সিসির বিরুদ্ধে কেন মাঠে নামছে মিসরীয়রা

মাসুম খলিলী | Sep 26, 2019 04:51 pm
সিসির বিরুদ্ধে কেন মাঠে নামছে মিসরীয়রা

সিসির বিরুদ্ধে কেন মাঠে নামছে মিসরীয়রা - ছবি : সংগ্রহ

 

মিসরে সিসির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামাকে যখন মৃত্যু-সমতুল্য কাজে পরিণত করা হয়েছে, ঠিক সে সময় দেশটির বিভিন্ন শহরে অব্যাহত বিক্ষোভের নতুন কোনো বার্তা রয়েছে কি না তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সেনাপ্রতিষ্ঠানের সাথে দেড় দশক ধরে কাজ করা এক বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী ও অভিনেতা মোহাম্মদ আলী জেনারেল সিসির বিরুদ্ধে বিলাসবহুল বাড়ি এবং হোটেলে কোটি কোটি টাকা অপচয় করার অভিযোগ এনে অনলাইনে বেশ কয়েকটি ভিডিও পোস্ট করেন। সিসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাক দেন স্পেনে স্বেচ্ছাপ্রবাসী এই আবাসন ব্যবসায়ী। ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, লাখ লাখ মিসরীয় নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। খরচ কমানোর নামে ভর্তুকি তুলে দিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হয়েছে। আর সিসি তার সুবিধার জন্য কোটি কোটি টাকা অপচয় করছেন।

এসব ভিডিও বার্তার অভিযোগ খণ্ডন করে বক্তব্য রাখেন খোদ সিসি। অভিযোগকে ‘মিথ্যা ও বানোয়াট’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। সিসি প্রথমে এ সেনাপ্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার ব্যবসায়ীকে মুসলিম ব্রাদারহুড বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার জীবন কাহিনীতে ইসলামিস্ট হওয়ার কোনো উপকরণ না পেয়ে তাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয় নারীলোভী হিসেবে। সে প্রচেষ্টায়ও হালে পানি না পাওয়ায় ট্রাম্পের কাছে ধরনা দিয়েছেন মিসরের জেনারেল কাম-প্রেসিডেন্ট সিসি। ট্রাম্প অবশ্য তাকে পিঠ চাপড়ে ‘রিয়েল লিডার’ হিসেবে সার্টিফিকেট দিতে কসুর করেননি। এরপরও উদ্বেগমুক্ত হতে পারছেন না আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসি নামের ‘নব্য ফেরাউন’ খেতাবপ্রাপ্ত এই ব্যক্তি।

তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন হলো, নতুন ঘটনার রহস্য কোথায়? ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের মধ্যপ্রাচ্য নীতিবিষয়ক কেন্দ্রের গবেষক খালিদ এলজিনদি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সামাজিক মাধ্যমে বিক্ষোভের ছবি দেখে মিসরীয় পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে তিনি অস্বস্তিবোধ করছেন। ছোট্ট আকারে হলেও কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ হচ্ছে। এমন একটি সরকারের শাসনামলে এই বিক্ষোভ হচ্ছে, যখন ভিন্নমতের প্রতি শূন্য সহনীয় নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে।’

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্যের পরিচালক সারাহ লিহ উইটসনের মূল্যায়ন অনুসারে, ‘সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে লোকজন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। এটি মিসরের ভয়াবহ পরিস্থিতিকেই তুলে ধরছে।’
মিসরে এমন এক সময় এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে অবস্থান করছেন মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। রওনা দেয়ার আগে টুইটারে গণতন্ত্রপন্থী আইয়াদ আল-বাগদাদী বলেন, ‘হেই, ডোনাল্ড ট্রাম্প, আপনার প্রিয় একনায়ক এখন নিউ ইয়র্কের পথে। তাকে সেখানেই রাখেন। তিনি ফিরে আসুক, মিসরীয়রা সেটি চান না।’ ট্রাম্প অবশ্য তাকে সেরা লিডার হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং সিসির কাজকর্মকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু সমস্যা হলো, ট্রাম্পের সকালের কথা বিকেলে ঠিক থাকে না।

ইসরাইলের সাথে সীমান্তঘেঁষা সাড়ে ৯ কোটি মানুষের এই দেশে নমনীয় বা মধ্যপন্থী যে ধরনেরই হোক না কেন, ইসলামিস্ট উত্থানের ব্যাপারে ইসরাইল ও তার মিত্ররা বিশেষভাবে আতঙ্কিত ছিল। আরব বসন্তের পথ ধরে হোসনি মোবারকের পতনের পর অবাধ নির্বাচনে ব্রাদারহুডের নেতা ড. মুরসি প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মিসরীয় প্রেসিডেন্ট হলে তার পতন ঘটানোর জন্য কার্যক্রম শুরু করা হয় সে দিন থেকেই। ইসরাইল ও সৌদি নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় দেশগুলোর বেশির ভাগ মিসরীয় ডিপ স্টেটের সাথে মিলে কাজ শুরু করে। আর সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এর বাস্তবে রূপান্তর করতে এক বছরের মতো সময় প্রয়োজন হয়।

