কোন খেলায় ভারত-ইরান সম্পর্কে নতুন জটিলতা!
কোন খেলায় ভারত-ইরান সম্পর্কে নতুন জটিলতা! - ছবি : সংগৃহীত
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রে ছয় দিনের সফর শুরু করেছিলেন হিউস্টনে হাউডি মোদিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে চমকপ্রদ স্টেজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু বৃহস্পতিবার শেষ করেছেন নিউ ইয়র্কে ইরানি প্রেসিডেন্ট রুহানির সাথে তাড়াহুড়া করে আয়োজিত এক বৈঠকের মাধ্যমে। রুহানি যখন তেহরান ফেরছিলেন, তখনই আয়োজন করা হয় এই বৈঠকের। তবে এর তাৎক্ষণিক প্রতীকী মূল্য অবশ্যই আছে।
এর মাত্র চার দিন আগে হাউডি মোদিতে ট্রাম্প সঙ্ঘ পরিবারের শ্রোতাদের রোমাঞ্চিত করে বহুল আলোচিত মন্তব্যে বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উচিত হবে যৌথভাবে ‘চরমপন্থী ইসলামি সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধে লড়াই করা। মোদি ও শ্রোতারা ভুলভাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে ট্রাম্প নিন্দা করেছেন পাকিস্তানকে। কিন্তু পরের দিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেই বলেছেন যে তিনি এ দিয়ে ইরানের কথা বুঝিয়েছেন।
অবশ্য ফটো সাংবাদিকতা যদি কোনো ইঙ্গিত দেয়, তবে বুঝতে হবে, রুহানির সাথে বৈঠক করে সমঝোতার চেষ্টা করেছেন মোদি। এটা অবশ্যই কঠিন বৈঠক ছিল। ইরানি প্রতিবেদন ছিল অনেক চাপা। প্রাথমিক লক্ষ্য মনে হয় ছিল বরফ গলানো।
মোদির নজরদারিতেই ভারত-ইরান সম্পর্ক চড়াই-উৎড়াই প্রত্যক্ষ করেছে। ২০১৫ সালের জুনে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার ঐতিহাসিক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে তিনি যখন প্রথম রুহানির সাথে বৈঠক করেছিলেন, তখন বিপুল আশাবাদের সৃষ্টি হয়েীছল। মোদি তখন ইরানের শিল্প ও অবকাঠামো খাতসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
রুহানি তা আন্তরিকভাবে গ্রহণ কছিলেন, ভারতের সাথে দ্রুত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাকিস্তানের উত্তেজনাপ্রবণ সীমান্ত থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে ভারতীয় উপস্থিতি নিয়ে ইসলামাবাদের অসন্তুষ্টি থাকা সত্ত্বেও কৌশলগত চাবাহার বন্দরে ভারতের জন্য একটি কন্টেইনার টার্মিনাল চালু করেছিল ইরান।
রুহানি পাকিস্তানকে আরেক দফা অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন আরো উত্তরে ইরান-আফগান সীমান্তের জাহেদানের সাথে চাবাহার বন্দরকে সংযোগকারী রেলওয়ে লাইন প্রতিষ্ঠার ভারতের প্রস্তাবে রাজি হয়ে।
ভূ-রাজনৈতিক কারণে ভারতীয়রা উৎফুল্ল হয়েছিল। ইরানের সাথে আঞ্চলিক কানেকটিভিটিতে ইরানের সহযোগিতা ছিল চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মতোই।
কিন্তু তা এখন ইতিহাস। সম্প্রতি ভারতে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত আলী চেগেনি দুঃখ করে বলেছেন যে মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ভারত কেবল ইরান থেকে তেল আমদানিই হ্রাস করেনি, সেইসাথে চাবাহার প্রকল্পের কাজও মন্থর করে দিয়েছে। উত্তেজনা প্রকাশ্যেই দেখা যাচ্ছে। জম্মু ও কাশ্মির পরিস্থিতিতে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে।
অথচ এই ইরানই ১৯৯৪ সালে জম্মু ও কাশ্মিরের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ওআইসি প্রস্তাব জাতিসঙ্ঘ ফোরামে উত্থাপন রুখে দিয়েছিল। ইরানের এই অবস্থানের ফলে ওআইসিতে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হতে পারেনি। তাছাড়া ইরান বলেছিল যে কাশ্মির হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় ইস্যু।
এই ইরানই ’৯০-এর দশকে জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলের শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা থেকে পাকিস্তানি মদতপুষ্ট বিদ্রোহ নির্মূলে সহায়তা করেছিল। ওই সময় অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিদেশী মিডিয়ার জন্য বন্ধ থাকা সত্ত্বেও নরসীমা রাও সরকার ওই সময়ের ভারতে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত শেখ আত্তারকে কারগিল সফরের অনুমতি দিয়েছিলেন।
এই ইরানই ’৯০-এর দশকের প্রথম দিকে গোয়েন্দা পর্যায়ে ভারতের সাথে সহায়তা করেছিল।
তাহলে বর্তমান সঙ্কটকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? সংক্ষেপে বলা যায়,, ইসরাইল-সৌদি-সংযুক্ত আরব আমিরাতি প্রভাবে পড়েছে ভারতের পারস্য উপসাগরীয় নীতি। ভারতীয় কূটনীতি এক দিকে ইরানের সাথে সম্পর্ক এবং অন্যদিকে ইসরাইল-সৌদি-আমিরাত ত্রিভূজ সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন এলিটরা ওই নীতি ত্যাগ করে ত্রিভূজের সাথে নিজেদের সমন্বিত করার চেষ্টা করছে।
বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এই পরিবর্তনকে উৎসাহিত করছে। কিন্তু আসল কারণ বিরাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকেন্দ্রিক রাজনীতিতে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে মোদির ৫ দিনের ইসরাইল সফরের পর থেকেই ইরান-ভারত সম্পর্কে অবনতি হতে থাকে।
ইরানের ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘বি’ টিমের দিকে দিল্লির এগিয়ে যাওয়ার কারণেই ভারত-ইরান সম্পর্কে ভাটা পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল বা সৌদি আরবসহ পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক রক্ষার পথে ইরান কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তবে নির্জলা সত্য হলো, দিল্লি স্রেফ ইরানের সাথে সম্পর্কে শীতলতা এনেছে।
ভারতীয় নেতৃত্বে বি টিম কিভাবে কাজ করে তা নিয়ে রহস্যই রয়ে গেছে। তবে ইসরাইল, সৌদি আরব ও আমিরাত তাদের কার্ড বেশ ভালোভাবেই খেলে। তারা জানে, দিল্লিতে কখন কাকে কিভাবে কাজে লাগাতে হবে।
যথার্থভাবেই বলা যায়, বৃহস্পতিবার রুহানির সাথে মোদির বৈঠকটি ছিল সংশোধন প্রয়াস। ইরান থেকে ভারত তেল ক্রয় করত ছাড়কৃত মূল্যে। কিন্তু এখন তারা তেল কিনছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও আমিরাত থেকে, বাজার মূল্যে। বিনিময়ে অন্য কোনো ধরনের সুবিধাও পাচ্ছে না।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক জোরদার করছেন, কাশ্মির ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করছেন। ভারতে বড় ধরনের বিনিয়োগে কোনো আগ্রহ নেই শেখদের। আর নির্বাচনে পরাজিত হয়ে নেতানিয়াহু যদি সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হন, তবে তিনি দুর্নীতির মামলায় বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন। অথচ তিনি ছিলেন বিশ্ব পরিমণ্ডলে মোদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
এমন পরিস্থিতিতে রুহানির সাথে বৈঠক করে ঠিক কাজটিই করেছেন মোদি। বৈঠকের যখন ব্যবস্থা করা হয়, তখন রুহানি বিমানবন্দরে রওনা হচ্ছিলেন। ফলে তার হাতে সময় ছিল কম। তার এবিসি নিউজকে সাক্ষাতকার দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারপরও মোদির বৈঠক করার অনুরোধে সময় বের করে নেন।
বর্তমানে ভারতের বেশি বন্ধু নেই এবং ইরান অন্যতম। মুসলিম বিশ্বে মোদি সরকারের ইমেজ খুবই খারাপ। ভারতের হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে যাত্রা এবং জম্মু ও কাশ্মিরে অচলাবস্থা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খারাপ অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
এমনকি রাশিয়ার মতো সময়োত্তীর্ণ মিত্ররাও আমাদের ‘চানক্য’ কূটনীতিতে মোহভঙ্গের শিকার হয়েছে। ভারত আর কত দিন পরস্পর বিপরীত নীতি অবলম্বন করবে? নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। মোদি-রুহানি বৈঠকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বই ফুটে ওঠেছে।
মনে হচ্ছে ইরানের সাথে সম্পর্কে যে অবনতি হয়েছে, তা মেরামতে অনেক কাজ করতে হবে। তবে রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকলে তা সহজেই হতে পারে। ভারতকে খুবই গুরুত্ব দেয় ইরান, দিল্লির প্রয়োজন প্রতিদান দেয়া। পারস্পরিক কল্যাণে সম্পর্ক বিনির্মাণের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস