হংকংয়ে বিক্ষোভ : কী করবে চীন?
হংকংয়ে বিক্ষোভ : কী করবে চীন? - ছবি : সংগ্রহ
এশিয়ার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র হংকংয়ে আবারো চলছে ব্যাপক আন্দোলন-বিক্ষোভ। চার মাস ধরে এই আন্দোলনে শত শত মানুষ গ্রেফতার হয়েছে, পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে অনেকে। জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। নতুন করে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার কারণ একটি নতুন আইনের প্রস্তাব।
এ আইনে বলা হয়েছে- বেইজিং, ম্যাকাও এবং তাইওয়ান থেকে পালিয়ে আসা কোনো অপরাধীকে ফেরত চাইলে তাকে চীন সরকারের কাছে ফেরত দিতে হবে; বিশেষত যেসব অপরাধীর বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণের মতো অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ চীন সরকার চাইলে অপরাধীকে চীনের কাছে তুলে দিতে বাধ্য থাকবে হংকং কর্তৃপক্ষ। এবং চীন সেই অপরাধীদের নিজ ভূখণ্ডে নিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে। অপরাধী প্রত্যর্পণের এই আইনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে হংকংয়ের মানুষ। প্রায় চার মাস আগে শুরু হয় বিক্ষোভ। আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দ্বীপ ভূখণ্ডটি। হংকংয়ের জনগণের মতে, এ আইনের মাধ্যমে হংকংয়ের বিচারব্যবস্থাই হুমকির মুখে পড়বে এবং তাদের ওপর চীনের প্রভাব বাড়বে।
চীনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গুয়াংদং প্রদেশের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত হংকং প্রাচীনকাল থেকে চীনেরই অংশ ছিল। কিন্তু ১৮৪০ সালের পর অঞ্চলটি ব্রিটেনের দখলে চলে যায়। এর ১৫৭ বছর পর চীন ও ব্রিটেনের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় হংকং দ্বীপ, কাউলুন, সিনকাই- এ তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত হংকং অঞ্চলটি চীনের হাতে ফিরে আসে। তবে চুক্তি অনুযায়ী চীন হংকংয়ের ‘স্বায়ত্তশাসন’ মেনে নেয় এবং সেখানে নিজস্ব একটি প্রশাসন ক্ষমতাসীন থাকে। তখন থেকে ১০৯৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ভূখণ্ডের প্রায় ৭০ লাখ মানুষ সমাজতান্ত্রিক চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার আওতায় থেকেও ব্রিটিশ স্টাইলের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসিত হয়ে আসছে। চীনের ‘এক দেশ দুই নীতি’ ব্যবস্থার আওতায় চলছে হংকংয়ের ‘গণতান্ত্রিক শাসন’।
হংকংয়ের বেশির ভাগ মানুষ জাতিগতভাবে চীনা বংশোদ্ভূত। চীনের মূল ভূখণ্ডে নেই এমন স্বাধীনতা হংকংয়ের জনগণ আজো উপভোগ করছে। তবে সমালোচকেরা বলছেন, ‘তাদের এই স্বাধীনতা এখন হুমকির মুখে। সেখানকার বিক্ষোভকারীরা মনে করছেন, প্রত্যর্পণ বিল পাস হলে হংকং পরিণত হবে আরেকটি চীনা নগরে। তার স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না।’ এজন্যই প্রত্যর্পণ আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কার্যত হংকংয়ের স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
বিলটি বাতিল করার দাবিতে জুনে শুরু হওয়া বিক্ষোভে এক দিনে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ সমবেত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত ১ অক্টোবর চীনের জাতীয় দিবসে হংকংবাসী ‘শোক দিবস’ পালন করে। বিবিসির খবরে বলা হয়, চীনের কমিউনিস্ট শাসনের ৭০ বছর উদযাপনের দিনটিতেই সবচেয়ে বেশি সহিংস ও বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে হংকং। বিশেষ প্রশাসনিক এ অঞ্চলে চীনের বা বেইজিং সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ চায় না সেখানকার মানুষ।
ওই দিন হংকংয়ের বিক্ষোভকারীরা আইনসভা ভবনে ভাঙচুর চালায় এবং অধিবেশন কক্ষে ঢুকে পড়ে। তারা স্প্রে- পেইন্ট দিয়ে কক্ষের দেয়ালে নানা রকম বার্তা লিখে দেয়। একজন বিক্ষোভকারী কেন্দ্রীয় অধিবেশন কক্ষের ভেতরের দেয়ালে হংকংয়ের প্রতীকের ওপর কালো রঙ ছিটিয়ে দেয়। আরেকজন পুরনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের ‘ইউনিয়ন জ্যাক’-আঁকা পতাকা তুলে ধরে।
