৭১ বছর বয়সে যুবনেতা : রাজনীতিবিদদের কাণ্ডজ্ঞানের সমস্যা

যুবলীগ চেয়ারম্যান - ছবি : সংগ্রহ
মানবজীবন বয়সের দিক থেকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত- শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন আর বার্ধক্য। মানুষ মাত্রই এসব ধাপ পেরোতে হয়। শৈশব-কৈশোরের নির্ভরতা কাটিয়ে তারুণ্য-যৌবনে পা দিয়ে প্রত্যেকে মহৎপ্রাণ হওয়ার জন্য থাকে উদগ্রীব। স্বপ্নে বিভোর থাকে। স্বপ্ন বাস্তবায়নে তরুণ প্রাণে থাকে আকুলতা-ব্যাকুলতা। মনে জাগে সমাজ পরিবর্তনের তীব্র বাসনা। সব অন্যায় ধুয়ে মুছে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থাকে তীব্র। মনের মণিকোঠায় বাসা বাঁধে দৃঢ়সঙ্কল্প। তারুণ্য আর যৌবনের ধর্মই হলো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
চার দিকের নানা অসঙ্গতি দেখে যুবশক্তি হয়ে ওঠে বিদ্রোহী। তবে পরিবার-সমাজের পারিপার্শ্বিক চাপে অনেকে পথহারা হয়ে, জীবনের গতিপথ হারিয়ে চোরাগলিতে মিলিয়ে যায়। এমন উদাহরণ আমাদের চার পাশে রয়েছে ভূরি ভূরি। সত্য ও ন্যায়ের সাথে যুবশক্তির নিত্যবসবাসের আকুতির মূলে রয়েছে অবৈষয়িক ভাবনা। তরুণ মন স্বার্থদুষ্ট হয়ে ওঠে না। সে শক্তিই তাকে করে তোলে অপ্রতিরোধ্য। তাই প্রতিটি রাষ্ট্র বিনির্মাণে তরুণ আর যুব সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য ও অনস্বীকার্য। দুনিয়ায় যেসব জাতি উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছে; তাদের উন্নয়নের মূলে রয়েছে যুব সম্প্রদায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম। এ কারণে দেশে দেশে যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে দেখা যায় যাতে যুবশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। আমাদের দেশেও যুবশক্তিকে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত করতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির মাঠে নিজেদের শক্ত ভিত নির্মাণে গঠন করেছে যুব সংগঠন। যুবশক্তির ওপর ভর করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তৎপরতা প্রবল। আর আমাদের দেশে যুব সংগঠনগুলো দস্তুরমতো মূল দলের অঙ্গসংগঠনের মর্যাদা পেয়েছে। ফলে রাজনীতির ময়দানে এসব সংগঠনের কদর ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে বিরোধী দলে থাকলে রাজনীতিবিদদের কাছে যুব আর ছাত্র সংগঠনগুলোর কদর থাকে আকাশছোঁয়া। রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়ান যুব নেতাকর্মীরা। এ ক্ষেত্রে যুব আর ছাত্র সংগঠনের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষণীয়। দেশের দুই প্রধান দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) যুব সংগঠনের নাম যথাক্রমে আওয়ামী যুবলীগ এবং জাতীয়তাবাদী যুবদল। সংক্ষেপে যুবলীগ আর যুবদল। এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির যুব সংগঠনের নাম যুব সংহতি। যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে এর তেমন প্রভাব নেই। বাম আদর্শে গড়ে ওঠা যুবমৈত্রীসহ আরো কিছু সংগঠন ক্ষীণ ধারায় বহমান। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের নভেম্বরে যুবলীগের জন্ম। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। তখন তার বয়স ছিল ৩২ বছর। এর বছর ছয়েক পরে ১৯৭৮ সালের ২৭ অক্টোবর গোড়াপত্তন যুবদলের। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজ দল বিএনপির অঙ্গসংগঠন হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার চিন্তা ছিল, যুবশক্তিকে দেশ গড়ায় যথাযথভাবে কাজে লাগানো।
বর্তমান যুব নেতৃত্বের হালহকিকত ভালো নয়; বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। শাসক দলের যুব সংগঠন যুবলীগ চেয়ারম্যানের বয়স ৭১ বছর। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের দেশের গড় আয়ু এখন ৭১-৭৩ বছর। এতে দেখা যাচ্ছে, যুবলীগের নেতৃত্ব ‘চিরযুবা’। যুবলীগের চেয়ারম্যান যখন সংগঠনটির প্রধান পদে আসীন হয়েছিলেন; তখন তার বয়স ছিল ৬৪ বছর। সাত বছর ধরে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। অথচ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর কমিটি করার কথা। শুধু তিনি নন, যুবলীগের নেতাদের আরো অনেকের বয়স ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উভয়ের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। ষাটের কাছাকাছি। যুব সংহতির সভাপতি ও সেক্রেটারির একই অবস্থা। শুধু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নয়, মহানগর, জেলা ও উপজেলা শাখার বেশির ভাগ কমিটির ‘যুব’নেতাদের বয়স এমনই। যুবনেতা নির্বাচনে মূল দলের নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি যদি জাতীয় কবির ভাবদর্শন হয়ে থাকে, তাহলে আলাদা কথা।
