ইতিহাস-দর্শন ও আইনশাস্ত্র উদ্ভাবনে মুসলমানের অবদান

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | Sep 24, 2019 01:00 pm
ইতিহাস-দর্শন ও আইনশাস্ত্র উদ্ভাবনে মুসলমানের অবদান

ইতিহাস-দর্শন ও আইনশাস্ত্র উদ্ভাবনে মুসলমানের অবদান - ছবি : সংগ্রহ

 

প্রথমেই বলে রাখা আবশ্যক, ইসলাম কেবল একটা ধর্ম নয়। স্রষ্টার সাথে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে ইসলামের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং ইসলাম হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। সে কারণেই ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, আইন, সমাজবিদ্যা, ভূগোল, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা ও শিল্পকলা চর্চায় ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোকপাত করা আবশ্যক। দুনিয়াদারির জীবনকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেনি, বরং সুস্থ সুন্দর জীবনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : বলো, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে নিষিদ্ধ করেছে? (৭:৩২৭) কুরআন মজিদে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে যারা বলে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের ইহকালে কল্যাণ দাও, পরকালেও কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা করো’ (২:২০১)।
কুরআন মজিদে শুধু আবিষ্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়নি, বরং নিত্যনতুন বিষয় উদ্ভাবনের ওপরও যথাযথ জোর দেয়া হয়েছে। যেমন- বলা হয়েছে, বলো, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং দেখো তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে! তাদের বেশির ভাগই ছিল মুশরিক (৩০ : ৪২)। আবার এ কথাও উল্লেখ আছে, যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ মণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং বলে হে আমাদের রব, তুমি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করোনি... (৩ : ১৯১)। জ্ঞান অর্জনের পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কেও কুরআন মজিদে স্পষ্ট পথনির্দেশ রয়েছে।

সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইন সম্পর্কে ব্যাপক চর্চা শুরু করেন মুসলিম আইনবিদগণ। প্রাচীনকালেও আইনের প্রচলন ছিল। ক্ষেত্র বিশেষে এগুলো বিন্যস্ত থাকলেও সেসব আইনের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। সে সময়ে আইনের দর্শন ও আইনের উৎস সম্পর্কে কোনো আলোচনা হতো না। আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, প্রয়োগ-পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা ছিল অনুপস্থিত। এমনকি ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এ বিষয়গুলো আইন বিশারদদের বিন্দুমাত্র নাড়া দিত না। মুসলমানেরা আইনের উৎস কুরআন ও হাদিসের আলোকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইন সম্পর্কে ব্যাপক চর্চা শুরু করেন। তারাই সর্বপ্রথম আইনকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের আগে আর কেউ আইনের মতো এত বস্তুনিষ্ঠ, এত বিমূর্ত বিষয় নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেননি। হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দী থেকেই এর চর্চা শুরু হয়। তখন আইনকে বলা হতো উসুলে ফিকহ।

প্রাচীনকালে আন্তর্জাতিক আইন বলতে যা বুঝান হতো, তাতে কোনো আন্তর্জাতিকতা ছিল না। বস্তুতপক্ষে তাকে আইনও বলা যায় না। আসলে সেটা ছিল রাজনীতিরই একটি অংশ। এটা রাষ্ট্রনায়কদের ইচ্ছা এবং দয়ার ওপর নির্ভর করত। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাপ্তিও ছিল সীমিত। যে সব রাষ্ট্রে একই ধর্ম বা ভাষাভাষীর লোকেরা বসবাস করত, কেবল সে সব দেশের মধ্যেই এ আইন কার্যকর ছিল। মুসলমানেরা সর্বপ্রথম আইনকে একটি নির্দিষ্ট বিধি-ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসেন, এর সাথে জুড়ে দেন দায়িত্ব ও অধিকারের বিষয়টি। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ইসলামের ইতিহাসের শুরুতে যেসব চুক্তিপত্র বা আইন প্রণীত হয়েছে, সেগুলোতেও আন্তর্জাতিক ধারাগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে জায়েদ ইবনে আলীর মাজমু-এর উল্লেখ করা যেতে পারে। জায়েদ ইবনে আলী ১২০ হিজরি মোতাবেক ৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। অতীত কালের যেসব চুক্তিপত্র আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে, সেগুলোর মধ্যে জায়েদ ইবনে আলীর চুক্তিপত্রটি সর্বাধিক প্রাচীন।