এরপর নির্মমভাবে ইসলামিস্ট দমন করার কাজে সিসি তার পূর্বসূরি সামরিক একনায়কদের রেকর্ড এমনভাবে ভাঙতে সক্ষম হন যে, ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলো তার প্রশংসায় ‘স্ট্রং ম্যান’ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। রাবাহ স্কোয়ারে এক দিনেই হত্যার শিকার হয় সহস্রাধিক ব্যক্তি। ব্রাদারহুডের একজন সাবেক প্রধান এবং দেশটির একমাত্র নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি কারাগারেই শারীরিক-মানসিক নির্যাতনে মৃত্যুর শিকার হন। ৬০ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে বন্দী করে নির্মমভাবে নির্যাতন চালানো হয়। ব্রাদারহুডের প্রধান ড. মুহাম্মদ বদিসহ প্রায় পৌনে এক হাজার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মুরসির মতোই চিকিৎসাহীন অবস্থায় ড. বদি নির্জন সেলে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন।

মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রধান ড. মোহাম্মদ বদির জেল খাটার ইতিহাস ৫৪ বছর আগেকার। ১৯৬৫ সালে ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের দমন অভিযান চালানোর সময় যুবক বয়সে তাকে প্রথম বন্দী করা হয়। পরের বছর নাসের সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্রাদারহুডের একাধিক নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, যাদের মধ্যে সাইয়্যেদ কুতুবও ছিলেন।

অন্যরা দীর্ঘকালীন কারাভোগের সাজা পেয়েছিলেন। তখন ব্রাদারহুডের একজন উল্লেখযোগ্য মহিলা সদস্য ছিলেন, যয়নব আল-গাজালী; তিনি ব্রাদারহুডের শীর্ষস্থানীয় পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং হাজার হাজার ছাত্র-যুবক তার বক্তৃতা শুনতেন। গাজালী ‘ফেরাউনের প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে প্রকাশিত তার কারাগারের স্মৃতিচারণে ১৯৬৫ সালে গ্রেফতারের পরে মিসরীয় সরকারের বর্বরতার জীবন্ত বিবরণ দেন। এ সময় তার অনেক ছাত্রকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে সামনে এনে তাকে দোষী করার জন্য বলা হতো। জীবনকে হুমকির সম্মুখীন করার পরও তারা সবাই সেটি প্রত্যাখ্যান করে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ব্রাদারহুডের বর্তমান মুরশিদে আ’ম ড. বদি। তখন ১৫ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল তাকে। নাসেরের মৃত্যুর পরে আনোয়ার সাদাত নতুন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সাধারণ ক্ষমার আওতায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়।

মধ্যপ্রাচ্যে নিযুক্ত সাবেক সিআইএ এজেন্ট রবার্ট বায়ারের একটি মন্তব্য মিসরের কারাগারের অবস্থা বোঝার জন্য যথেষ্ট। আমেরিকা কিভাবে মিসরকে ব্যবহার করেছে তার ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আপনি কোনো বন্দীকে গুরুতরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান, তবে সেই বন্দীকে জর্দানে পাঠান। আর আপনি যদি তাকে নির্যাতন করতে চান তবে সিরিয়ায় পাঠান। আর যদি আপনি চান যে তার সাথে আর কখনো যেন দেখা হবে না তাহলে আপনি তাকে মিসরে পাঠান।’

লিবিয়ার সন্দেহভাজন আলকায়েদা কর্মী আলি আল-ফখেরি ওরফে ইবনে আল শায়খ আল-লিবিকে সিআইএ হোসনি মোবারকের গোয়েন্দা প্রধান ওমর সুলেমানের অধীনে মিসরে নির্যাতনের জন্য পাঠিয়েছিল। লিবি সেখানে ‘স্বীকার করেন’ ইরাক রাসায়নিক অস্ত্র সংগ্রহ করছিল এবং সেগুলো আলকায়েদার হাতে দিয়েছিল। এই মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল এবং ইরাক আক্রমণের মূল যুক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ‘গোয়েন্দা তথ্য’।

