জেনারেল জিয়াউল হকের মৃত্যু! যে ঘটনা এখনো রহস্যাবৃত
জিয়াউল হক - ছবি : সংগ্রহ
৭ আগস্ট, ১৯৮৮। ফোনটা যখন বেজে উঠল, তখন ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন গুন্থার ডিন নয়াদিল্লিতে তার অফিসে একাই ছিলেন।
ফোন কলটা ছিল যুগ্ম সচিব রনেন সেনের। ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর অফিসের স্পর্শকাতর যোগাযোগ ও গোয়েন্দা কার্যক্রম সংক্রান্ত সব বিষয় তিনি দেখাশোনা করতেন।
রনেন ও ডিন ঘুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রায় প্রতিদিনই তারা সমন্বয় বৈঠকে বসতেন।
১৯৮৮ সালের সেই দিনটিতে ডিন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটার কথা ভাবেননি, আর সেদিন রনেনের সাথে তার কোনো বৈঠকের কর্মসূচিও ছিল না।
কিন্তু দিল্লি থেকে ৬৮০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তের ওপারে ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তখন নাটকীয় ঘটনা ঘটে চলেছিল যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার এবং ডিনের নিজের জীবনও চিরকালের জন্য পাল্টে দিতে যাচ্ছিল।
রনেন সেন শান্ত গলায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডিনকে জানালেন যে তিনি এইমাত্র জানতে পেরেছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হককে বহনকারী বিমান পাক ওয়ান বিধ্বস্ত হয়েছে।
ডিন খবরদাতাকে বিশ^াস করতেন, কিন্তু তার মনে হলো খবরটি অবিশ^াস্য, কারণ তিনি ভালো করেই জানেন যে কোনো সন্দেহজনক অবস্থায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হওয়ার অর্থ হলো আরেকটি পাক-ভারত যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা।
কয়েক মিনিটের মধ্যে রনেন সেন ডিনকে নিশ্চিত করলেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর কথা।
২.
৬৪ বছর বয়স্ক, ১১ বছর ধরে পাকিস্তানের ক্ষমতায় থাকা জেনারেল জিয়াউল হক রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৪০০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত বাহওয়ালপুর থেকে ফিরছিলেন। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন বাহওয়ালপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে তেমওয়ালিতে মার্কিন আব্রামস ট্যাংকের মহড়া দেখতে। এদিকে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরনল্ড রাফেল এবং এ অঞ্চলে শীর্ষ আমেরিকান সামরিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারবার্ট এম ওয়াসম ১৫ আগস্ট তেমওয়ালিতে খুন হওয়া এক আমেরিকান নানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে গিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়ার আমন্ত্রণে তারা ট্যাংক মহড়া দেখতে আসেন। আড়াই ঘণ্টা পর ফেরার সময় প্রেসিডেন্ট তার সাথে বাহওয়ালপুর থেকে সি-১৩০ বিমানে ইসলামাবাদ ফেরার জন্য অনুরোধ করলে তারা রাজি হন। এভাবে নিয়তি তাদের একত্রে হঠাৎ মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়।
প্রেসিডেন্ট জিয়াসহ সঙ্গীদের বহনকারী বিমানটি বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে বাহওয়ালপুর থেকে আকাশে ওড়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাতে বিস্ফোরণ ঘটে। বিমানটি বস্তি লাল কামালের পাশে সাটলেজ নদী তীরের কাছে বিধ্বস্ত হয়। এতে জিয়ার সাথে বিমানে থাকা মার্কিন রাষ্টদূত ও একজন বিশিষ্ট মার্কিন ব্রি. জেনারেলসহ পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা ও সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ৩১ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল আখতার আবদুর রহমান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ মোহাম্মদ আফজাল, সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সিদ্দিক সালিক প্রমুখ যারা সবাই ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিশ^স্ত। সে দিন লকহিডের বিশাল সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানটিতে দু’জন পাইলট ছিলেন উইং কমান্ডার মাসুদ হাসান ও কো-পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাজিদ।