প্রসঙ্গক্রমে আরো উল্লেখ্য, মুসলমানদের হাতে আন্তর্জাতিক আইন স্বতন্ত্র শাস্ত্র বা বিজ্ঞান হিসেবে বিকাশ লাভ করে। এমনকি ১৫০ হিজরির আগে প্রণীত বিভিন্ন বিবরণ বা রচনায় এ সংক্রান্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। অবশ্য সে সময়ে আন্তর্জাতিক আইন বলতে স্বতন্ত্র কোনো শিরোনাম ছিল না, ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত সিয়ার শীর্ষক শিরোনামে এ আলোচনা স্থান পেয়েছে। ইবনে হাজর রচিত ‘তাওয়ালি আত-তাসিস’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে পথম গ্রন্থ রচনা করেন হজরত ইমাম আবু হানিফা র:। তিনি ছিলেন জায়েদ ইবনে আলীর সমসাময়িক। এ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যেÑ ক. এখানে সব বিদেশীকে একই পাল্লায় পরিমাপ করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে কোনো রকম তারতম্য বা কারো প্রতি কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব করা হয়নি। খ. মুসলমানদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে, সে বিষয়ে এখানে কোনো উল্লেখ নেই, বরং গোটা বিশ্বের অমুসলিম রাষ্ট্রগুলো এ গ্রন্থের মুখ্য আলোচ্য বিষয়। বস্তুতপক্ষে ইসলাম নীতিগতভাবে স্থান, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সব মুসলমানকে এক সুতায় গেঁথে দিয়েছে। সবাইকে নিয়ে গড়ে তুলেছে একটি জাতি।

মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি অবদান রয়েছে তুলনামূলক কেইস ল-এর ক্ষেত্রে। ইসলামি আইনের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। বিশেষ কোনো আইনের ব্যাপারে কেন এ মতপার্থক্য দেখা দেয় অথবা এজাতীয় মতপার্থক্যের ফলাফল কী হতে পারে তা নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। এখান থেকেই তুলনামূলক কেইস ল-এর উদ্ভব ঘটে। এ বিষয়ের ওপর দাবসি এবং ইবনে রুশদ রচিত পুস্তকগুলো পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। সাইমুরি তুলনামূলক আইনবিজ্ঞান বা আইনপদ্ধতির ওপর পুস্তক রচনা করেন। আরবি পরিভাষায় এ জাতীয় পুস্তককে বলা হয় উসুলে ফিকহ। মুসলমানেরাই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের জন্য লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করেন। বস্তুতপক্ষে নবী করিম সা: ছিলেন এ সংবিধানের রচয়িতা। তিনি যখন মদিনায় নগররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তখন এ সংবিধানটি প্রণয়ন করেন। ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম এবং আবু উবায়েদের বর্ণনার মধ্য দিয়ে এটা আমাদের হাতে পৌঁছেছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বিচারব্যবস্থা প্রতিরক্ষা প্রভৃতি সব বিষয় সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে। রাষ্ট্রনায়ক তথা জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে স্পষ্টভাবে। ৫২টি ধারা সংবলিত এ সংবিধানটি প্রণয়ন করা হয় ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। এখানে ইসলামি আইনকে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। ক. ধর্মীয় আচার আচরণ, খ. যাবতীয় চুক্তি সম্পর্কিত বিষয়, গ. শাস্তি সম্পর্কিত বিষয়াদি।

ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যে দু’টি ধারা লক্ষ করা যায়। একটি ধারাকে বলা যায় পুরোপুরি ইসলামের ইতিহাস, নবী করিম সা: এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবন ও কর্ম এর প্রধান উপজীব্য। অন্য ধারায় রয়েছে অমুসলিমদের ইতিহাস। ইসলামপূর্ব যুগের আরব থেকে শুরু করে সমসাময়িককালের বিশ্ব পরিস্থিতি যেমন- রোম, পারস্য এসবই ছিল অমুসলিমদের ইতিহাসের বিষয়বস্তু। বস্তুতপক্ষে হিজরি প্রথম শতাব্দীতেই ইতিহাস রচনার এ দু’টি ধারা স্বতন্ত্রভাবে বিকাশ লাভ করে। অবশ্য পরবর্তীতে ইতিহাস রচনার এ দুটি ধারা স্বতন্ত্রভাবে বিরাজ করেনি বরং এ দু’টি ধারা মিলে একটি সামগ্রিক রূপ গ্রহণ করে। ঐতিহাসিক রশিদুদ্দীন খানের রচিত ইতিহাস গ্রন্থই এর স্বাক্ষর বহন করে। এখানে আম্বিয়ায়ে কেরাম, নবী করিম সা: এবং খলিফাদের জীবন ও কর্ম যত ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, তেমনি স্থান পেয়েছে যাজক সম্প্রদায় তথা রোমান, পারস্য, চীন, ভারত, মঙ্গোলীয় শাসকদের জীবন ও কর্ম। গ্রন্থটি একাধারে আরবি ও ফারসি ভাষায় রচিত হয়েছে। অবশ্য বৃহদাকারের এ গ্রন্থটির বিরাট অংশ এখনো মুদ্রণের অপেক্ষায় আছে। খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলেই মুসলিম সাম্রাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। হজ ও বাণিজ্য উপলক্ষে দূরবর্তী অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা যে কত উন্নত ছিল ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকেই তার প্রমাণ মেলে। বালাজুরি ও ইবন জাউজি লিখেছেন, ‘বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ডাক প্রেরণ করা হতো। এর বিস্তৃতি ছিল সুদূর তুরস্ক থেকে মিসর পর্যন্ত। এমনকি সরকারি ডাকের সাথে সাধারণ নাগরিকরা তাদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র প্রেরণ করতে পারত। খলিফা হজরত উমরের নির্দেশে তখন থেকেই এ নিয়মটি প্রবর্তন করা হয়। ডাক বিভাগের কর্মকর্তারা যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর গাইড বা পথনির্দেশিকা তৈরি করতেন। এসব পুস্তিকায় যাত্রাপথের প্রতিটি অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ থাকত। এগুলো বিন্যস্ত করা হতো বর্ণমালা অনুসারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ বিবরণ থাকত বিস্তারিত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার সংক্ষিপ্ত। এভাবেই রচিত হয় ভূগোল বিষয়ে নানা গ্রন্থ। পরবর্তীকালে এগুলোই মুসলমানদের অন্যান্য বিষয়ে গভীর ও বৈজ্ঞানিক চর্চায় অনুপ্রাণিত করে। টলেমির রচিত ভূগোল গ্রন্থ আরবিতে অনূদিত হয়।