কবি নজরুল ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধে যৌবনকে বয়সের ফ্রেমে বাঁধতে ছিলেন নারাজ। তার মতে, মনে তারুণ্য থাকলেই সে যুবক। ইংরেজিতে আমরা যাকে বলি, ‘এভারগ্রিন’; মানে চিরসবুজ। আর বয়সে তরুণ-যুবক হলেও মনে জ্বরা এসে বাসা বাঁধলে সে আর যাই হোক, যুব নয়। আসল কথা, গতিশীলতাই তারুণ্য আর যুবশক্তির প্রতীক। অর্থাৎ তারা ‘চিরনবীন’। রবীন্দ্রনাথও যৌবনের জয়গান গেয়ে বলেছেন, ‘ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা/ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ যৌবনের বন্দনায় সমকালীন বাংলা কবিতায় বাংলাদেশের কবি হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটির আবেদন অর্ধশতাব্দীতেও ম্লান হয়নি। শিক্ষিত মহলে বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে এখনো কবিতাটি তুমুল জনপ্রিয়। বিখ্যাত সেই কবিতা দেশের আনাচে-কানাচে দেয়াললিখনে শোভা পায়। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাছে এর কদর আকাশছোঁয়া। একটি কবিতার বদৌলতে দেশের আনাচে-কানাচে কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল হেলাল হাফিজের। সেই কবিতার পঙ্ক্তি- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ নিরেট যৌবনের বিজয়গাথা।
এত বেশি বয়সেও যুব সংগঠনের নেতৃত্বে থাকাকে ‘রাজনীতিবিদদের কাণ্ডজ্ঞানের সমস্যা’ বলে মনে করেন লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুবিধাবাদের রাজনীতিতে নিয়মনীতি, সামাজিকতা কিছুই মানা হচ্ছে না। এমনকি বয়সটাও মানা হচ্ছে না। চক্ষুলজ্জাও হারিয়ে ফেলেছে। ৪০ বছরের বেশি কারো কোনোভাবেই যুবলীগের নেতা হওয়া উচিত নয় (সূত্র : প্রথম আলো, ৩ অক্টোবর ২০১৯)।
কী কারণে সৈয়দ আবুল মকসুদ ৪০ বছরের কথা উল্লেখ করেছেন; তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু পবিত্র কুরআনে মানুষের ৪০ বছর বয়সের কথা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে- ‘অতঃপর সে তার পূর্ণশক্তি পর্যন্ত পৌঁছায় এবং সে ৪০ বছরে এসে উপনীত হয়, তখন সে বলে, হে আমার রব, এখন তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও- তুমি আমার ওপর যেসব অনুগ্রহ করে এসেছ এবং আমার বাবা-মায়ের প্রতি যে করুণা তুমি করেছ, আমি যেন এর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারি, আমি যেন ভালো কাজ করতে পারি; যার ফলে তুমি আমার ওপর সন্তুষ্ট হবে। আমার সন্তানসন্ততির মাঝেও তুমি সংশোধন এনে দাও, অবশ্যই আমি তোমার দিকে ফিরে এসেছি। অবশ্যই আমি তোমার অনুগত বান্দাদের একজন। এরাই হচ্ছে সেসব মানুষ, যারা যেসব ভালো কাজ করে তাদের কাছ থেকে তা আমি গ্রহণ করি। আর তাদের মন্দ কাজগুলো আমি উপেক্ষা করি। এরা জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা : ৪৬, আয়াত : ১৫-১৬)।
মূলত ৪০ বছর বয়স হচ্ছে মানবজীবনের পূর্ণতার বয়স। কেন যে, আমাদের দেশে যুব রাজনীতি বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হলো- সত্যিই তা এক অপার রহস্য। অথচ শুরুতে এমন ছিল না। তখন যারা যুব রাজনীতির কর্ণধার ছিলেন, তারা প্রকৃত অর্থেই ছিলেন যুবক। তা হোক বয়সে কিংবা কাজে। আমাদের সবার জানা, বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানের বদৌলতে চল্লিশ-পরবর্তী মানবজীবনের সূচক হয় নিম্নগামী।
রাষ্ট্রীয়ভাবেও কিন্তু যুবশক্তির মানদণ্ড নির্ণয়ে, ২০১৭ সালের জাতীয় যুবনীতি অনুসারে, ‘১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের যেকোনো বাংলাদেশী নাগরিক যুব হিসেবে গণ্য হবে’ উল্লেখ করা হয়েছে। যুব নেতৃত্ব নির্বাচনে গোঁজামিল আর কাকে বলে? গোঁজামিলের কারণেই দেশে যুব সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে বয়সের ভারে ন্যুব্জ ‘আদু ভাই’ মার্কা নেতারা যুব সংগঠনে আদরণীয়-কদরণীয় হয়ে ওঠেন। এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। যুব সংগঠনের নেতৃত্ব আদৌ যুব রাজনীতি কি না তা নিয়ে জনসাধারণের মাঝে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে- বর্তমানে দেশে ‘যুব রাজনীতি’র নামে যা চলছে, আসলে তা ‘রাজনীতির যুবশক্তি’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
camirhamza@yahoo.com