ওইদিনই পুলিশ প্রথম বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে তাজা বুলেট ছোঁড়ে। এতে অন্যান্যের মধ্যে ১৮ বছরের এক স্কুলছাত্রও আহত হয়েছে। এই ঘটনায় ক্ষোভ আরো তীব্র হয়ে ওঠে। হংকংয়ের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। মুখোশ পরে বিক্ষোভে শামিল হচ্ছে সর্বস্তরের সব বয়সের মানুষ। ২০১৪ সালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তরুণ হিরো ২২ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী জোশুয়া ওং সদ্য কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই বিতর্কিত প্রত্যর্পণ বিলের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন-বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। তৈরি হয়েছে আপসহীন নতুন তরুণ নেতৃত্ব। তারা জেল-জুলুম-গুলি উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।
হংকংয়ের বেইজিংপন্থী প্রশাসক ক্যারি লাম বিক্ষোভের মুখে প্রস্তাবিত বিল স্থগিত করেছেন এবং এই বিলটি বিতর্কের জন্ম দেয়ায় ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু তাতে জনগণের ক্ষোভ কমছে না। তারা লামের পদত্যাগ এবং বিলটি চিরতরে বাতিল করার দাবি জানাচ্ছেন।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ আগেই যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে চীনের প্রতি হুঁশিয়ারি বার্তা জানিয়েছেন। নতুন আইনের কারণে হংকংয়ের আইনসংক্রান্ত নীতিমালা পরিবর্তিত হতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী মহল এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোও একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তবে হংকংয়ের কর্তৃপক্ষ বলছে, এ আইন নিয়ে এত দুর্ভাবনার কিছু নেই। কারণ, এ অপরাধী প্রত্যর্পণের অনুরোধে সাড়া দেয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে হংকংয়ের বিচার বিভাগই। কিন্তু বিশ্লেষকদের ধারণা, এ আইনের ফলে চীনা বিচারব্যবস্থার অধীনে অন্যায্যভাবে আটক ও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যাবে।
ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে আন্দোলনে নামলেও বিক্ষোভকারীদের অনেকেই পুরোপুরি আশাবাদী নন। কারণ, হংকংয়ের আইনসভায় বেইজিংপন্থীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। নানা কৌশলে হংকংয়ের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে কমিউনিস্ট চীন। আইনসভায় বেইজিংপন্থী নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এরই মধ্যে চীনা প্রভাবের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বিক্ষোভ দমনে ব্যর্থ হয়ে হংকং কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বিক্ষোভে মুখোশ পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বিক্ষোভকারীরা মুখোশ পরে যেন নিজেদের পরিচয় লুকাতে না পারে, এ জন্য গত শুক্রবার জরুরি নির্দেশে ঔপনিবেশিক যুগের আইন বলবৎ করেছেন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটির নির্বাহী ক্যারি লাম। গত শনিবার থেকে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা নাকচ করে দিয়ে মুখোশ পরেই এ দিন সকালে ফের হংকংয়ের রাস্তায় নামেন বিক্ষোভকারীরা। শুধু তাই নয়, হংকংয়ের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকায় রাস্তাগুলোতেও ব্যারিকেড বসান। বিবিসির ভাষ্য, মুখোশ নিষিদ্ধ করায় আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন বিক্ষোভকারীরা। নিষেধাজ্ঞা আইনের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তারা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষের জন্য কঠিন হবে।