অনুরূপভাবে অনুবাদ করা হয় সংস্কৃতি ভাষায় রচিত ভারতীয় লেখকদের বহু গ্রন্থ। এ সময়ে মুসলমানেরা দীর্ঘ সফর ও সমুদ্রযাত্রার বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করে। সফরনামা ও সমুদ্রযাত্রার কাহিনী প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের জ্ঞান বাড়িয়ে দেয়। ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে সব কিছুই হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখার মতো একটি মানসিকতার সৃষ্টি হয়। ভূগোল সম্পর্কে মুসলমানদের যে কত গভীর জ্ঞান ছিল, ইমাম আবু হানিফা র:-এর একটি উক্তি থেকেই তার স্বাক্ষর মেলে। একবার মু’তাজিলা সম্প্রদায়ভুক্ত এক ব্যক্তি ইমাম আবু হানিফা র:কে জিজ্ঞাসা করেছিল, পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুটি কোথায় অবস্থিত? জবাবে তিনি বলেছিলেন, তুমি যেখানে বসে আছ ঠিক ওটাই হলো পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। বলে রাখা আবশ্যক, যদি কারো মধ্যে এ ধারণা থাকে যে, পৃথিবী গোলাকার, কেবল তার পক্ষেই এ ধরনের একটা জবাব দেয়া সম্ভব।

মুসলমানেরাই সর্বপ্রথম পৃথিবীর মানচিত্র তৈরি করেন। সেখানেও পৃথিবীকে তারা বৃত্তাকারে উপস্থাপন করেন। উদাহরণ হিসেবে এখানে ইবনে হায়কলের অঙ্কিত মানচিত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে। মানচিত্রটি এত নিখুঁত যে, সেখানে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কাছে প্রাচ্যের দেশগুলোকে শনাক্ত করতে কোনো বেগ পেতে হয় না। সিসিলির রাজা রজারের (১১০১-৫৪) জন্য একটি ম্যাপ তৈরি করেছিলেন ভূগোলবিদ ইদ্রিস। এ ম্যাপটিতে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পর্যন্ত এমন নিখুঁতভাবে স্থান পায় যে, তা সবাইকে চমকে দেয়। এমনকি এই মানচিত্র নীল নদের উৎসমুখটিও দেখানো হয়েছিল। স্মরণ রাখতে হবে, আরব মুসলমানেরা দক্ষিণকে চিহ্নিত করেছেন উঁচু অঞ্চলে আর উত্তরকে নি¤œাঞ্চল হিসেবে। সমুদ্রপথে চলাচলের সুবিধার্থে দ্রাঘিমা ও অক্ষাংশের বিচিত্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। একই কারণে মুসলমানদের মধ্যে জ্যোতিষ চর্চা এবং নৌ-চর্চা বিদ্যা সম্পর্কিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

স্ক্যান্ডিনেভিয়া, ফিনল্যান্ড, রাশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে খননকার্য চালিয়ে মুসলমান শাসন আমলের হাজার হাজার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ঘটনা থেকে নিশ্চিতভাবে এ শাসন আমলের হাজার হাজার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ঘটনা থেকে নিশ্চিতভাবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, মধ্যযুগে মুসলমানদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। ব্যবসা উপলক্ষে তারা অনায়াসেই দূর-দূরান্তে যাতায়াত করতেন। খ্যাতিমান একজন মুসলিম নাগরিকের নাম ইবনে মাজিদ। ভাস্কোদা-গামার ভারত অভিযাত্রার সময় ইবনে মাজিদ ছিলেন নৌবহরের পাইলট বা প্রধান নাবিক। জানা যায় যে, এ অভিযাত্রাকালে ইবনে মাজিদ দিকনির্দেশক যন্ত্র বা কম্পাস ব্যবহার করেছিলেন। বিশেষ করে বসরা থেকে চীন পর্যন্ত মুসলমানদের নৌ-সফর ছিল খুবই বিস্ময়কর। এ ক্ষেত্রে তারা যে নৈপুণ্য ও দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন, তা সবাইকে চমকে দেয়। ইংরেজিতে বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দের মধ্যে রয়েছে আরসেনাল, অ্যাডমিরাল, মনসুন, ট্যারিফ ইত্যাদি। এ শব্দগুলো উদ্ভব হয়েছে মূল আরবি ভাষা থেকে। বহুকাল ধরে পাশ্চাত্য সভ্যতার ওপর মুসলমানদের যে কত ব্যাপক প্রভাব ছিল, এ শব্দগুলো থেকে সহজেই তা অনুমান করা যায়।

জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রেও মুসলমানদের অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে। তারা বেশ কিছু জ্যোতিষ্ক আবিষ্কার করেন এবং এগুলোর ওপর ব্যাপক গবেষণা পরিচালনা করেন। তারা এসব জ্যোতিষ্কের নামকরণ করেন আরবি ভাষায়। মজার ব্যাপার এই যে, পাশ্চাত্য জগতেও এসব জ্যোতিষ্ক মুসলমানদের দেয়া আরবি নামেই পরিচিত হয়ে আসছে। বিজ্ঞানী ইবনে রুশদ, সূর্যের পৃষ্ঠদেশের দাগকে প্রথম শনাক্ত করেন। উমর খইয়াম বর্ষপঞ্জিকার ব্যাপক সংস্কার করেন। ফলে তা গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জিকা অপেক্ষা বহুগুণে উন্নততর রূপ লাভ করে। ইসলামের আবির্ভাবের আগেই বেদুইন আরবরা ক্ষুদ্র আকারের একটি মানমন্দির নির্মাণ করেছিল। প্রধানত অন্ধকার রাতে মরু অঞ্চল দিয়ে যাতায়াতের কাজে তা ব্যবহৃত হতো। তা ছাড়া আবহাওয়া, বৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজেও এটা ছিল বিশেষ উপকারী। কিতাবুল আনওয়া শিরোনামের গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়ে বিস্তর বর্ণনা রয়েছে। পরবর্তী সময়ে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে সংস্কৃত, গ্রিক এবং অন্যান্য ভাষায় রচিত পুস্তকাবলি আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এসব পুস্তকের তথ্য বা বর্ণনার মধ্যে প্রচুর বৈপরীত্য বা পরস্পরবিরোধিতা লক্ষ করা যায়। ফলে প্রকৃত সত্য নিরূপণ ও এসব তথ্য যাচাই করার জন্য নতুন নতুন পরীক্ষা শুরু হয়। প্রয়োজন পড়ে দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণের। নির্মিত হয় অসংখ্য পর্যবেক্ষণকেন্দ্র। ফলে জ্যোতির্বিদ্যার ব্যাপক প্রসার ঘটে। খলিফা আল-মামুনের শাসনামলেই পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করা হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার এই, এ পরিমাপটি ছিল খুবই নিখুঁত। এ সময়ে জোয়ার-ভাটা, সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা, রংধনু প্রভৃতি বিষয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়। বিশেষ করে সালাত কায়েম এবং সিয়ামের সময়সূচির সাথে চন্দ্র-সূর্যের গতিবিধিকে তারা গভীর মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করে।

ইসলামের দৃষ্টিতে বিজ্ঞানে কুসংস্কার বা কল্পকাহিনীর কোনো স্থান নেই। এখানে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য এবং এটাই হলো ইসলামি বিজ্ঞানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মুসলমানদের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান চর্চার পদ্ধতি ছিল ভারি চমৎকার ও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিজ্ঞান চর্চার শুরুতে অপরিসীম ধৈর্যসহকারে তারা আরবি ভাষায় যতগুলো টেকনিক্যাল শব্দ আছে তার একটি তালিকা তৈরি করেন। টেকনিক্যাল শব্দগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা অসাধারণ ধৈর্য ও সতর্কতার সাথে পদ্যে লেখা কিংবা গদ্যে লেখা নানা ধরনের পুস্তক-পুস্তিকা অধ্যয়ন করেন। শব্দ সংগ্রহের পাশাপাশি তারা এগুলোর অর্থ, ব্যবহার এবং প্রয়োগ কৌশল সম্পর্কে উল্লেখ করেন। শব্দগুলোকে বিন্যস্ত করেন প্রাণিবিদ্যা, এনাটমি, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ানুসারে। তা ছাড়া, বিভিন্ন সময় এগুলো পরিমার্জন ও সংশোধন করেন। শব্দ তালিকার সাথে যোগ করেন নতুন নতুন শব্দ। পরবর্তীকালে বিজ্ঞান গ্রন্থ অনুবাদ করার সময় এ শব্দ তালিকা খুবই কার্যকর বলে প্রতীয়মান হয়। অন্য ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলো আরবিতে অনুবাদ করার সময় বিদেশী শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। অনুরূপভাবে আরবি ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলো অন্য ভাষায় রূপান্তর করার সময় আরবি শব্দ দ্বারা অনুবাদ পুস্তকগুলো ভারাক্রান্ত হয়নি।

