ডাকসু এ কী হাল!

ডাকসু এ কী হাল! - ছবি : সংগ্রহ
ডাকসু এ কী হাল!
গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে ডাকসুর সুনাম ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ডাকসুর একটি ঐতিহ্যবাহী ভূমিকার কথা সর্বজন স্বীকৃত। যখনই কোনো স্বৈরশাসক গণতন্ত্রকে পদদলিত করতে চেয়েছে, তখনই জেগে উঠেছে ডাকসু। সে ইতিহাস ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বিস্তৃত। ২৭ বছর পর মৃত ডাকসু যখন জীবিত হয়েছে, তখন পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় গড়িয়ে গেছে অনেক পানি। দেশ হারিয়েছে ‘নির্বাচনী গণতন্ত্র’। সুতরাং দেশের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন, ক্ষমতাসীনদের ‘শক্তির সংস্কৃতি’ দিয়েই সম্পন্ন হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম ডাকসু ভিপি নুরুল হক। সবেধন নীলমণি অথবা হারাধনের একটি ছেলে। লোকে বলে নিরঙ্কুশ জনপ্রিয়তা হজম করা সম্ভব হয়নি। অন্যরা বলে সমগ্রকে জায়েজ করার কেরামতি। নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক তার স্বীকৃত মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত। যেখানেই যায় সেখানেই শাসক দলের সোনার ছেলেরা তাকে মারধর করে। এসবের মধ্যেও ‘আগুনমুখা গাঙপাড়ের সাহসী ছেলেটি’ এগিয়ে যাচ্ছে। যা হোক, নির্বাচনী কেরামতির পর এখন ডাকসু স্বস্বীকৃত বৈধতার সঙ্কটে নিপতিত। তথাকথিত নির্বাচিত ডাকসু জিএস একই সাথে ছিলেন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। অতি সম্প্রতি তিনি চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য অপরাধে ক্ষমতার সর্বোচ্চ কেন্দ্র থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। তিনি সঙ্গতভাবেই ডাকসুর জিএস হিসেবে পদে অধিষ্ঠিত থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে পদত্যাগ করাই ছিল সঙ্গত।
তবে তিনি আসছেন না। ডাকসুর কোনো কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন না। ডাকসুর অন্য পদাধিকারীরাও প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের অনেকেই নিয়মানুগভাবে ছাত্রত্ব অর্জন করেননি। যে কায়দায় দেশ চলছে, সেই কায়দায় তারা ভর্তি হয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে আইন-কানুন, নিয়ম-রীতি এবং ন্যায়ানুগতার কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। এ হেন ডাকসু গত সপ্তাহে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তটি নিয়ে এখন তর্কবিতর্ক চলছে। এটি তাদের সীমা-পরিসীমার বিষয় কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর বর্তমান ডাকসুর তৃতীয় কার্যকরী পরিষদের সভায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত পরিবেশ পরিষদ ক্যাম্পাসে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়।
উল্লেখ্য যে, দীর্ঘকাল ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠনকে প্রকাশ্যে কাজ করতে দিচ্ছিল না ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনটি। এবার তারা নির্বাচিত ডাকসুকে ব্যবহার করে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করল। এ বিষয়ে ডাকসুর এজিএস ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ধর্মভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি আমাদের কার্যনির্বাহী সভার অ্যাজেন্ডায় ছিল। সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্তটি পাস হয়েছে।’