গণতন্ত্রের দাবিতে চার মাস ধরে একরকম অচল, চীনের অধীনস্থ ‘এক দেশ, দুই নীতি’র অঞ্চলটি। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কর্তৃপক্ষ যে ব্যর্থ হচ্ছে, তার লক্ষণ স্পষ্ট। এই সময়ে হংকংয়ে অবস্থানরত চীনা সেনাবাহিনী কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে, তাদের স্থাপনার ওপর কোনো আঘাত এলে বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করা হবে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গণতন্ত্রকামীদের সতর্ক করার ঘটনা এটাই প্রথম।
অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন, চীন হংকংয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কারণ, নিজের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করতে চাইবে না বেইজিং। হংকং অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চীনা অর্থনীতির জন্য হংকং কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যাবে নিচের তথ্যগুলোর দিকে নজর দিলে। ২০১৭-১৮ সালে চীন যে ১২৫ বিলিয়ন ডলার সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ পেয়েছে, তার মধ্যে ৯৯ বিলিয়ন ডলারই এসেছে হংকংয়ের মাধ্যমে। চীনে যারা বিনিয়োগ করতে চান, তারা আইনের শাসন ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার জন্য হংকংকে চীনের ‘সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা’ মনে করেন। ২০১৮ সালে চীন দেশটির ৬০ শতাংশ কোম্পানি আইপিও খুলেছে হংকংয়ের শেয়ারবাজারে। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের পর্যায় থেকে চীনাদের নিয়ন্ত্রণে আসার সময় হংকংয়ের অর্থনীতি ছিল চীনের মোট অর্থনীতির ১৮ শতাংশের মতো। আর গত বছর চীনের জিডিপির ২.৭ শতাংশের সমান অবদান রেখেছে হংকং। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে এটি হংকংয়ের এক বিরাট অবদান তাতে সন্দেহ নেই।
গ্যারেথ লেদার নামের একজন অর্থনীতিবিদের বক্তব্য তুলে ধরেছে বিবিসি। তাতে লেদার বলেন, ‘আমার মনে হয় হংকং চীনের কাছে ততটা গুরুত্ব বহন করে না। চীনের সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা, আর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যই তারা হংকংয়ের কিছু সাফল্য বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত।’ লেদার বলেন, ‘উদ্বেগের বিষয় হলো- হংকং শাসনের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। প্রকৃত ঝুঁকি হলো, হংকং সরকার পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারছে না, যেটা চীনকে সহায়তায় এগিয়ে আনতে পারে।’ এ জন্যই চলমান এই সঙ্কটকে চীনের জন্য বড় পরীক্ষা বলেও মনে করা হচ্ছে।
চীন কি যুক্তরাজ্যের সাথে সম্পাদিত তার চুক্তির প্রতি অনুগত থাকবে নাকি সেনাবাহিনী দিয়ে হংকংয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ বহাল করবে, সেই প্রশ্ন জেগেছে অনেকের মনে।
আমাদের ধারণা, এ ঘটনা চীনকে ব্যাপকভাবে বিব্রত করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এ মুহূর্তে বড় ধরনের বাণিজ্য যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে চীন। এদিকে, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বলয় সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ ইনিশিয়েটিভ নিয়ে চালাচ্ছে মহাযজ্ঞ। এই সময়ে হংকং ইস্যুতে তারা খুব একটা অস্থির হয়ে উঠবে, এমনটি মনে হয় না। হংকংয়ের আন্দোলন এখনো রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠেনি। কেউ নিহত হয়নি। সেনাবাহিনী তথা চীনা নেতৃত্ব ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে। অদূরভবিষ্যতে তারা কোন দিকে যাবে, সেটি আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করবে বলে মনে হয়।
তবে হংকং চীনের নিয়ন্ত্রণেই আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই সত্য চীনের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।