সি-১৩০- এর ব্যাকআপ হিসেবে ছিলেন উইং কমান্ডার মুনাওয়ার আলম। চাকলালা বিমান ঘাঁটি থেকে তিনি উড়েছিলেন। এ সময় এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলার (এটিসি) তাকে জানান যে তিনি পাক-ওয়ান বিমানের পাইলটের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। এটিসি ব্রিগেডিয়ার নাসিম খানকে খবর নিতে বলেন। তিনি একটি ফরাসি পুমা হেলিকপ্টারে মুলতান কোর কমান্ডার জেনারেল শামিম আলমকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার নাসিমও যোগাযোগ করতে পারলেন না। এর মধ্যে মুশাক স্কাউট বিমানের পাইলট যে কিছুক্ষণ আগে আকাশে উড়েছিল তার কাছ খেকে ভয়ঙ্কর বার্তাটি আসে, পাক-ওয়ান বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে।
ব্রিগেডিয়ার নাসিম ও জেনারেল শামিম কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে ধোঁয়ার মেঘ উত্থিত হয়েছিল। পরে তিনি ডন পত্রিকার কাছে স্মৃতিচারণে বলেন, আমি প্রথমে ব্রিগেডিয়ার ওয়াসমের ক্যাপ দেখতে পেলাম। তারপর জেনারেল আখতারের ক্যাপ। তারপর আমার চোখ গিয়ে পড়ল কালো মোজা ও কালো জুতা পরা একটি বিচ্ছিন্ন পায়ের ওপর। আমার মনে হল এ পা জেনারেল জিয়ার।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান সিনেটের নেতা গোলাম ইসহাক খান স্বীকার করেন যে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় নাশকতার সংশ্লিষ্টতা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে বিমান ধ্বংস নিয়ে বহুমুখী সন্দেহ মাথাচাড়া দেয়। একটি সরকারি তদন্তে বলা হয় এটা নাশকতা, কিন্তু প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করা হয়নি। পেন্টাগন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমান দুর্ঘটনার কথা নাকচ করে দিয়ে বলে, চার ইঞ্জিনের টার্বোপ্রপ সি-১৩০ বিমানটির উড্ডয়ন ও নিরাপত্তা রেকর্ড ত্রুটিহীন ছিল।
এ সময় জেনারেল জিয়ার পুত্র এজাজুল হক দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে কানাডায় পরিবারের সাথে অবকাশ যাপন করছিলেন। তার সাথে ছিলেন তার স্ত্রীর বড় বোন যার বিয়ে হয়েছিল জেনারেল আখতারের পুত্র গাজী আখতার খানের সাথে। ১৭ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে টেলিফোন বেজে উঠল। জেনারেল জিয়ার এক এডিসি ক্যাপ্টেন পীর মোহাম্মদ এজাজুল হককে জানালেন তার বাবার বিমান নিখোঁজ হয়েছে। এজাজুল হক পারে ডনের কাছে স্মৃতিচারণে বলেন, আসলে তারা খুব ভদ্রভাবে আমাকে খবরটা দিতে চেয়েছিল। এরপর তার মামা ডাক্তার বাশারত এলাহী আসল খবর জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
১৯৮৮ সালের ১৯ আগস্ট মারগালা হিলসে জিয়ার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ১০ লাখ মানুষ এতে সমবেত হন। জনতা ‘জিয়াউল হক- চন্দ্র-সূর্য যতদিন থাকবে ততদিন আপনার স্মৃতিও বেঁচে থাকবে’ বলে স্লোগান দেন। তারপর ফয়সাল মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়। বাংলাদেশ, চীন, ভারত, তুরস্ক, মিসর, ইরানসহ প্রায় ৩০টি দেশের প্রেসিডেন্ট এ সময় উপন্থিত ছিলেন। কবরের ওপর নির্মিত হয় সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত এক সমাধি সৌধ।
৩.