ব্রাদারহুডের ওপর জেনারেল সিসির বর্তমান দমন অভিযানে সন্তুষ্ট সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলো (কাতার ছাড়া) সিসির শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য অকাতরে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়। গোয়েন্দা সহায়তা ও আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহ করে দেয়ার কাজটি করে ইসরাইল। সিসির নিষ্ঠুর অপশাসনে শীর্ষ পশ্চিমা দেশগুলোও সরব-নীরব সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়ায়। এভাবে জেনারেল সিসি সেনাপ্রতিষ্ঠান ও মিসরীয় ডিপ স্টেটের পূর্ণ সমর্থন আর আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সহায়তায় নিজের প্রশাসনকে সুসংহত করার সুযোগ লাভ করেন। এটি করতে গিয়ে তিনি ইসলামিস্ট দমন করার পাশাপাশি সিসি-বিরোধী সেকুলারিস্ট, সোস্যালিস্ট, লিবারেল ডেমোক্র্যাট নির্বিশেষে সবাইকে নিশ্চিহ্ন করার কাজটি শুরু করেন নিজের শাসনকে চ্যালেঞ্জমুক্ত করতে। মুরসির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটাতে যে আল-বারাদি, আহমদ শফিক, হামাদির সহায়তা তিনি গ্রহণ করেছিলেন; পরে তাদের কাউকে জেলে কাউকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। ফলে ইসলামিস্টদের সাথে সাথে যেসব পাশ্চাত্যবাদী লিবারেল সেকুলারিস্ট শক্তিকে পশ্চিমা দেশগুলো পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছিল, তারাও মিসরীয় মাটিতে পা ফেলার সুযোগ হারাতে থাকে। একই সাথে দেশটির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পরিবর্তে ক্রমাগতভাবে প্রাণহীন করে ফেলেন সিসি।

অতীতের রেকর্ড ভাঙা দারিদ্র্যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে মিসরে। তার ৬ বছরে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ৩২ শতাংশে উন্নীত হয়। রাজধানী স্থানান্তর ও সুয়েজ খাল সম্প্রসারণ প্রকল্পে প্রচুর বিদেশী সহায়তার অর্থ খরচ করেও কর্মসংস্থানে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেননি সিসি। তিনি দু’টি দ্বীপ উপঢৌকন দিয়েছেন সৌদি আরবকে। নিজের প্রাসাদ নির্মাণে বিপুল অর্থব্যয় রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন তার এখনকার প্রধান প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী।

মোহাম্মদ আলীর ডাকে সিসি-বিরোধী যে বিক্ষোভ হচ্ছে তার তাৎপর্য কতখানিÑ এ প্রশ্নটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি হিসেবে আলী তেমন পরিচিত কেউ নন। কিন্তু তিনি এক সময় মিসরীয় ক্ষমতার বলয়ের একজন ছিলেন বলে মনে হয়। সম্ভবত তিনি যে আন্দোলন সংগ্রামে মিসরীয়দের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন তা তার একক কোনো উদ্যোগ নয়। এর কিছুটা আভাস পাওয়া যায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ জাকির প্রতি সিসিকে গ্রেফতার করার আহ্বানে। তার ডাকে কায়রোর তাহরির স্কোয়ারসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে যে বিক্ষোভ হয়েছে, তা ২০১১ সালের আরব জাগরণের আন্দোলনের তুলনায় হয়তো বড় কিছু নয়। কিন্তু আন্দোলনের এটি শুরু বলেই মনে হচ্ছে। ফলে এর শেষ গন্তব্য কোথায়, সেটি বলার সময় সম্ভবত এখনো আসেনি।

এবারের বিক্ষোভের বিশেষ দিক হলো মিসরের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা নাগরিকদের রাস্তায় নেমে এবং আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটাতে বলেছেন। মিসরীয় সশস্ত্রবাহিনীর সাবেক চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল সামি আনানের অনুগত মিসর অফিসার্স ফ্রন্ট বলছে, তারা বিক্ষোভকারীদের সুরক্ষা দেবে। ফেসবুকে এই গোষ্ঠীটি বলছে যে, ২৫ জানুয়ারি হোসনি মোবারকের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরের মতো, সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের রক্ষা করবে। সামি আনানের সরকারি মুখপাত্র হিসেবে ড. মাহমুদ রেফাতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং তথ্যের জন্য প্রত্যেককে তার সাথে যোগাযোগ করার আহ্বান জানান হয়েছে। রেফাত বলেছেন, তিনি যে সব অফিসার বিক্ষোভকারীদের সুরক্ষা দেবেন তাদের নাম প্রকাশ করবেন এবং তাদেরকে মিসরীয় সেনাবাহিনীর সম্মানিত অফিসার বলে অভিহিত করবেন।

