পাটপাতার চা
পাটপাতার চা - ছবি : সংগ্রহ
পাটপাতা থেকে চা, বিষয়টা অবাক হওয়ার মতো হলেও বাস্তবে তাই ঘটছে। একসময় ব্রিটিশ বেনিয়ারা বাঙালি জনগোষ্ঠীকে চায়ের অভ্যাস করাতে ফ্রি পান করাত। সেই চা এবার বিদেশে রফতানি করবে বাংলাদেশ। তবে এটা বিদেশীদের শেখানো সেই চা নয়। এটি বাংলাদেশে উদ্ভাবিত বিশ্বের প্রথম পাটের পাতা থেকে তৈরি জৈবপানীয় (চা)।
একটা সময় পাটের পাতা শুধু শাক হিসেবে খাওয়া হতো। কিন্তু তা থেকে তৈরি হচ্ছে চা, যা রফতানি করে আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রাও। এই চা বাজারজাত করতে মানিকগঞ্জের পুটাইল ইউনিয়নের লেমুবাড়িতে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প নিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশে পাট ‘সোনালি আঁশ’ হিসেবে পরিচিত। একসময় পাটই ছিল বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান পণ্য। পাটের আঁশের সেই সোনালি অতীত না থাকলেও পাটের পাতা তৈরি করেছে এক নতুন সম্ভাবনা। পাটপাতা শাক হিসেবে খাওয়ার প্রচলন বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু এই পাটপাতা থেকে ‘চা’ উৎপাদন শুরু হয়েছে। এখন ছোট করে এই উৎপাদন চললেও বড় আঙ্গিকে উৎপাদনের জন্য কারাখানা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এই চায়ের স্বাদ একদম গ্রিন টি’র মতো। আর দামও হবে সাধারণ চায়ের মতোই।
বাংলাদেশ জুটমিলস, করপোরেশন ও ইস্টারট্রপ, জার্মানির যৌথ উদ্যোগে মানিকগঞ্জে তৈরি হচ্ছে পাটপাতার চা। পাটপাতার চা স্বাভাবিক চায়ের চাইতে উন্নতমানের ও সুস্বাদু। প্রাথমিক পর্যায়ে পাতা সংগ্রহ ও শুকানোর প্রক্রিয়া চলে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার পুটাইল ইউপির লেমুবাড়ি এলাকায়। পরের প্রক্রিয়া চলে ঢাকায়। কিছু দিনের মধ্যে লেমুবাড়িতেই চালু হবে চা তৈরির পুরো প্রক্রিয়া। আর এখান থেকে উৎপাদিত চা সরাসরি যাবে দেশ পেরিয়ে বিদেশে। এরই মধ্যে আড়াই টন চা জার্মানিতে রফতানি করা হয়েছে। পরবর্তীকালে হয়তো দেশেও পাওয়া যাবে এই পাটপাতার চা। পাটপাতার চায়ে কিছুটা গন্ধ থাকে। লেবু, আদার ফ্লেভারেও এই চা তৈরি হচ্ছে।
কথা হয় পাটপাতা থেকে জৈবপানীয় তৈরির পরীক্ষামূলক প্রকল্পের পাটচাষি সমন্বয়কারী আবদুল আলীমের সাথে। তিনি জানান, বাংলাদেশ জুটমিলস করপোরেশন ও ইস্টারট্রপ, জার্মানির যৌথ উদ্যোগে পাটপাতা থেকে পানীয় তৈরির প্রকল্প পরিচালনা করছে। এদের উদ্যোগে ২০১৬ সালে লেমুবাড়ির নতুন হাটের মো: আইয়ুব আলীর ৪০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে পাটপাতা দিয়ে চা তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শুরু করা হয়। কাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, কাঁচা পাটপাতার জন্য লেমুবাড়ি চর এলাকায় এক হাজার ৯১৮ শতাংশ জমিতে পাট চাষ করেছেন। স্বাভাবিক চাষের মতোই এ পাট চাষ করা হয়। পাট বোনার ৬০ থেকে ৬৫ দিনের মধ্যে এ গাছ যখন ছয় থেকে সাত ফুট লম্বা হয়, তখন আগা কাটার উপযোগী হয়। তখন পাটগাছের দৃই থেকে আড়াই ফুট করে আগা কেটে এনে একটি বড় শেডের নিচে রাখা হয়।
আবদুল আলীম আরো জানান, পাটের আগা কাটার জন্য ১৩ জন পুরুষ শ্রমিক রয়েছেন। এদের পারিশ্রমিক দেয়া হয় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জনপ্রতি ৩৫০ টাকা। এরপর ওই পাটের আগা থেকে পাতা ছেঁড়ার জন্য নারী শ্রমিক রয়েছেন ৩৫ জন। এদের পারিশ্রমিক দেয়া হয় প্রতি কেজি পাতায় ১০ টাকা করে। তারা প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ কেজি করে পাতা ছিঁড়েন। এরপর কাঁচা পাতাগুলো মাচার ওপর রেখে শুকানো হয়। রোদ থাকলে তা শুকাতে দু-তিন দিন লাগে। শুকনো পাতা বস্তাবন্দী করে যত্নে রাখা হয়। পরে ঢাকা থেকে লোক এসে শুকনো পাতা নিয়ে যায়। এরপর বিজেএমসির তত্ত্বাবধানে চা তৈরি চলে ঢাকায়। মানিকগঞ্জে ১৪ জন স্টাফ রয়েছেন। তারা সার্বক্ষণিক কাজের তদারকি করেন।