ডিন পরে বলেন, ফোনে কথা বলার সময় সেন তাকে জানিয়েছিলেন যে ভারতের উপগ্রহগুলো জিয়াউল হকের বিমান দুর্ঘটনার শেষ মুহূর্তের ছবি ধারণ করেছে।
প্রকৃত সময়ে পাকিস্তানের স্পর্শকাতর যোগাযোগ আড়ি পেতে শোনার মতো সক্ষমতা সেনের ছিল। তিনি ছিলেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয়কারী। প্রধানমন্ত্রী যখনি চাইতেন তখনি তিনি ব্রিফিংয়ের জন্য তার অফিসে উপস্থিত হতেন।
রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম চার বছরে ভারতের ‘র’ও সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ ব্যাপক পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানি নেতারা জানতেনই না যে সীমান্তের এ পারে শ্রোতারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরের ঘটনাবলি সরাসরি জেনে ফেলছে।
রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদর দফতরে রোপিত ইলেকট্রনিক সার্ভেইলেন্স ইন্টারসেপ্টেড কম্যুনিকেশন্সের মাধ্যমে সেন প্রতি মিনিটের ঘটনাবলি জেনে যাচ্ছিলেন।
বিমান দুর্ঘটনার ভয়াবহ প্রকৃতি ও মরদেহগুলোর সার্বিক বিকৃতির কথা জেনে জিয়ার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বেনজির ভুট্টো একে আল্লাহর গজব বলে আখ্যায়িত করেন।
কিন্তু শিগগিরই এ দুর্ঘটনা আল্লাহর গজব না মানুষের ষড়যন্ত্রের ফল, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াকে বহনকারী বিমানটি মসৃণভাবে আকাশে উড়েছিল ও চার হাজার ফুট উচ্চতায় পৌঁছেছিল। বেশির ভাগ প্রত্যক্ষদর্শী জানান যে, বিমানটি হঠাৎ পাক খেতে শুরু করে এবং মাটিতে ভেঙ্গে পড়ার পর বিশাল ধুলার মেঘ উত্থিত হয়।
তবে কেউ কেউ বলেন, মাঝ আকাশে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায় এবং তারপর বিমানটি শূন্যে পাক খেতে শুরু করে।
কেউই বিশ্বাস করেনি যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও শীর্ষ সামরিক অফিসারদের বহনকারী বিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হতে পারে।
সংবাদপত্রগুলো ইঙ্গিত করল, এটা নাশকতা। কিন্তু কেউই বলতে পারল না যে কিভাবে এই নিখুঁত চক্রান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হলো এবং কে সে যে এ রকম কাজ করতে পারে?
ডিনের কোনো সন্দেহ ছিল না যে এটা আধুনিক কালের একটি ধ্রুপদি হত্যাকাণ্ড।
তিনি তৎক্ষণাৎ অনুধাবন করলেন যে, পাকিস্তানের পরিস্থিতি ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বিশৃঙ্খলা এটাই বলছে যে কেউ একজন পাকিস্তানকে একটা শিক্ষা দেয়ার জন্য দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছে, সম্ভবত তারা একটি নয়া আঞ্চলিক শৃঙ্খলার পথ মসৃণ করতে চায়।
ভারত অবস্থার দ্রুত মূল্যায়ন করছিল।
রাজীব গান্ধী উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হয়েছে, সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। তিনি রনেনকে নির্দেশ দিলেন-
: রাষ্ট্রদূত ডিনকে জিজ্ঞাসা কর তিনি ওয়াশিংটন ডিসি ও ইসলামাবাদ থেকে কী জানতে পেরেছেন।
রাজীব গান্ধীর অফিসে উত্তেজনা বিরাজ করছিল, কারণ কোনো একজন অতি উৎসাহী জেনারেল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের হঠাৎ মৃত্যুর সুযোগে হঠকারিতামূলক কিছু করে বসতে পারেন। এ তো সত্যি যে, প্রেসিডেন্ট জিয়া স্বৈরাচারের তকমা মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি।
যা হোক, ভারতের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ তাদের নতুন সংগৃহীত মহাকাশ যুগের গ্যাজেটের সাহায্যে কৌশলে সীমান্তের ওপারের সব কথাবার্তা শুনতে পেলেও পাকিস্তানের ঘোষণার জন্য তারা অপেক্ষা করছিল।
এদিকে, পাকিস্তানের ঘটনাবলি ডিনকে বিপর্যস্ত করে দিল। সেদিন বিকেলে তিনি উপলব্ধি করলেন যে তার দীর্ঘ বর্ণাঢ্য পেশাদার কূটনীতিক জীবনের শেষ অ্যাসাইনমেন্টে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। নয়াদিল্লিতে তার সাড়ে তিন বছরের অবস্থান, প্রধানমন্ত্রীর অফিসে প্রবেশাধিকার সত্ত্বেও গোটা সময়টাই অপচয় হয়েছে।
রেগে উঠলেন ডিন, বুঝলেন পররাষ্ট্র দফতর ও হোয়াইট হাউসে আরামদায়ক অফিসে অবস্থান করা অদৃশ্য হাতগুলোর দ্বারা তিনি ব্যবহৃত হয়েছেন।
তিনি জরুরি আলোচনা করার জন্য ভাইস প্রেসিডেন্ট এইচ ডব্লিউ বুশ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ শুলজের অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলেন।
স্ত্রী মার্টিন তাকে সতর্ক হতে পরামর্শ দিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি তার যাত্রাও বিলম্বিত করেেত চাইলেন। কিন্তু ভারতে ডিনের তিন বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছিল। তাই কোনো কিছুরই পরোয়া করলেন না তিনি। ১০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লি থেকে বিমানে চড়ে বসলেন। কিন্তু তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাকে সতর্ক করে দিল যে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। বিমানে তার সঙ্গী হয়েছিল একজন সিআইএ এজেন্ট। সে তার প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে নজর রাখছিল।
ডালাস বিমানবন্দরে নামার পর ডিনকে অভ্যর্থনা জানান পররাষ্ট্র দফতরের ইন্টেলিজেন্স ও রিসার্চ ইউনিটের প্রধান মর্ট আব্রামইজ। তিনি ডিনকে বললেন যে তিনি যে সব সাক্ষাতের আবেদন করেছিলেন সেগুলোর সবই বাতিল করা হয়েছে।
এই বিপজ্জনক শীতল অভ্যর্থনার বিষয়টি ডিন ও আব্রামইজের ইতোমধ্যেই জানা হয়ে গিয়েছিল, কারণ কয়েক সপ্তাহ ধরে দিল্লির মার্কিন দূতাবাসের কূটনৈতিক বার্তাগুলো দক্ষিণ এশিয়ার ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা নিয়ে পররাষ্ট্র বিভাগের সাথে একমত হতে পারছিল না। ডিন প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিমান দুর্ঘটনা বিষয়ে সরকারি ভাষ্য বিশ^াস করেননি।
দিল্লিতে বন্ধুদের সাথে বৈঠকের মধ্যে ডিন এই বিমান দুর্ঘটনা বিষয়ে ভারত ও পাকিস্তানের বিপুল পরিমাণ খবর সংগ্রহ করলেন এবং এ সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিমান দুর্ঘটনা কোনো নাশকতার কাজ নয় এবং এটি সাধারণ বিমান দুর্ঘটনাও নয়।
ততদিনে জিয়া বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে ভাষ্য থেকে আমেরিকার সরকারি ভাষ্য দূরে সরে গেছে। এর কারণ ছিল গৌণ।
কূটনৈতিক বিভাগ তাদের সব গুরুত্ব ওই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরনল্ড রাফেলের ট্র্যাজেডির দিকে নিবদ্ধ করেছিল।
আমেরিকান কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের এই ক্ষতির প্রতি গুরুত্ব প্রদর্শন করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ শুলজ ইসলামাবাদে আসেন। তবে ডিন এ ঘটনার পর ছিলেন অক্লান্ত পরিশ্রমী। নয়াদিল্লি থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো তার নোটগুলো এক সঙ্কটের সূচনা করেছিল।
জিয়ার বিমান দুর্ঘটনা ছিল এর আগে সঙ্ঘটিত ধারাবাহিক রহস্যময় ঘটনাগুলোর একটি এবং ডিন এই ধ্বংসকাণ্ডের মধ্যে একটি প্যাটার্ন লক্ষ্য করেন।
তিনি ওয়াশিংটনে আমেরিকার কূটনীতির মূল নেতাদের সাথে মুখোমুখি কথা বলতে চাইছিলেন। কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় সঙ্ঘটিত ঘটনাবলিতে ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত বোধ করছিলেন তিনি। অথচ দিল্লিতে তার অ্যাসাইনমেন্টই ছিল এ ধরনের বিপর্যয় ঠেকানো যার জন্য তিনি তিন বছর ধরে সব পক্ষের সাথে কাজ করেন। কিন্ত ডিন তার বসদের সাথে আলোচনা করার আগেই তাকে থামিয়ে দেয়া হয়। তাকে বলা হয় যে দিল্লিতে চাকরির প্রচণ্ড চাপের কারণে তার ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন ঘটেছে বলে পররাষ্ট্র দফতদরের মনস্তাত্ত্বিকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। তিনি স্থিতিশীল নন। এক্ষেত্রে নিয়ম মত তাকে কোনো মানসিক চিকিৎসার জন্য না পাঠিয়ে তাকে ছুটি দিয়ে জেনেভার কাছে ভারব্রিয়ারে তার স্ত্রীর বাংলোবাড়িতে অবস্থান করে বিশ্রাম নিতে বলা হয়। অর্থাৎ তাকে ঘাঁটানো হল না, কিন্তু কঠিনভাবে জানিয়ে দেয়া হলো যে তার আর প্রয়োজন নেই।
জন গুন্থার ডিনের ঘোর সন্দেহ যে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ অত্যাধুনিক পন্থা ব্যবহার করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছে। কিন্তু তিনি যে আলোচনার পরিকল্পনা করেছিলেন সেখানে ইসরাইলের কথা ছিল না। কে জিয়াকে হত্যা করল, এ প্রশ্নই ছিল তার মূল জিজ্ঞাসা।
কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যু প্রাসঙ্গিক ছিল, গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আশ্চর্য বিষয় যে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র তার চিরন্তন শত্রু রাশিয়াকে জড়িত করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকে। আরো আশ্চর্য যে এ বিষয়টি তদন্তের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এফবিআইয়ের একটি টিমকে পাকিস্তানে পাঠায় এক বছর পর যারা কোনো তদন্ত কাজই করেনি। বরং পাকিস্তান সরকারের তদন্তকে সমর্থন জানিয়ে দেশে ফিরে যায়।
৪.
পাকিস্তানে জিয়াউল হকের প্রধান প্রতিপক্ষ বেনজির ভুট্টোসহ সবারই সন্দেহ যে জিয়ার মৃত্যু একটি নাশকতা, কিন্তু কর্তৃপক্ষ ফরেনসিক বিষয়ে দৃষ্টি না দিয়ে তার উত্তরাধিকারী নির্বাচনের দিকে সকল মনোযোগ নিবদ্ধ করল। কারণ যৌক্তিক ভয় ছিল যে, স্বৈরশাসকের রহস্যময় মৃত্যু পাকিস্তান, ভারত ও অন্যান্য স্বার্থসন্ধানীদের জড়িয়ে এক অগ্নিঝড়ের সৃষ্টি করতে পারে।
জিয়াউল হকের বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার তিন দশক পরও আসলে কী ঘটেছিল সে বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। যারা এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জড়িত ছিল তাদের মধ্যে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, সিআইএ ও পাকিস্তানে জিয়ার শত্রুরা।
জিয়াউল হক হত্যায় দুটি প্রধান তত্ত্ব গুরুত্ব পায়। এক. নাশকতা, দুই বাহওয়ালপুর থেকে বিমানে তোলা আমের ঝুড়িগুলোতে বোমা রাখা। উল্লেখ্য, বাহওয়ালপুর বিমান ঘাঁটিতে তখন সামরিক ও বেসামরিক কড়া প্রহরা বিদ্যমান ছিল। যা হোক, এ দুটি তত্ত্বের কোনোটির পক্ষেই পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলেনি।
ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন হেন্ডারসনের তত্ত্ব যে সি-১৩০-এর পাইলট মাসুদ সম্ভবত স্থানীয় এক ধর্মীয় নেতাকে হত্যার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াকে দায়ী মনে করতেন। তিনিই এ ঘটনা ঘটান। অন্যান্য তত্ত্বও আছে। যেমন : বিমানে বোমা পাতা ছিল যা আকাশে বিস্ফোরিত হয়। আসলে কী ঘটেছিল তা আমরা কোনো দিনই জানতে পারব না। তবে জিয়া উল হকের মৃত্যুতে যে বিষয়টি নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই তা হলো যে এ মৃত্যু পাকিস্তানের ভবিষ্যতকে চিরকালের জন্য পাল্টে দেয়।
পাকিস্তানের এক নীতি বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও লেখক রাজা আহমদ রুমি বলেন, তার মৃত্যু গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ডিসেম্বরে নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করে। ১৯৭৭ সাল থেকে জিয়া সামরিক স্বৈরাচার হিসেবে পাকিস্তান শাসন করেন। তিনি ইসলামি গ্রুপগুলোকে উৎসাহিত করেন, ধর্মের উপর আরো গুরুত্ব দিতে পাঠ্যবই সংশোধন করেন এবং পাকিস্তানকে আধুনিক রূপ দেন যা আর কেউ করেননি। তবে তার মৃত্যুতে পাকিস্তান একটা ধাক্কা খেল, দেশটি গণতন্ত্র পেল।
জিয়াউল হক নিজে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন। তিনি জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন ও তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। ভুট্টোকে বিচারের সম্মুখীন করে ১৯৭৮ সালে তাকে ফাঁসি দেন। ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড রোধের কোনো চেষ্টায়ই তিনি কর্ণপাত করেননি।
জিয়া আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রিগান প্রশাসনের সবচেয়ে বড় মিত্রে পরিণত হন। তার পররাষ্ট্র নীতির পছন্দের মধ্যে ছিল আফফগানিস্তানে আমেরিকার শীতল যুদ্ধ কর্মসূচির অন্ধ অনুসরণ এবং সৌদি আরবের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মেনে নেয়া যার অনুসরণ আজো অব্যাহত আছে। আফগান যুদ্ধে পাকিস্তানের সহানুভূতির অর্থ ছিল পাকিস্তান মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ আর শিয়া বিরোধীদের সমর্থন দিচ্ছিল। এটাই পরবর্তীকালে পাকিস্তানে জিহাদি মতাদর্শের উত্থান ঘটায়।
মৃত্যুর পরও জিয়াউল হক পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহলে একজন মেরুকরণ প্রবণ ও ব্যাপক আলোচিত ব্যক্তি। ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা তার নীতি নির্ধারণী দক্ষতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও গবেষণা করেছেন। কোনো কোনো লেখক তাকে ‘দ্য রিং মাস্টার’, ‘মাস্টার অব ইলিউশন’ ও ‘মাস্টার টেকটিশিয়ান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাকে পাকিস্তানের অত্যন্ত সফল জেনারেলদের মধ্যে একজন বলে গণ্য করা হয় যিনি সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের সব দায়িত্ব প্রদান করেন।
একটি বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় যে বিমানের নিহত আরোহীদের মধ্যে দু একজন বাদে বাকি সবাই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরদ্ধে আফগান মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহের সাথে জড়িত ছিলেন।
এদিকে ১৯৯৩ সালে জিয়াউল হকের পুত্র এজাজুল হক একটি তদন্ত কমিশন চালু করতে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে বাধ্য করেন। বিচারপতি শফিকুর রহমান কমিশন তদন্ত শেষ করে বলে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের বাহওয়ালপুর বিমান ধ্বংসের তদন্ত চালাতে দেয়নি। তাদের তৈরি রিপোর্টটি প্রকাশ না করে সিল করে দেয়া হয়। বিশেষ করে পাকিস্তান বিমান বাহিনী মুলতান বিমান ঘাঁটিতে রাখা সি-১৩০ বিমানের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য সেখানে তাদের ঢুকতেই দেয়নি।
এজাজুল হক আরেকটি কাজ করতে গিয়েছিলেন। সি-১৩০ হারকিউলিসের নির্মাতা লকহিডের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে গিয়েছিলেন। তিনি জানান, কোনো টাকা পাওয়ার জন্য নয়, আমি চেয়েছিলাম যে লকহিড প্রমাণ করুক যে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য বিমানটি ধ্বংস হয়নি। তিনি আইনজীবী এফ লি. বেইলিকে (পরে ও. জে. সিম্পসনের মামলার আইনজীবী হয়ে নাম করেন) নিয়োগ করেন। বেইলি সব শুনে বলেন, এটি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মামলা। নিহত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাফেলের স্ত্রী ন্যান্সি এলি-রাফেল ও ব্রিগেডিয়ার ওয়াসমের স্ত্রীর সাথে এজাজুল হকের যোগাযোগ ছিল। দু জনেই এ মামলার ব্যাপারে তাদের পূর্ণ সমর্থন জানান।
তিনি জানান, জানতে পারলাম যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন এজেন্সি বেইলিকে লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করেছে। তিনি বলেন, এ এক অস্বাভাবিক ঘটনা। যা হোক, এরপর থেকে বেইলি তার ফোন ধরা বন্ধ করে দেন। আর ন্যান্সি তার ফোন নম্বর পরিবর্তন করেন। তার নতুন নম্বর এজাজুল হক আর পাননি। তিনি বলেন, এ অবস্থায় মামলার চিন্তা থেকে সরে আসি।
এ ধরনের ঘটনায় প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হবে, এমনটা আশা করা যায় না, বিশেষ করে তার সম্ভাব্য মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনায়। তবে নিজেদের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ নিহত হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র শুধু রাজনৈতিক কারণে এ বিষয়ক বহু সত্য গোপন করে যায়। তা যে ইচ্ছাকৃত ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিমান দুর্ঘটনা বিষয়ে যতগুলো তদন্ত হয়েছে তার কোনোটিই নিহতদের স্বজনদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আজো তারা এ হত্যাকাণ্ডের জবাব পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।