উদাহরণ হিসেবে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের উল্লেখ করা যেতে পারে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানসংক্রান্ত গবেষণা ও পুস্তক রচনাকালে তারা প্রতিটি পারিভাষিক শব্দ আরবি ভাষা থেকে গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে তারা কোনো বিদেশী শব্দই ব্যবহার করেননি। তবে যে সব উদ্ভিদ আরব দেশে জন্মায় না, কেবল সেগুলোর ক্ষেত্রেই বিদেশী ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। দিনাওয়ারি (মৃ. ৮৯৫ খ্রি:) নবম শতাব্দীতে কিতাব আন-নাবাত, ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটানিকা রচনা করেন। বৃহদাকারের ছয়টি খণ্ডে এগুলো সঙ্কলনও করা হয়। অথচ গ্রিক ভাষায় রচিত জীববিদ্যার কোনো বই তখনো অনূদিত হয়নি।

বিজ্ঞানী সিলবারবার্গ মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে বলেন, উদ্ভিদ বিদ্যা সম্পর্কে গ্রিকদের বিজ্ঞান চর্চা হাজার বছরের। ডায়সেকোরাইডের এবং থিওফেরাটাসের হাতে উদ্ভিদ বিদ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিকাশ লাভ করে। এরপরও এ কথা সত্য যে, মুসলিম উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দিনাওয়ারির একক সফলতা ছিল গ্রিকদের সম্মিলিত সফলতার চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। তিনি কেবল উদ্ভিদের দৃশ্যমান অবস্থা সম্পর্কেই আলোচনা করেননি, বরং চিকিৎসা কাজে উদ্ভিদের ব্যবহারের সম্ভাবনা এবং অন্যান্য গুণের প্রতিও আলোকপাত করেন। এমনকি বৈশিষ্ট্য আনসারে উদ্ভিদকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেন, আলোচনা করেন উদ্ভিদের প্রাপ্তিস্থান এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে। মুসলমানদের হাতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। বিশেষ করে শল্যচিকিৎসা, ওষুধ বিজ্ঞান, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তাদের অবদান ছিল বিস্ময়কর।

এমনকি তদানীন্তনকালেই পেশাদার চিকিৎসক হওয়ার জন্য একজন ডাক্তারকে রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে সনদপত্র গ্রহণ করার নিয়ম চালু হয়। স্মরণ রাখা আবশ্যক, রোমান, ভারত, চীন প্রভৃতি দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছিল মুসলিম জাহানের অভিন্ন সীমানা। এসব দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার সাথে মুসলমান বিজ্ঞানীদের নিবিড় সংযোগ ছিল। ফলে এসব দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যতটুকু অগ্রগতি হয়েছিল, তার সবটুকুরই সমাবেশ ঘটেছিল মুসলমানদের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল দ্বিবিধ। প্রথমত, তারা ইতোমধ্যে অর্জিত জ্ঞানের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান; দ্বিতীয়ত, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে তারা আরো মৌলিক অবদান রাখেন। এমনকি শরীরে রক্ত চলাচলের তথ্যাদিও মুসলমান কর্তৃক আবিষ্কারের ফসল। ইবনে নাফিসের রচনা থেকেই এ কথা জানা যায়। মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্যে আল-রাজি, ইবনে সিনা ও আবুল কাশেম বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। তাদের রচনা এবং গবেষণাকর্ম বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। কিছুকাল আগেও তাদের গবেষণাকর্মকে পাশ্চাত্যের চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চার ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। আলোক বিজ্ঞানে উন্নয়নে মুসলমানদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। নবম শতাব্দীতে আল-কিন্দির রচিত রশ্মিবিষয়ক গ্রন্থ এখনো মজুদ রয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, তদানীন্তন গ্রিকদের রচিত বিজ্ঞান গ্রন্থের চেয়ে আল-কিন্দির গ্রন্থ ছিল বহুগুণে অগ্রসর ও উন্নতমানের। হায়সাম ছিলেন আল-কিন্দির একজন সার্থক উত্তরসূরি। তিনিও তার গবেষণাকর্মের জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। প্রধানত দু’টি কারণে খনিজ বিজ্ঞানের প্রতি বিজ্ঞানীদের আগ্রহ লক্ষ করা যায়। প্রথমত, চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য খনিজ সম্পর্কে জানাটা জরুরি। দ্বিতীয়ত, মূল্যবান পাথরের মধ্যকার গুণাগুণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে খনিজ বিজ্ঞান ছিল খুবই সহায়ক। এ ব্যাপারে রাজা-বাদশাহ ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছিল বেশি। খনিজ বিজ্ঞানের ওপর আল-বেরুনির গবেষণা কর্ম এখনো বিশেষভাবে ফলপ্রসূ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

ইবনে ফিরনাস (মূ. ৮৮৮) একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। এ যন্ত্রের সাহায্যে তিনি বহুদূর পর্যন্ত উড়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। একটি দুর্ঘটনায় তিনি ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তার গবেষণাকর্মকে অব্যাহত বা চূড়ান্তভাবে রূপ দেয়ার জন্য কোনো বিজ্ঞানী এগিয়ে আসেননি। ফলে তার মৃত্যুর সাথে সাথে উড্ডয়ন সম্পর্কিত গবেষণা কর্মের যবনিকাপাত ঘটে। কোনো কোনো বিজ্ঞানী এমন কতগুলো কলকব্জা আবিষ্কার করেন, যেগুলোর সাহায্যে পানির তলদেশে নিমজ্জিত জাহাজকে অনায়াসেই তোলা যেত। এ যন্ত্রের সাহায্যে বিরাটাকারের বৃক্ষকেও সহজে উপড়ে ফেলা সম্ভব হতো। তা ছাড়া পানির তলদেশের জগত ছিল মুসলমান বিজ্ঞানীদের জ্ঞানচর্চার একটি অন্যতম ক্ষেত্র। তারা মুক্তা, ঝিনুক ও মৎস্যচাষের ওপর গভীর গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তাদের রচিত গবেষণাধর্মী গ্রন্থের সংখ্যাও যথেষ্ট। বন্য পশু ও প্রাণীর প্রতি আরব বেদুইনদের প্রবল আকর্ষণ ছিল। তারা প্রাণিজগতের জীবনধারা সম্পর্কে চর্চা করে প্রচুর আনন্দ পেত। মুসলিম প্রাণিবিজ্ঞানীদের মধ্যে আল-জাহিজের (মৃ. ৮৬৮) স্থান ছিল সবার শীর্ষে। তিনি প্রাণিবিদ্যাকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন। পরবর্তীকালে আল-কাজবিনি, দামিরি ও মিওকাওয়াই প্রাণিবিজ্ঞানী হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এমনকি তদানীন্তনকালে গৃহপালিত পশু ও বন্যপ্রাণীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিকারের কাজে ব্যবহার করা হতো। মুসলমান বিজ্ঞানীরা এসব বিষয়েও অসংখ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।

বিশ্বজগতের সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করার জন্য কুরআনুল কারিম মানুষকে তাগিদ দিয়েছে। তাকে আরো অনুপ্রাণিত করেছে আসমান-জমিনকে কিভাবে মানবজাতির অধীনস্থ করা হয়েছে সে সম্পর্কে নিরলস চর্চা করতে আর সে কারণেই ইসলামে যুক্তি ও বিশ্বাসের মধ্যে কোনো সঙ্ঘাত নেই। তাই দেখা যায়, ইসলামের প্রাথমিক জামানা থেকেই মুসলমানেরা রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা চর্চায় গভীর মনোনিবেশ করেন।

খালিদ ইবনে জায়িদ (মৃ. ৭০৪), ইমাম জাফর আস সাদিক র:-কে বলা হয় মুসলিম বিজ্ঞানীদের পথিকৃৎ। জাবির ইবনে হাইয়্যান ছিলেন তাদেরই একজন কৃতী ছাত্র। গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্মের জন্য আজো তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাদের গবেষণা কর্মের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা অনুমানের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠ পরীক্ষণের ওপর নির্ভর করতেন। তারা তথ্য সংগ্রহ করতেন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। তাদের হাতে পড়েই প্রাচীনকালের রসায়ন শাস্ত্রের সাথে নতুন নতুন তথ্য যোগ হয়। তা ছাড়া, এ তথ্যগুলো ছিল প্রমাণযোগ্য। এভাবেই রসায়নশাস্ত্র একটি বিজ্ঞানের মর্যাদা লাভ করে। জাবির ইবনে হাইয়ানের হাতে রসায়নবিদ্যা খুবই প্রসার লাভ করে। সে আমলেই তিনি রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ভস্মীকরণ (ঈধষরহধঃরড়হ) এবং লঘুকরণ (জবফঁপষরবং) পদ্ধতির কথা জানতে পারেন। তিনি ছিলেন বাষ্পীকরণ, ঊর্ধ্বপাতন, ঘনীভূতকরণ প্রভৃতি কলাকৌশলের আবিষ্কারক। এটা জানা কথা যে, বিজ্ঞানের এ অগ্রযাত্রার জন্য মুসলমানদের যুগ যুগ ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিজ্ঞানীদের গবেষণাকর্ম ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পাশ্চাত্য জগতে এ গ্রন্থগুলো দীর্ঘ দিন পাঠ্যপুস্তক হিসেবে চালু ছিল। আধুনিক বিজ্ঞান যে মুসলমানদের কাছে কতখানি ঋণী, মুসলমানগণ বিজ্ঞানচর্চার যে কতখানি অগ্রসর ছিলেন, এ ঘটনা থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অঙ্কশাস্ত্র উন্নয়নে মুসলমানেরা যে অবদান রেখেছেন, তা কখনো ম্লান হওয়ার নয়। এলজেব্রা, জিরো, সাইফুর প্রভৃতি শব্দের উৎপত্তি আরবি ভাষা থেকেই। আর মুসলমান অঙ্কবিশারদরা এগুলোর আবিষ্কারক। মুসলমান অঙ্কবিশারদদের মধ্যে খাওয়ারিজমি, উমর খৈয়াম, আল-বেরুনি খুবই খ্যাতিমান। এদের তুলনা চলে ইউক্লিডের সাথে। সাধারণভাবে অঙ্কচর্চায় গ্রিকদের ব্যাপক খ্যাতি থাকলেও ত্রিকোণমিতি ছিল তাদের কাছে সম্পূর্ণ অজানা বিষয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মুসলমানেরাই ছিলেন অঙ্কশাস্ত্রের এ শাখার উদ্ভাবক।