কিছু দিনের মধ্যেই মানিকগঞ্জের এই লেমুবাড়ি এলাকায় চা তৈরির সব কার্যক্রম চালু করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। চাষের জায়গা ও অন্যান্য কাজের জন্য জমি সংগ্রহ করা হচ্ছে। চা তৈরির সব যন্ত্রপাতি কয়েক দিনের মধ্যেই এখানে এনে স্থাপন করার কাজ শুরু হবে। পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী এসে এর উদ্বোধন করবেন বলে তিনি জানান। সব কিছু মিলিয়ে এই এলাকায় শুরু হবে বড় ধরনের কর্মযজ্ঞ। এই শিল্পের সাথে যুক্ত হবেন অনেক বেকার যুবক, শ্রমিকসহ স্থানীয় মানুষ। ভালো সড়ক ও নৌ যোগাযোগ থাকার কারণে এখানে গড়ে উঠবে নানা ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। অদূর ভবিষ্যতে এ এলাকা আয়ের একটি উৎসক্ষেত্র হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা।
নারী শ্রমিক জাহানারা বেগম বলেন, অভাবের সংসারে ছেলে-সন্তান নিয়ে একা সংসার চালানো স্বামীর পক্ষে কষ্টসাধ্য। তাই বাড়িতে বসে না থেকে প্রতিদিন এখানে পাটপাতা ছেঁড়ার কাজ করি। এতে প্রতিদিন দু-তিন শ’ টাকা করে পাই। তা সংসারে খরচ করি।
বাংলাদেশ জুটমিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) জুট লিভস ড্রিংক প্রজেক্টের উপদেষ্টা এইচ এম ইসমাইল খান এই চায়ের উদ্ভাবক। তিনি জানান, পাটের পাতা থেকে চা উদ্ভাবন বিশ্বে এটাই প্রথম। এর মাধ্যমে বিশ্ব নতুন এক বাংলাদেশকে দেখতে পাবে। এই চা পানে মানবদেহের ডিএনএ ক্ষয় রোধ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষা ও কোলেস্টেরল হ্রাস করবে। এখনো এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
তোষা পাটের পাতার এই চা স্বাদে ভালো। তবে দুধ মিশিয়ে এই চা পান করা যাবে না। ভেজষ গুণ থাকায় পাট চায়ের রয়েছে নানা উপকার। রফতানি বৃদ্ধির পাশাপাশি দ্রুত দেশের বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করছে বিজেএমসি। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে পাট চায়ের জিআই সনদের জন্য আবেদনের কথাও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। উৎপাদন বাড়াতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি পাটের সোনালি ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা বলেন, এখানে চা শিল্প কারখানা গড়ে উঠলে অনেক বেকার যুবক ও শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হবে। তা ছাড়া, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার সাথে সড়ক ও নৌপথে যোগাযোগ ভালো থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে।
প্রাচীনকালে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ফিলিপাইন ও মিসরে রোগ নিরাময়, রোগ প্রতিরোধ এবং রোগীর শিগগিরই আরোগ্য লাভের জন্য পাটপাতার নির্যাস ও স্যুপ নিয়মিত ব্যবহার হতো। খ্রিষ্টপূর্ব ছয় হাজার বছর অগেও পাটপাতা রোগ নিরাময় ও সৌন্দর্য চর্চায় ব্যবহার হতো। জানা গেছে, এখন জেসমিন, রোজি, লেমন গ্রাস ও জিনজার রোজ- এই চার ফ্লেভারের পাটপাতার চা উৎপাদন করা হচ্ছে।
একসময় সোনালি আঁশ খ্যাত পাট ছিল এ দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। পাটের সেই সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাটকে নানাভাবে ব্যবহার করে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হচ্ছে, যার ধারাবাহিকতায় পাট ও চা শিল্পে যোগ হচ্ছে পাটপাতার চা। এতে পাট ও চা শিল্প সমুদ্ধ হবে। বিদেশে রফতানির মাধ্যমে সোনালি আঁশের অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে।