এনআরসি আর সিএবি : কী করবে ভারতীয় মুসলিমেরা?

অন্য দিগন্ত ডেস্ক | Oct 04, 2019 08:51 pm
এনআরসি আর সিএবি : কী করবে ভারতীয় মুসলিমেরা?

এনআরসি আর সিএবি : কী করবে ভারতীয় মুসলিমেরা? - ছবি : সংগৃহীত

 

এখন অলক্ষুণে গুড় গড় শব্দ আসছে অনেক দূর থেকে। আজকে তা দ্রুত ভয়াবহ ঝড়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। এটি শেষ পর্যন্ত আমরা যে ভারতকে চিনি, সেটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। অনেকে আশা করেছিল যে একমাত্র ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে নাগরিকত্ব থেকে লোকজনকে বাদ রাখার সংশোধিত আইনটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর প্রবল বিরোধিতার মুখে পরিত্যক্ত হবে। তারা আরো আশা করেছিল যে সাম্প্রদায়িকতা বিদ্বেষপূর্ণ সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনে আসামের বাইরেও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) করার যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছিল, তা স্রেফ নির্বাচনী বাগাড়ম্বড়তাই হয়ে থাকবে, নির্বাচনী ফায়দা লাভের মেরুকরণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার, ক্ষমতাসীন দল ও তাদের আদর্শিক গুরু, আরএসএস তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডার জন্য নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) ও জাতীয় এনআরসি করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পার্লামেন্টে ঘোষণা করেছেন যে তিনি ভারতীয় মাটির প্রতিটি ইঞ্চি থেকে ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ বিতাড়িত করবেন। তিনি প্রতিটি রাজ্যে বিদেশীদের জন্য আটক কেন্দ্র নির্মাণ করতে বলেছেন, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে, এমন উপায়ে সিএবি পাস করবেন। বিজেপির বেশ কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী ও নেতা তাদের রাজ্যে এনআরসি বাস্তবাযনের আহ্বান জানিয়েছেন। আর আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত হিন্দুদের আশ্বস্ত করেছেন যে এনআরসিতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, বিভিন্ন শহরসহ ভারতজুড়ে মুসলিম বসতিগুলোতে আতঙ্ক আর ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য কী কী নথিপত্র লাগবে, তা বেপরোয়াভাবে জানতে চাইছে লোকজন। তাছাড়া সময়সীমা ১৯৭১, ১৯৪৭, ১৯৫১ না ১৯৮৭- কোনটি হবে তা জিজ্ঞাসা করছে। যারা এসব নথিপত্র সংগ্রহ করতে পারবে না, তাদের পরিণাম কী হবে, সেটাও জানতে চাইছে। ক্ষমতাসীন এস্টাবলিশমেন্টের কেউ জবাব দিচ্ছে না। ফলে সচকিত ভাব ও বিভ্রান্তিই কেবল বাড়ছে প্রতিদিন। এমনকি দিল্লিতে গৃহহীন আশ্রয়গ্রহণকারী মুসলিম লোকজন আমাদের কাছে জানতে চাইছে- আমাদের কী হবে? আমাদের কাছে তো কোনো নথিপত্র নেই। আর অন্যান্য ধর্মের লোকজন উদ্বিগ্ন নয়।

স্বাধীনতার পর প্রথম ৪০ বছর তথা ১৯৮৭ পর্যন্ত ভারতে জন্মগ্রহণকারী যে কেউ ভারতের নাগরিক বিবেচিত হতো। ১৯৮৭ সালে আইন সংশোধন করে বলা হয়, অন্তত এক শতাংশ ভারতীয় হওয়ার শর্ত নির্ধারণ করা হয়। ২০০১৩ সালে আমি ভারতীয় নাগরিক হতে পারতাম ওই এক শতাংশের জোরে। আর যারা তাও ছিল না, তাদেরকে অবৈধ অভিবাসী বলা হতো না। তাদের চিহ্নিত করা হতো বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে অবস্থানকারী হিসেবে।
এটাই সন্ত্রস্ত্রকরণের বীজ রোপণ করে। এখন সিএবি পাস হলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদেরকে (মুসলিমদের বাদ দিয়ে) ভারতীয় গণ্য করা হবে। ২০০৩ সালের সংশোধনীটিসহ নতুন ব্যবস্থার অর্থ হবে কেবল যেসব মুসলিম নথিপত্রহীনভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে, তারাই অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হবে। এখানেই শেষ নয়, তাদের সন্তান, তাদের সন্তানাও ভারতের নাগরিকত্ব পাবে না। এই প্রত্যাখ্যান হবে চিরস্থায়ী। কারণ এ ধরনের লোকদের নাগরিকত্ব অর্জনের কোনো পথ খোলা রাখা হয়নি। এমনকি যারা ভারতে জন্মগ্রহণ করেছে, অন্য কোনো দেশকে চেনে না, যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও পোষণ করে না, তারাও ভারতের নাগরিকত্ব পাবে না।