সর্বসম্মতির কথা বলা হলেও ডাকসু ভিপি পরে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে ভিন্নমত পোষণ করেন। জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজও নিষিদ্ধ করা হয় বলে ভিপি নুরুল হক জানান। তিনি তার বিবৃতিতে বলেন, ‘সাধারণ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেটা নয়।’ তিনি তার ব্যাখ্যায় বলেন, ‘সিদ্ধান্ত হয়েছে ধর্মীয় উগ্রবাদী, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধ’। দৃশ্যত দুই নেতার বক্তব্যে নীতিগত সামঞ্জস্য থাকলেও প্রয়োগিক ভিন্নতা রয়েছে। নুরুল হক যা বোঝাতে চান তা হলো, ধর্মভিত্তিক সব সংগঠনই সাম্প্রদায়িক, উগ্রবাদী ও মৌলবাদী নয়। ধর্মের শ্বাশত আবেদন রয়েছে। যে কেউ ধর্মের বাণী প্রচার ও প্রকাশ করতে পারে। তাছাড়া এর একটি মানবিক ও আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে।
তবে ধর্মকে ভর করে যদি কেউ হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ায় তা ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। একই সাথে যে সংগঠন সহজ-সরল, নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পথ না নিয়ে চরম পথ নেয় অথবা উগ্রতা ছড়ায় তা সমাজের সাধারণ স্বভাববিরোধী। সুতরাং দেশ-জাতি-রাষ্ট্র এর বিরোধী পদক্ষেপ সঙ্গতভাবেই নিতে পারে। অবশ্য বিশ^ব্যাপী বুশওয়ার বা ওয়ার অন টেররের ব্যাখ্যায় বাংলাদেশ সরকার শান্তি-অশান্তি অথবা চরম-পরম এর পার্থক্য নির্ণয়ে অপারগ হতে পারে। ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলোর পাশাপাশি স্বৈরাচারের সাথী অভিধায় অভিযুক্ত জাতীয় ছাত্রসমাজকে নিয়েও দুই পক্ষের ভিন্নমত পরিলক্ষিত হয়। ছাত্রসমাজ নিষিদ্ধ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ডাকসু ভিপি-এজিএসের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ২৬ সেপ্টেম্বর কার্যনির্বাহী সভায় ক্যাম্পাসে সব ধর্মভিত্তিক (সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী) ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রস্তাবের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির সহযোগী সংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজ নিষিদ্ধের প্রস্তাব দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন ভিপি নুরুল হক নূর। এদিকে জাতীয় ছাত্রসমাজের বিষয়টি সভার অ্যাজেন্ডাতে ছিল না বলে দাবি করেন এজিএস সাদ্দাম হোসেন। ভিপি নুরুল হক নূরের দাবি, ১৯৯০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের সভায় ক্যাম্পাসে জাতীয় পার্টির ছাত্রসমাজ এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এর কোনো লিগ্যাল ফরম্যাট ছিল না। তাই ডাকসুতে উগ্র, সাম্প্রদায়িক, ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি এবং জাতীয় ছাত্রসমাজের রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রস্তাবের সঙ্গে সবাই একমত হয়েছে।
ভিপি নূর জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের গৃহপালিত বিরোধী দল আখ্যা দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গৃহপালিত বিরোধী দল নিয়ে ক্ষমতায় আছে। আর সাদ্দাম হোসেন যেহেতু ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন এবং তার একটি মাদার অর্গানাইজেশন আওয়ামী লীগ এই গৃহপালিত দলের কারণে ক্ষমতায় থাকাটাকে জায়েজ করে নিয়েছে। তাই এখন রাজনৈতিক কারণে হয়তো এই কথাটা উল্টিয়ে বলছেন যে, ‘তারা ছাত্রসমাজ নিয়ে কথা বলেননি।’ ভিপি নূর আরো বলেন, ‘১৯৯০ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এর কোনো লিগ্যাল বডি ছিল না। তাই আমরা সবাই ওই সিদ্ধান্ত ডাকসুর গঠনতন্ত্রে সংযোজনের প্রস্তাব করেছি। এখানে ছাত্রসমাজের বিষয়ে ছাত্রলীগের মনোনীত প্যানেলের সবাই একমত হয়েছে। এখন তারা বারবার বলছে যে, ধর্মভিত্তিক সব ছাত্র সংগঠনের নিষিদ্ধের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, ছাত্রসমাজকে নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু ডাকসুতে প্রস্তাবনা ছিল, ধর্মভিত্তিক উগ্র, মৌলবাদী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা। কারণ এখানে অনেক ইসলামী নিবন্ধিত দল রয়েছে, তাদের যদি আমরা নিষিদ্ধ করি তাহলে আদালতের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। তাই ভিসিও (আখতারুজ্জামান) বলেছিলেন, শুধু ধর্মভিত্তিক দল নয়, এদের মধ্যে যারা উগ্র তাদেরও নিষিদ্ধ করতে। এ বিষয়ে ডাকসুর সহ-সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, জাতীয় ছাত্রসমাজের বিষয়টি গতকালের অ্যাজেন্ডাভুক্ত ছিল না। এটি পরিবেশ পরিষদ আগেই নিষিদ্ধ করেছে। তবে ভিপি এ বিষয়ে একবার আলোচনা করছিল।
ভিসি আখতারুজ্জামান নিশ্চিত করেন, ওই সভায় কোনো সংগঠনের নাম ধরে আলোচনা হয়নি। দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনীতি দিয়ে তাদের ছাত্র সংগঠনটিও দারুণভাবে প্রভাবিত। জাতীয় সংসদে যেমন জাতীয় পার্টি গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত, জাতীয় ছাত্রসমাজকেও ছাত্রলীগ সেভাবেই দেখতে চায়। অবশ্য তাদের নিষিদ্ধ করার অধিকার তথাকথিত পরিবেশ পরিষদ বা ভিপি নুরুল হক সংরক্ষণ করেন না। গণতান্ত্রিক অধিকার সবার জন্য সমান। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানে যে, তাদের পছন্দ না হলেও মেনে নিতে হবে। গণতন্ত্রের শর্ত অনুযায়ী ধর্মের নামে রাজনীতি করার বা স্বৈরাচারের সাথী হওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে। আবার তাদের বিপক্ষে কথা বলার অধিকার সবার রয়েছে। পরমতকে অবশ্যই সহ্য করতে হবে। মনীষী ভলটেয়ার বলেন, ‘আমি আপনার সাথে একমত না হতে পারি কিন্তু আপনার কথা বলার অধিকারের জন্য প্রয়োজনে আমি প্রাণ দিতে পারি।’ কিন্তু শাসক দলের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ভিন্ন রকম। তারা যা বলবে, যা করবে, যা আদেশ দেবে- সেটাই হচ্ছে গণতন্ত্র। লক্ষণীয় যে, এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগের একক ও অলঙ্ঘনীয় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে চলছে। কোথাও কারো কথা বলার এতটুকু অধিকার নেই।
অলিখিতভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাম ঘরানার যেসব ছাত্র সংগঠন তাদের পরিপূরক শুধু তাদেরই ছাত্রলীগ কথা বলতে ও কাজ করতে দিয়েছে। এই সমীকরণটি বুঝতে ডাকসু নির্বাচন-পূর্ব সংলাপ স্মরণ করা যেতে পারে। যেসব প্রতিবাদী সংগঠন বাম অথবা ডান তারা কখনোই স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বিচরণ করতে পারেনি। এরা সবচেয়ে আপসহীন ও মারমুখী ছিল এদের প্রধান প্রতিপক্ষ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতি। হলে হলে খুঁজে খুঁজে তারা ছাত্রদলের নেতাকর্মী ও সাধারণ সমর্থকদের বিতাড়ন করেছে। ইসলামী ছাত্রশিবির অনেক আগে থেকেই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত রয়েছে। মাঝে মধ্যে তাদের অপছন্দের যে কাউকে শিবির সন্দেহে পেটানোর অনেক খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যখনই কোনো জনপ্রিয় ইস্যু নিয়ে মিটিং-মিছিল হয়েছে তখনই শিবিরের তৎপরতা বলে এরা সে আন্দোলন বানচালের চেষ্টা করেছে। যেমন : কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন।