জেনারেল সিসিকে দিয়ে মিসরে যে কাজ করানো হয়েছে তা অনেককে দিয়ে সম্ভব হতো না এ কথা যেমন ঠিক, তেমনিভাবে মিসরীয় সমাজ কাঠামো ও অর্থনীতির যে অরাজক এক অবস্থা তার আমলে তৈরি রয়েছে তার নিরসনও তাকে ক্ষমতায় রেখে সম্ভব নয়। এ বক্তব্যটি মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে যখন আসছিল তখন এটাকে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকেরা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এ বক্তব্য এখন আসছে তাদের মিত্রশক্তি থেকেও। ফলে ট্রাম্প সিসিকে নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা দিয়ে মিসরের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা যাবে না। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রতি সিসিকে গ্রেফতার করে ক্ষমতা নেয়ার জন্য মোহাম্মদ আলীর আহ্বান এ দিক থেকে বিশেষ গুরুত্ব রাখে।

মিসরের রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে হলে মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক অবস্থা সামনে রাখতে হবে। ইসরাইলে ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অধিক আসনে জয়ী হতে পারেননি। অথচ তিনি নির্বাচনী প্রচারের সময় জর্দান উপত্যকা ও পশ্চিম তীরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে ইসরাইলের পূর্ণাঙ্গ দখল কায়েমের কথা বলেছিলেন। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রসত্তাকে বিদায় করে ট্রাম্পের তথাকথিত শান্তি ফর্মুলার প্রধান কারিগর তিনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নেতানিয়াহু ইসরাইলের আরেক মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। মধ্যপন্থী নীল-সাদা জোটের প্রধান বেন্নি গানজ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে হচ্ছে। সেটি হলে ইসরাইলের কট্টর নীতি কিছুটা হলেও নমনীয় হবে। তিনি আরব-ইসরাইল সমঝোতার কথা নির্বাচনের আগে বলেছেন।
ইসরাইলের পরিবর্তনের একটি প্রভাব কমবেশি মিসরে পড়বে। সমঝোতার সম্ভাবনা এগিয়ে নিতে হলে মিসরে এখন যে কট্টর স্বৈরাচার চলছে, তার পরিবর্তন এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে কার্যকর হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আর সেটি করতে হলে সিসির বিদায়ের কথাই ভাবতে হবে।

মিসরীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক শক্তি হলো সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। সৌদি আরবের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে টিকে আছে সিসি সরকার। সে সমর্থন এখনই উঠে যাবে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। তবে তাদের কাছেও ব্যক্তি সিসির গুরুত্ব কমে যাচ্ছে বলে মনে হয়। ড. মুরসির কাছে নির্বাচনে হেরে যাওয়া আহমদ শফিক ছিলেন আমিরাতের মোহাম্মদ বিন জায়েদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি আমিরাত থেকে ফিরে এসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে চাইলে তাকে জেলে পাঠান সিসি। অন্য দিকে এত সহায়তার পরও ইরানের সাথে সিসির এক ধরনের যোগাযোগ বজায় রাখার বিষয়টি মোহাম্মদ বিন সালমান সব সময় সন্দেহের চোখে দেখেন।

সিসির যেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকে, সেখানে তিনি মিত্রশক্তির স্বার্থের কানাকড়ি মূল্য দেন না। কেবল তার মাতৃকুলের পূর্বপুরুষ ইহুদিদের রাষ্ট্র ইসরাইল হলো এর ব্যতিক্রম। তার এই নীতিটি তাকে কিছুটা হলেও শক্তির ভরকেন্দ্রগুলোর সাথে দূরত্ব তৈরি করেছে। জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের পাশাপাশি ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের এই দূরত্ব সিসির বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দিলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।

মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলজুড়ে পরিবর্তনের জন্য নির্ণায়ক হিসেবে জনপ্রিয় প্রতিবাদ পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে। এটি সুদান এবং আলজেরিয়ায় একনায়কের পতন ঘটিয়েছে। দুই দেশেই আন্দোলনকারীরা অতীতের ব্যর্থ অভ্যুত্থান থেকে শিক্ষা নিয়েছে। আর এখন অবধি সেনাবাহিনীর কাছে বিপ্লবের ফলকে সমর্পণ না করেই অন্তর্বর্তী সময়ে আন্দোলনকারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। এটি মিসরের ঘটনায়ও প্রভাব ফেলতে পারে। মিডল ইস্ট আইয়ের সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট যথার্থই বলেছেন, ‘ছয় বছর শীতের পরে আরব বসন্ত আবার শুরু হয়েছে। এটি একটি ধীর গতিময়, তবে এইবার, মনে হয়, অচলাবস্থা আসবে। এটি কি সিসির জন্য শেষ পর্দা হবে? হ্যাঁ এটি তার চূড়ান্ত খেলাতে পরিণত হতে পারে।’

mrkmmb@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us