নেপালে ভারতকে যেভাবে হারিয়ে দিচ্ছে চীন

ক্রাসজটপ আইওয়ানেক | Oct 08, 2019 09:16 pm
নেপালে ভারতকে যেভাবে হারিয়ে দিচ্ছে চীন

নেপালে ভারতকে যেভাবে হারিয়ে দিচ্ছে চীন - ছবি : সংগৃহীত

 

কয়েক বছর আগে আমি বেইজিং থেকে দিল্লি যাত্রা করেছিলাম স্থলপথে, তিন ধাপে। প্রথমটি ছিল বেশ দ্রুত, রেলগাড়ি ও বাসে করে, বেইজিং থেকে লাসা পর্যন্ত। এরপরের দুটি ধাপ ছিল অনেক দীর্ঘ। জিপে করে লাসা থেকে কাঠমান্ডু এবং তারপর বাসে করে কাঠমান্ডু থেকে দিল্লি পর্যন্ত। এই সফরের মধ্যের ধাপটি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, নেপাল ও চীন-নিয়ন্ত্রিত তিব্বতের মধ্যে কী ভীষণ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এই যাত্রার ফলে মাঝে মাঝে কানে আসা নেপাল-চীন রেলপথের ধারণাটি আমার মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি করেছে। পড়া এখানেই শেষ করবেন না। এটি এমন কোনো লোকের প্রবন্ধ নয়, যিনি একবার অঞ্চলটি দেখে মনে করেছেন যে তিনি এর রাজনীতি বুঝে ফেলেছেন। আমার জানা আছে যে আমি সেখানে গেছি, জায়গাটি দেখেছি বলতে যথাযথ বাছাই হয় না। আমি যা আলোচনা করতে চাইছি তা বাস্তবে অন্তর্জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে। অর্থাৎ নেপালের ভৌগোলিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে যে ধারণায় উপনীত হয়েছি, তার অনেকটাই বিপরীত দেশটির বর্তমান আন্তর্জাতিক অবস্থান।

যদি কেউ কোনো দেশের রাজনীতির ভূগোলের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে চায়, তবে তার সমানে নেপালের ভূরাজনীতি একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে। ভূবেষ্টিত, দুটি বৃহৎ প্রতিবেশীর মধ্যে থাকা তুলনামূলক ছোট দেশ হওয়া, দক্ষিণ দিকে ভারতের প্রতি সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত হওয়া, উত্তর দিকে বিশ্বের উচ্চতম পর্বতমালা দিযে চীনের পথটি দৃশ্যত রুদ্ধ থাকায় ভূগোল কতটা বাস্তব অবস্থা তার নিখুঁত উদাহরণ হলো নেপাল। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি বেইজিংয়ের সাথে কাঠমান্ডুর সম্পর্ক ভূরাজনীতি ও ভূগোলকে অস্বীকার করে।
ভূরাজনীতিকে এখানে রাজনীতির অংশ হিসেবে ভূগোলকে গুরুত্ব দেয়, এমন চিন্তাধারা হিসেবে বুঝতে হবে। নেপালের আন্তর্জাতিক অবস্থানের ভূরাজনৈতিক দর্শন অনেক বছর ধরেই ভুল পথে চালিত করেছে। এটা ভারতীয় পক্ষ প্রশ্নে ভ্রান্ত নীতিমালা সৃষ্টি করেছে, এবং সেইসাথে চীনের ভূগোলের ভয়ের অভাবের কারণে তাকে নেপালে তাকে প্রভাব বিস্তারের আরো সুযোগ করে দিয়েছে।

প্রথমত, ভূগোল সবসময় গুরুত্বপূর্ণ থাকলেও এর তাৎপর্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সংশোধন ও বিলীন করা যেতে পারে। ভূগোলকে চ্যালেঞ্জ করার অন্যতম সাহসী কাজ হিসেবে চীন ইতোমধ্যেই বেইজিং থেকে লাসা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করেছে। ২০১৪ সালের মধ্যে শিগাতসে পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা হয়ে গেছে। এখন চলছে নেপাল সীমান্তের গিরং পর্যন্ত নির্মাণকাজ। তবে নেপাল সীমান্তে পর্বতমালা থাকায় এরপর রেললাইন নির্মাণ করা যাবে কিনা তা নিয়ে আমি সন্দীহান। তবে তিব্বত পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ হয়ে যাওয়া হিমালয় অঞ্চলে সঙ্ঘাত সৃষ্টি হলে চীন এখন অনেক দ্রুততার সাথে সশস্ত্র বাহিনী পাঠাতে পারবে।

অবশ্য রেলপথ না থাকলেও নেপাল কিন্তু পুরোপুরি ভারতের ওপর নির্ভরশীল নয়। হিমালয়ের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে চলাচলের পথ আছে। সাধারণ জ্ঞানের কথা হলো এই যে নেপালে আসা প্রায় সব পণ্য আসে ভারত হয়ে। এমনকি নেপালগামী চীনা পণ্য যদি সমুদ্রপথে পূর্ব ভারত হয়ে (সাধারণভাবে কলকাতা) স্থল পথেই পরিবহন করা হয়। চীন-নেপাল বাণিজ্য নিয়ে প্রকাশ খারেলের ছোট্ট তবে চমকপ্রদ সমীক্ষায় দেখা গেছে যে বিভিন্ন পথে চীনা পণ্য আমদানিতে তেমন ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে না। ২০১৭ সালে চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ৫৯ ভাগ এসেছে ভারত-নেপাল সীমান্ত দিয়ে। আর বাকি ৪১ ভাগ এসেছে আকাশ ও তিব্বত থেকে বিমানপথে। ২০১৫ সালে ভূমিকম্পের পরও একই অবস্থা ছিল। ২০১৩ সালে তিব্বত ও বিমানপথে চীনা পণ্য এসেছিল ৪৭ ভাগ, আর ভারত হয়ে এসেছিল ৫৩ ভাগ।

অধিকন্তু, চীন থেকে নেপাল যাওয়া বিমান সংযোগ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। অনেক বেশি লোক, অর্থ ও ব্যবসা এতে সম্পৃক্ত হচ্ছে। গত কয়েক বছরে দুই দেশ কয়েকবারই তাদের বিমান সার্ভিস চুক্তি সংশোধন করেছে। এর ফলে ১০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ফ্লাইট সংখ্যা ১৪ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৮। ধারণা করা হয় বন্যা পর্বতমালা অতিক্রম করতে পারে না। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বন্যার মতোই চীনা পর্যটক দেখা গেছে নেপালে। অবশ্য ভারতীয় পর্যটকের তুলনায় চীনারা সংখ্যায় অনেক কম, কিন্তু তারা ইতোমধ্যেই দ্বিতীয়স্থানে চলে এসেছে। তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০১৮ সালে নেপালে এসেছিল ভারতের দুই লাখ পর্যটক, আর চীনের দেড় লাখ। এই বাস্তবতাও মনে রাখতে হবে যে নেপালে ভারতীয়রা এসেছে মোটামুটিভাবে বাসে, আর চীনারা বিমানের টিকেট কেটে।

দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি সহযোগিতার নতুন মাত্রার সৃষ্টি করেছে। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের বিষয়টির কথাই ধরা যাক। নেপালে প্রভাব বিস্তারের চীন-ভারত লড়াই চলছে সেই ১৯৫০-এর দশক থেকে। এটা নতুন কিছু নয়। উভয় দেশই অর্থের বিনিময়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে, এখনো করছে। অনেক দিন পর্যন্ত ভূগোলই ভারতকে সুবিধা দিয়েছে। আগে নেপালকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ভারত নগদ মুদ্রাসহ যেকোনো কিছু পরিবহন বন্ধ করে দিতে পারত। কিন্তু ইন্টারনেট আর্থিক বিষয়টি প্রায় অদরকারি করে ফেলেছে। এখন ইলেকট্রনিকব্যবস্থায় নেপালের প্রয়োজনে ভারতের চেয়ে চীনই অনেক বেশি অর্থ পাঠাতে পারে। এর ফলে ভারতের আগের সুবিধাটি শেষ করে ফেলেছে।

ইন্টারনেট ভূগোলকে অতিক্রম করে গেছে, নেপাল ও চীন সম্প্রতি ফাইবার লিঙ্কের মাধ্যমে সংযোজিত হয়ে গেছে।
তৃতীয় বিষয়টি শিগগিরই অগ্রাহ্য করা হবে। তা হলো চিন্তাধারা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও মতাদর্শ। সংস্কৃতিকে ভূগোলের মতো করে পরিমাপ করা যায় না। আধুনিক নেপালে ভাষা ও সংস্কৃতির জটিল মিশ্রণ রয়েছে। এ দিক থেকে চীন ও ভারত উভয়কেই কিছু সুযোগ ও কিছু সমস্যার সৃষ্টি করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নেপালের সাথে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নয়া দিল্লির জন্য বেশ ভালো সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু এটিই ভারতের জন্য বোঝা হয়ে দেখা দেয়, যখন সে নেপালকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্ত্বা হিসেবে বুঝতে না পারে। ২০১৬ সালে নেপালের ওপর ভারতের অবরোধের কারণেই কাঠমান্ডুকে বেইজিংয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আর বেইজিং সুযোগটি লুফে নিয়েছিল। সংস্কৃতির ব্যাপারেও ভারত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও মাঝে মাঝে ভুল নীতির কারণে সমস্যার সৃষ্টি করে। আর সেটাই নেপালকে ঠেলে দেয় চীনের দিকে।

অন্যদিকে নেপালের সাথে বৌদ্ধধর্মের সম্পৃক্ততার কথা বলে চীন। লুম্বিনিতে বৌদ্ধের জন্মস্থানের মতো প্রকল্পগুলোতে এ কারণেই অর্থায়ন করতে রাজি থাকে চীন। ভাষার প্রতিবন্ধকতাও এড়ানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে অনেক নেপালিই চীনা ভাষা শিখতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।
তবে এর মানে এই নয় ভূগোল কোনো প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করছে না বা ভবিষ্যতে নেপালের অবস্থানে কোনো প্রভাব ফেলবে না। সর্বোপরি চীনের চেয়ে অনেক সস্তায় নেপালে অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারে ভারত। সাম্প্রতিক পেট্রোলিয়াম পণ্যের পাইপলাইন এর একটি উদাহরণ। তাছাড়া অবরোধ আরোপ করার মতো শক্তি ভারতের হাতে রয়েই গেছে।

তবে তাই বলে আমি বলছি না যে ভূরাজনীতি চিন্তাভাবনা নেপালে নয়া দিল্লির অবস্থান শক্তিশালী করার বদলে দুর্বল করে দিয়েছে। আসলে এই ভৌগোলিক সুবিধাই নয়া দিল্লির মধ্যে নেপাল তার বলে ধারণার জন্ম দিয়েছে। ভারত মনে করছে যে নেপাল সার্বভৌম দেশ নয়, বরং তারই বর্ধিত অংশ মাত্র। এই চিন্তা থেকেই অবরোধ আরোপ করেছিল। অথচ এটিই অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে নেপালে ভারতের ভাবমূর্তিতে সবচেয়ে বড় আঘাত সৃষ্টি করেছে।

এই অঞ্চলে চীনের নির্মাণ এত তাৎপর্যপূর্ণ ও দৃশ্যমান হয়ে পড়েছে যে রবার্ট ক্যাপলান পর্যন্ত লিখেছেন যে ‘হিমালয় সমান হয়ে পড়ছে’ এবং ‘দূরত্বের অবসান”। এ ধরনের উপসংহার হয়তো স্ব-লক্ষ্য বা রাজনীতিতে ভূগোলের নৈকট্যের ওপর জোর দেয়া বলে মনে হতে পারে। হিমালয়ের উঁচু প্রাচীর আর দুই মহান সভ্যতাকে আলাদা করতে পারে না বলে তিনি (ভূগোলের বদলা নামের গ্রন্থের লেখক) মন্তব্য করেছেন। আমি ধরে নিতে পারি যে আমরা বর্তমান চীন-নেপাল সম্পর্ককে ভূরাজনীতি প্রশ্নে জটিল বাস্তবতার বদলা হিসেবে অভিহিত করতে পারি।
দি ডিপ্লোম্যাট


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us