এসব আন্দোলন মূলত সরকারবিরোধী কোনো বিষয় ছিল না। ক্ষমতাসীনেরা সবসময়ই ওইসব আন্দোলনকে তাদের বিরোধী বলে মনে করেছে। এর পেছনে বিরোধী দলের দুরভিসন্ধি প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে যখন ধর্ষণবিরোধী মিছিল হয়, হাস্যকরভাবে এটাকেও তারা শিবিরের অপতৎপরতা বলে প্রচার করেছে। বিগত প্রায় ১২ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালসহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের ন্যূনতম অস্তিত্বও তারা সহ্য করেনি। তারা খালি মাঠে গোল দিয়েছে। সুতরাং এখন নতুন করে ধর্মভিত্তিক অথবা স্বৈরশাসককেন্দ্রিক ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধকরণের ঘোষণা নতুন করে পুরনো ঘটনা। ইতোপূর্বে যা তারা করেছে, গায়ের জোরেই করেছে। ডাকসু হওয়ার পর তারা অবৈধকে বৈধ করার আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ পেয়েছে। ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠন এমনিতেই সর্বত্র দুর্দান্ত প্রতাপে রাজত্ব করে যাচ্ছে। জাতীয় মডেলের নিশীথ নির্বাচনের মতো নির্বাচন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের অপতৎপরতার আইনানুগ ভিত্তি দেয়ার কৌশল তারা হাতে নিয়েছে। ডাকসু মার্কা নির্বাচন সাধারণ ছাত্রসমাজের কোনো উপকারে আসবে না, বরং অন্যায়, অপকর্ম ও অত্যাচার আইনানুগতা পাবে।
ঢাবিতে ধর্মভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি প্রত্যাখ্যান করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ইসলামী ও সমমনা ১৪টি ছাত্র সংগঠনের নেতারা। এক যৌথ বিবৃতিতে ছাত্রনেতারা বলেন, বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে ডাকসু ঐতিহ্যবাহী নাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডাকসুর ঐতিহ্যে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
ছাত্রনেতারা অভিযোগ করেন, সম্প্রতি ঢাবিতে ধর্মভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের মতো এখতিয়ারবহির্ভূত ও অসাংবিধানিক দাবি জানিয়েছে ডাকসু। ছাত্র রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ও মূলধারার ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজে ছাত্রসমাজ হতবাক ও বিক্ষুব্ধ। ডাকসুর এ ঘোষণা অগণতান্ত্রিক ও ডাকসুর নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। একই সাথে এ দাবি সুস্পষ্টভাবে ডাকসুর এখতিয়ারবহির্ভূত ও অসাংবিধানিক। তাদের ভাষায়, ভিপিকে পাস কাটিয়ে গৃহীত এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নূরও অকপটে এ কথা স্বীকার করেছেন।
ছাত্রনেতারা মন্তব্য করেন, আশ্চর্যজনক বিষয় হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে ইসলামী ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা হচ্ছে। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল মূলত এ অঞ্চলে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ধর্মবিরোধী তথা মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী এই সিদ্ধান্ত নেয়ার অপচেষ্টা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড এ দেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, তাহজিব তমদ্দুনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তাচেতনায় আঘাতের শামিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে চরমোনাই পীর সাহেবের ছাত্র সংগঠন ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত সমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুছ আহমাদ বলেন, ঢাবি ক্যাম্পাসে ধর্মভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব পাস করে ডাকসু একটি অসাংবিধানিক ও অধিকারবহির্ভূত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্যাম্পাসে কে কোন মত ও পথের রাজনীতি করবে তা নির্ধারণ করার এখতিয়ার ডাকসু রাখে না।
ডাকসুর নামে ছাত্রলীগ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটি দেশের সংবিধান ও সরকার অনুসৃত বিধান ও দৃষ্টিভঙ্গিবিরোধী। আমরা সবাই জানি যে, আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বহাল রেখেই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখেছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক : বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ তাহলে স্পষ্টত ডাকসুর সিদ্ধান্ত সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ধর্মের প্রতি কী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, কওমি মাদরাসার সনদ স্বীকৃতি ও অবশেষে হেফাজতে ইসলামকে গণভবনে তুলে আনার ঘটনা থেকে তা প্রমাণিত।