পূর্বে বাগদাদ ও পশ্চিমে কর্ডোভা-গ্রানাডাকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিকাশ ঘটে। এ সময়ে অসভ্য বর্বরতা বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রগুলো মুসলমানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। তখন থেকেই ব্যাহত হয় মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চার ধারা। বস্তুতপক্ষে এটা ছিল বিজ্ঞানের ইতিহাসের জন্য একটা দুর্যোগ ও দুর্ভাগ্য। কারণ, তখনো মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। হাতেলেখা পাণ্ডুলিপিগুলো জমা থাকত গ্রন্থাগারগুলোতে। এর সংখ্যা ছিল শত-সহস্র। অসভ্য বর্বররা বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রগুলো নিজেদের দখলে নেয়ার সাথে সাথে মূল্যবান পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থাগার পুড়িয়ে ফেলে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাসে এটা ছিল একটা অবর্ণনীয় ও অনুপূরণীয় ক্ষতি। এমনকি তাদের নৃশংসতা থেকে বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিজীবীরা অব্যাহতি পেলেন না। তাদেরকেও তারা নির্দয়ভাবে হত্যা করল। বৈজ্ঞানিক তথা বুদ্ধিজীবীদের শত শত বছরের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে যে জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছিল, মাত্র দিন কয়েকের নৃশংসতায় তা নিঃশেষ হয়ে গেল। এ ধরনের দুর্যোগের কারণে কোনো সভ্যতার ধ্বংস হলে তা পুনরুদ্ধার করা সত্যিকার অর্থেই দুরূহ ব্যাপার। এর জন্য কয়েক শতাব্দীর দরকার হয়। প্রয়োজন পড়ে অফুরন্ত সম্পদের। আরো প্রয়োজন অন্যান্য সভ্যতা সম্পর্কে ব্যাপক চর্চা ও পর্যালোচনার। তার চেয়ে বড় কথা এই যে, যখন তখন প্রতিভাবান ব্যক্তি ও মহৎ হৃদয়ের আবির্ভাব ঘটে না। এ দুটোই আসে আল্লাহর বিশেষ রহমত ও দান হিসেবে। বিজ্ঞানের বিকাশে কুরআন মজিদের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তেমনিভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে শিল্পকলার উন্নয়নের ক্ষেত্রে। বস্তুতপক্ষে কুরআন মজিদ মুসলমানদের শিল্পকলার চর্চায় উৎসাহিত করেছে। যেমনÑ সুন্দর সহিহভাবে কুরআন সংরক্ষণ প্রচেষ্টা থেকেই ক্যালিগ্রাফি বা সুন্দর হস্তলিখন এবং বাঁধাই শিল্পের সূত্রপাত ঘটেছে। মসজিদ নির্মাণশৈলী থেকেই সৃষ্টি হয়েছে আর্কিটেকচার বা স্থাপত্য এবং অলঙ্করণ শিল্পের। এক সময়ে ধর্মীয় অনুভূতি ও উপলব্ধি থেকে যে শিল্পের উদ্ভব ঘটে পরবর্তী সময়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বিলাসিতা সে শিল্পকলাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যায়। তবে ইসলাম আত্মিক ও পার্থিব চাহিদার মধ্যে একটি সামঞ্জস্য বিধান করার নীতি শিক্ষা দেয়। শিক্ষা দেয় সব বিষয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করার। অর্থাৎ ইসলামের হুকুম এই যে, মানুষের স্বভাবজাত প্রতিভার অবশ্যই বিকাশ ঘটাতে হবে। তবে তা হতে হবে সঠিক এবং আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশিত পথে। তাকে গড়ে উঠতে হবে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে।

