সিসির পতন হবে এবার?
আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি - ছবি : সংগ্রহ
মিসরীয় একনায়ক প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসির অপসারণের দাবিতে রাজধানী কায়রোসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, অনলাইনে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভের আহ্বান জানানো হয়েছিল। সিসির শাসনাধীন ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের কারণে মিসরে এ রকম বিক্ষোভের ঘটনা একেবারেই বিরল বলা চলে।
এই বিক্ষোভে লোকজন এসে আরব বসন্তের কেন্দ্রস্থল তাহরির স্কয়ারে জড়ো হন। ২০১১ সালে এখান থেকে শুরু হওয়া প্রতিবাদে দেশটির সেই সময়ের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতন ঘটেছিল। এ ছাড়াও, বিভিন্ন শহরে রাতের নীরবতা ভেঙে রাস্তায় নেমে পড়েন সিসির নিপীড়নে ক্ষুব্ধ লোকজন। দেশটির একনায়ক প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসির শাসনামলে এটিই প্রথম কোনো গণবিক্ষোভ।
মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ২০১৩ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন তখনকার সেনাপ্রধান আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি। এরপর বিরোধীদের প্রতি তিনি সব ধরনের দমনাভিযান চালিয়েছেন। ষাট হাজার ভিন্নমতাবলম্বীকে তিনি কারাগারে ঢুকিয়েছেন। অনেকের বিচার চলছে। গত ১৭ জুন বিচার চলাকালে আদালত কক্ষে আকস্মিক পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন মোহাম্মদ মুরসি। তার মৃত্যুকে সম্পূর্ণ হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করেছে মুসলিম ব্রাদারহুড। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, কারাগারে তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তার সংগঠনকে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হিসেবে কালোতালিকাভুক্ত করেছেন আল-সিসি। ক্ষমতা দখলের পর থেকেই সব ধরনের গণবিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেন সিসি। ২০১৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী শত শত বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেন তিনি।
গত ২০ সেপ্টেম্বর দীর্ঘদিন পর রাতের নীরবতা ভেঙে হঠাৎ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন মিসরীয়রা। তারা স্লোগান দিতে থাকেন, ‘সিসি, তুই ক্ষমতা ছাড়’। কিন্তু এই বিক্ষোভের পেছনে কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা সঙ্ঘবদ্ধতার চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়াই বড় ভূমিকা রেখেছে।
স্পেনে নির্বাসিত মিসরীয় ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী গত ১৭ সেপ্টেম্বর সিসি প্রশাসনকে আলটিমেটাম দিয়ে বলেছিলেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে যদি স্বৈরশাসক সিসি পদত্যাগ না করেন, তবে শুক্রবার মিসরীয়রা তাহরির স্কয়ারে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করবেন। মিসরের যে নির্বাসিত ব্যবসায়ী এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছে তার নামেই আরবি মিডিয়াগুলো এবারের আন্দোলনের নামকরণ করছে। এ বিক্ষোভটিকে তারা বলছে ‘সাউরাতু মোহাম্মদ আলী’। তবে আন্দোলনের ক্ষেত্রে একজন সচেতন অনলাইন একটিভিস্ট হিসেবেই তার পরিচয়টা মুখ্য হয়ে উঠেছে। দেশের স্বার্থে স্বৈরশাসকের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামার ডাক দিয়েছেন তিনি।
প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছিল যেভাবে
গত ২ সেপ্টেম্বর একটি ভিডিও আপলোডের মাধ্যমে ঘটনার সূত্রপাত করেন মোহাম্মদ আলী। ওই ভিডিওতে তিনি প্রশাসন ও সরকারে বিভিন্ন স্তরে থাকা কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরে সে সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। দীর্ঘ ১৫ বছর মিসরে একজন মিলিটারি ঠিকাদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন মোহাম্মদ আলী। সে কারণে অভ্যন্তরীণ অনেক দুর্নীতির ব্যাপারে অবগত তিনি। দেশ গণতান্ত্রিক হলেও অঘোষিতভাবে সেনাশাসনই চলছে মিসরে। তাই অনেক সেনাকর্মকর্তা ও জেনারেল সিসির কাছের লোকদের বিরুদ্ধে জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে ফাইভ স্টার হোটেল আর ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার যে অভিযোগ মোহাম্মদ আলী দাঁড় করায় তাতে সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে থাকে।
এরপর মোহাম্মদ আলী সোস্যাল মিডিয়াতে ধারাবাহিক হতে শুরু করেন। পরের ভিডিওগুলোতে বিগত ছয় বছরের আরো যে ইস্যুগুলো নিয়ে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলো নিয়েও প্রতিবাদ জানাতে থাকেন তিনি।
তার দাবিগুলোর মধ্যে ছিল- মিসরের চরম অর্থনৈতিক মন্দা, রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে সানাফির ও তিরান দ্বীপ বিক্রি করে দেয়া, ইসরাইলের স্বার্থরক্ষায় জাতীয় স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য না রেখে সিদ্ধান্ত নেয়া, রাজনৈতিক বন্দি ও গুমের রেকর্ড তৈরি করা, এককভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসা, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা।
এতদিন ধরে এসব দুর্নীতির কোনো বিষয় নিয়েই কোনো ধরনের প্রতিবাদের সুযোগ পায়নি মিসরীয় জনগণ। পুঞ্জীভূত এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ যখন সাহস করে একজন বেসামরিক মানুষ করে দেখালেন, সামরিক কর্তাদের সাথে দীর্ঘ সময় কর্মরত থাকায় তার কথাগুলো জনগণের মধ্যে বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করে। এভাবেই সৃষ্টি হতে থাকে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট।
ঘটনার একপর্যায়ে মোহাম্মদ আলীর কথা আমলে নিতে বাধ্য হন জেনারেল সিসি। একটি অনুষ্ঠানে মিডিয়ার সামনেই রাষ্ট্র পরিচালনায় ত্রুটির কথা কৌশলে স্বীকার করে নেন এ স্বৈরশাসক। কিন্তু এতে মোহাম্মদ আলীর আন্দোলনের পক্ষে জনমত আরো তীব্র হয়ে ওঠে। ১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জেনারেল সিসিকে পদত্যাগের জন্য সময় বেঁধে দেন। অন্যথায় জনগণ ২০ সেপ্টেম্বর আন্দোলনে নেমে পড়বে বলে হুঁশিয়ারি করেন তিনি। এদিনের কর্মসূচিকে ‘জুমুয়াতুল গজব’ (বিক্ষোভের শুক্রবার) বলে অভিহিত করেন মোহাম্মদ আলী।
কর্মসূচি পরবর্তী প্রতিক্রিয়া
স্বেচ্ছায় নির্বাসন গ্রহণ করা মোহাম্মদ আলী বর্তমানে স্পেনে অবস্থান করছেন। দেশের বাইরে থাকার কারণে অনেক অনলাইন একটিভিস্টরা টুইট করেছিলেন, তার এই কর্মসূচি সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তা ছাড়া সিসি সরকার যেভাবে আন্দোলনের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে এতে কর্মসূচির দিন ব্যাপক প্রস্তুতি থাকবে প্রশাসনের।
কিন্তু এত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও শুক্রবার রাত ৮টার পর থেকে তাহরির স্কয়ারসহ রাজধানীর প্রায় চারটি স্পটে মোটামুটিভাবে ও রাজধানীর বাইরে আলেকজান্দ্রিয়া ও মানসুরায় জনগণ সিসির পদত্যাগের দাবিতে বিশাল শোডাউন করে। বিক্ষোভকারীরা নিজেদের প্রোফাইল পিকচারে লাল ছবি দিয়ে রাজপথে নেমে আসে। বিভিন্ন জায়গা থেকে সিসির ছবিসংবলিত ব্যানার নামিয়ে পোড়ায় বিক্ষুব্ধ জনতা। সবার স্লোগান ছিল ‘আশ শা’ব ইউরিদ ইসকাতুন নিজাম’ তথা জনগণ সরকারের পতন চায়। আরো স্লোগান ছিল ‘আমরা যাবো না, এবার সিসি যাবে’।
চলমান বিক্ষোভের কারণে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক মানুষকে আটক করা হয়েছে। আটকদের মধ্যে অনেক মানবাধিকার কর্মীও রয়েছেন। যদিও সরকারের তরফ থেকে আটককৃতদের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। বিক্ষোভের আশঙ্কায় বিভিন্ন শহরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়াসহ বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। এই বিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে গড়ায় সেটিই দেখার বিষয়।