদের সাথে লড়াই করার জন্য। তারা আল-কায়েদা ছাড়াও পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বা ও অন্যান্য সংগঠনের সাথেও সম্পর্ক রক্ষা করে চলে।
তালেবানের মতাদর্শ আগের চেয়ে অনেক কম ধর্মকেন্দ্রিক রয়েছে। আলেক্স স্ট্রিক ভ্যান লিনস্কটেন ও আনন্দ গোপাল জানিয়েছেন, প্রচলিত ইসলামের ব্যাপারে তালেবান তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তারা এখন আধুনিক বিশ্বের সাথে অনেক বেশি সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী। এ কারণেই তারা সামাজিক মিডিয়া ও প্রযুক্তির ব্যবহার করছে।
স্টিভ কল তার ডিরেক্টেরট এস নামের গ্রন্থে লিখেছেন, পাকিস্তানে অবস্থানের সময় তালেবান নেতারা ইসলামের বিভিন্ন সংস্করণের সাথে পরিচিত হয়। আগে তারা এসব ব্যাপার এড়িয়ে যেত। এখন তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের আলোচনা ও বহুমতকে গ্রহণ করতে বেশ আন্তরিক।
তালেবান মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রশংসা করে। ২০১২ সালে মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হলে দলটি তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল। ২০১৯ সালে মুরসি মারা গেলে তারা মন্তব্য করেছিল যে এই মৃত্যু মিসর ও পুরো ইসলামি বিশ্বের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি।
রাজনৈতিক ইসলামের একটি অবয়ব হলো বিশ্বজনীনতা। ইসলামপন্থীরা মুসলিম উম্মাহর সাথে সংহতি প্রকাশ করতে আগ্রহী থাকে। মুসলিম বিশ্বের বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের নিয়ে তালেবান বেশ কিছু বিবৃতি দিয়েছে।
উদহারণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৮ সালে তেল আবিব থেকে জেরুসালেমে ইসরাইলের রাজধানী সরিয়ে নেয়ার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে তালেবান নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানায়।
গত মার্চে ক্রাইস্ট চার্চে হামলার ব্যাপারেও তালেবান বিবৃতি দেয়। নিরীহ মুসুল্লিদের ওপর হামলার ঘটনাকে তারা চরম ঘৃণা ও ক্ষমাহীন অপরাধ হিসেবে অভিহিত করে। অর্থাৎ মুসলিম স্বার্থের ব্যাপারে তালেবানের আগ্রহ বেশ স্পষ্ট হয় এসব ঘটনায়।
উজবেকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া সফরের সময় গ্রুপটি ইসলামি পরিচিতির ওপর জোর দেয়। মোল্লা বারাদর ও তার সহকর্মীদের বুখারার মুসলিম স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় তারা আলেমদের সাথে বৈঠক করেন। তালেবান নিজেদেরকে আফগান আন্দোরন নয়, বরং বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে নিজেদের পরিচিত করছে।
ভবিষ্যতে এর বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। কে বলতে পারে যে ভবিষ্যতে তালেবান বিদেশে তাদের মুসলিম ভাইদের সহায়তা করবে না? তবে এখন তারা আফগানিস্তান যুদ্ধের দিকেই মনোযোগ নিবদ্ধ করে আছে। তারা এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায়, নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পেরেছে যে বিদেশে হস্তক্ষেপ করা হলে অবরোধ ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
আফগানিস্তানের স্থবির অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য বিদেশী অর্থনৈতিক সহযোগিতাও প্রয়োজন তালেবানের। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়র সাথে বেশি করে একীভূত তালেবান শেষ পর্যন্ত আরো উদার হবে, মানবাধিকারের ব্যাপারে আরো গ্রহণযোগ্য হবে বলে আশা করা যায়।
যাই ঘটুক না কেন, পুরনো, কঠোর ধর্মীয় বিধিনিষেধে আবদ্ধ তালেবান ইতোমধ্যেই অনেক বেশি আধুনিক ও কসমোপলিটান আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আমরা ১৯৯০-এর দশকের পর অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি।
দি ডিপ্লোম্যাট