এর আরেকটি অর্থ হলো, মুসলিম ছাড়া অন্য কারো নাগরিকত্বের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ তাদের কাছে নথিপত্র না থাকলেও তারা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে। সিএবির পর এনআরসিতে কেবল ভারতীয় মুসলিমদেরকেই প্রমাণ করতে হবে যে তাদের পূর্বপুরুসেরা ভারতে আইনসম্মতভাবে প্রবেশ করেছিল। আবার নাগরিত্ব প্রমাণ করার দায়িত্বটি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নাগরিকদের ওপরই ন্যস্ত করেছে। অত্যন্ত গরিব, নিরক্ষর লোকদেরকেই ভোটার কার্ড, জন্ম নিবন্ধন ইত্যাদি নথিপত্র জোগাড় করতে হবে। আরো খারাপ ব্যাপার হলো, অমিত শাহের অধীনে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজ্যগুলোকেই দায়িত্ব দিয়েছে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করতে, এসব ট্রাইব্যুনালে নিজস্ব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে, মানদণ্ড নির্ধারণ করতে।
বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিভাজন ও আদর্শগত বিভ্রান্তি থাকায় কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সভায় সিএবি পাস করতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাসী।

কিন্তু সিএবি কার্যত ভারতীয় সংবিধানের অনেক মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব অধিকারের একটি হলো সাম্য। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে যদি ভারতে আশ্রয় পাওয়া ও নাগরিকত্ব লাভের মাপকাঠি হয়, তবে কেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, চীনের উইঘুর, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আহমদিয়া ও শিয়া, এসব দেশের সেক্যুলার ব্লগার ও সমকামী মুসলিমেরাও এই সুবিধা পাবে না?
আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এসব সংশোধনী ভারতের সেক্যুলার গণতান্ত্রিক সংবিধানের আত্মাকেই আঘাত করে। ভারতে আমরা মহাত্ম্যা গান্ধী, বি আর আম্বেদকর, জওহের লাল নেহরু ও মাওলানা আযাদের ঐতিহ্যে পরিপুষ্ট। এই দেশে সব নাগরিক সমান, তারা তাদের ইচ্ছামতো ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারে, নাস্তিকও হতে পারে। ধর্মীয় পরিচিতির ওপর ভিত্তি করে নাগরিক নির্ধারণের কোনো দেশ হিসেবে ভারতকে কল্পনা করা হয় না।

এক শ’ বছর আগে হিন্দু মহাসভা ও ১৯২৫ সালে আরএসএস অন্য এক ভারতের কল্পনা করেছিল। তাদের কল্পিত ভারতে হিন্দুরা শাসন করবে, প্রাধান্য বিস্তার করবে, মুসলিমদের বহিষ্কার করা হবে কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হবে। ১০০ বছর পর বর্তমান ক্ষমতাসীন এস্টাবলিশমেন্ট মনে করে, ওই সময় এসে গেছে। সিএবি ও দেশব্যাপী এনআরসি-এ কার্যত কেবল মুসলিমদেরকেই তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। এর ফলে কোটি কোটি মুসলিমের মধ্যে ভয়, দুর্ভোগ আর অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে।

এই ভয়ঙ্কর ঝড় আগামী মাসগুলাতে ভারতকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। আর তা একসময় যেভাবে মনে করা হয়েছিল, যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তা ধ্বংস করে ফেলবে। আমাদের মুসলিম ভাই বোনেরা এজ এই হুমকিকে স্পষ্টতই ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে দেখছে। আর আমাদের বাকিরা উদ্বেগহীনভাবেই আমাদের জীবন অতিবাহিত করব।
আমরা কী বুঝতে পারছি না যে এটা ভারতের সেক্যুলার গণতান্ত্রিক সংবিধানের মৃত্যু হিসেবে চিহ্নিত হবে?

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us