প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলে থাকেন, ‘দেশ মদিনার সনদ অনুযায়ী শাসিত হচ্ছে।’ জঙ্গি দমনে সরকার ও এর নেতারা যেসব শব্দাবলি উচ্চারণ করেন তা ডাকসু ভিপি নূরের ব্যাখ্যার কাছাকাছি, ছাত্রলীগের বাক্য বিন্যাসের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। আর নীতিগতভাবে বা দর্শনগতভাবে যদি ছাত্রলীগ মনে করে এটি ধর্ম নিরপেক্ষতার ব্যত্যয়, তাহলে তাদের মডেল ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দিতে হয়। ভারতে হিন্দুত্ববাদের উগ্র উত্থানের কারণে, বাংলাদেশেও উগ্র ইসলামের আবির্ভাব হতে হবে- এটা কোনো যৌক্তিক বক্তব্য হতে পারে না। তবে বাস্তবতা হলো, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ-আরএসএসের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠন কাজ করছে।
সেখানে স্বাধীনতার সুপ্রভাত থেকেই বিগত ৭৩ বছর ধরে মুসলিম ও ইসলামের পরিচয় বহনকারী মুসলীম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী বহাল তবিয়তে কার্যকর রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমদের নতুন জোট ‘মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমীন’-এর আত্মপ্রকাশও বাধাগ্রস্ত হয়নি। পাশ্চাত্য- ইউরোপ আমেরিকা যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের স্বর্গ বলে দাবি করে, সেখানে খ্রিষ্টধর্মের নামে অসংখ্য রাজনৈতিক দল কাজ করছে। জার্মানিতে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতায় রয়েছে। চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মারকেল তার প্রতিনিধিত্ব করছেন। ফ্রান্সেও ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বেশ জনপ্রিয়। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ রিপাবলিকান পার্টি মূলত খ্রিষ্ট ধর্মভিত্তিক। ব্রিটেনে ক্রিশ্চিয়ান পিপলস অ্যালাইন্সের আদর্শ খ্রিষ্টধর্ম। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের রাজনৈতিক দলের নাম আমেরিকান সলিডারিটি পার্টি। আর ‘ব্যাক টু দ্য বাইবেল’ স্লোগান নিয়ে ইভেনজালিকা আন্দোলন সেখানে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে খ্রিষ্টধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতসব উদাহরণ এ কারণে দিতে হলো, যাতে ক্ষমতাসীনদের অগ্রসর প্রজন্ম সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের বিষয়ে আশ্বস্ত হতে পারে। আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীলরা ধর্মের বিদায়কে ধর্মনিরপেক্ষবাদের স্তম্ভ মনে করেন। বক্তৃতা ও বিবৃতিতে যারা প্রায়ই পাশ্চাত্যের উদাহরণ দেন, তাদের প্রকৃত ইতিহাস ও বর্তমান প্রবণতা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বলা যায়।
উপর্যুক্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এতক্ষণে এ কথা নিশ্চয় স্পষ্ট হয়েছে যে, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে ডাকসুর মতো রাষ্ট্রের অধস্তন প্রতিষ্ঠান কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। যেখানে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, লালন ও অগ্রায়ন তাদের কর্তব্য, সেখানে তারা সংবিধান ও প্রচলিত বিধিবিধানবিরোধী অবস্থান নিয়ে স্বইচ্ছামূলক ঘোষণা প্রকাশ করতে পারে না। আশা করি বুঝে-শুনে অবশেষে ডাকসু তাদের গৃহীত অন্যায় সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com