নবী করিম সা:-এর জন্য সর্বপ্রথম যে মিম্বরটি তৈরি করা হয়েছিল তাও দুটি গোলক বা গোলাকার বস্তু দ্বারা সাজান হয়েছিল। গোলক দুটি ছিল অনেকটা ডালিমের মতো। নবী করিম সা:-এর দুই প্রিয় নাতী ও গোলাক দুটি দিয়ে বেশ মজা করে খেলতেন। এখান থেকেই কাঠের কারুকাজের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে কুরআন মজিদের কপিগুলো নানা রঙে সুশোভিত করা হয় এবং সেগুলো বাঁধাইয়ে দারুণ যতœ নেয়া হয়। সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলা যেতে পারে, শিল্পকলার বিকাশ ও প্রসারের ক্ষেত্রে ইসলাম কোনোরকমের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি। বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকে শুধু প্রাণীর প্রতিকৃতি চিত্রায়ন বা নির্মাণের ক্ষেত্রে। এর পশ্চাতেও কতকগুলো যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে। কারণগুলো প্রধানত মনোজাগতিক, সামাজিক, জীববিদ্যা ও আধ্যাত্মিক বিষয় সম্পর্কিত। অবশ্য কতকগুলো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমনÑ শিশুদের খেলনা, চাদর ও কার্পেট সাজ-সজ্জার বেলায় নবী করিম সা: আপত্তি করেননি। বৈজ্ঞানিক চাহিদা যেমন চিকিৎসা, নেতৃত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে এ বিধি ছাড় দেয়া হয়েছে। আরো ছাড় দেয়া হয়েছে নিরাপত্তাজনিত চাহিদা যেমন পুলিশের পরিচয়পত্র, পলাতক অপরাধীদের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে। তা ছাড়া সমসাময়িককালে বিদেশে সফরের জন্য পাসপোর্ট জাতীয় বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও এ বিধিনিষেধ আরোপ করা যায় না।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, মূর্তিমান শিল্পের ব্যাপারে ইসলাম যে বিধিনিষেধ রয়েছে তা কখনো মুসলমানদের শিল্পচর্চাকে ব্যাহত করতে পারেনি, বরং তাদের হাতে বিমূর্ত শিল্পচর্চার যে বিকাশ ঘটেছে তা খুবই বিস্ময়কর। কুরআন মজিদে মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে সাজ-সজ্জার অনুমোদন রয়েছে (সূরা নূর : ৩৬)। বাস্তব উদাহরণ হিসেবে মদিনার মসজিদে নববী, জেরুসালেমের মসজিদ, ইস্তাম্বুলের সোলায়মানিয়া মসজিদ, আগ্রার তাজমহল, গ্রানাডার আল-হামরা প্রাসাদ এবং এ জাতীয় আরো কতকগুলো কীর্তির উল্লেখ করা যেতে পারে। অন্য যেকোনো সভ্যতার অসামান্য স্থাপত্য কর্ম বা শিল্প সৌকর্যের তুলনায় এগুলোকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। মুসলমানরা ছবি আঁকার পরিবর্তে ক্যালিগ্রাফিকে গ্রহণ করেছে একটি শিল্পকর্ম হিসেবে। বলতে গেলে এটি তাদের একান্ত নিজস্ব সম্পদ। তারা প্রধানত অঙ্কন, কাপড় ও বিভিন্ন দ্রব্য চিত্রায়নের কাছে ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করে থাকে। যে সমস্ত ক্যালিগ্রাফি দরদ, যতœ ও নৈপুণ্যের সাথে প্রণীত হয়েছে, সেগুলোর মান খুবই উন্নত। দেখতেও চমৎকার ও মনমুগ্ধকর। এগুলোর সৌন্দর্য সত্যিই অবর্ণনীয়।

কুরআন তিলাওয়াত মুসলমানদের শিল্পচর্চার আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। কুরআন তিলাওয়াতে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের অবকাশ নেই। কুরআনের সকল আয়াত সমান ও একই মাত্রার নয়। নবী করিম সা:-এর কাল থেকেই মুসলমানরা পরম আগ্রহের সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত করে আসছেন। কুরআন মজিদের নিজস্ব একটি গতি ও ছন্দ আছে। এর আয়াতগুলো খুবই শ্রুতিমধুর ও মিষ্টি। অন্য যেকোনো ভাষার গতি ও ছন্দের মান যত উন্নত ও চিত্তাকর্ষকই হোক না কেন, তা কখনো কুরআন মজিদের মিষ্টি-মধুর সুরকে ম্লান করতে পারে না। যারা কারী সাহেবের তিলাওয়াত অথবা প্রতিনিয়ত মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে উচ্চারিত আজানের ধ্বনি শ্রবণ করে, তারা ভালভাবেই জানে যে, এ মুসলমানদের একটা অনন্য সম্পদ। এর স্বাদ ও বৈশিষ্ট্যই আলাদা। এর সাথে এমন একটা পরিতৃপ্তি ও আনন্দ মিশে আছে যার সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনা হয় না। মুসলমানদের হাতে গানবাজনারও যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। গানবাজনাগুলো ছিল পার্থিব জগৎ সম্পর্কিত। রাজা-বাদশা-ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ছিল এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। গানবাজনার উন্নয়নে যারা অসাধারণ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আল-ফারাবী, ইবনে সিনা এবং আরো অনেকে। তাদের অবদানগুলো অমর কীর্তি হিসেবে বিরাজ করছে। গ্রিক এবং ভারতীয় সঙ্গীতের সংস্কারে তাদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তারা সঙ্গীতে বিভিন্ন সঙ্কেত ব্যবহার করেন এবং সঙ্গীতযন্ত্রের বিষদ বিবরণ দেন। তা ছাড়া আনন্দ, বেদনা, দুঃখ, অসুস্থতা অর্থাৎ কোন পরিস্থিতিতে কী ধরনের যন্ত্র ব্যবহৃত হবে, কবিতার সুর ও ছন্দ কেমন হবে- তা ছিল তাদের গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

কবিতা সম্পর্কে নবী করিম সা: বলেছেন যে, এমন কিছু কবিতা আছে যেগুলো জ্ঞানের গভীরতায় পরিপূর্ণ। আবার কোনো কোনো বক্তার বক্তব্য কার্যকর ম্যাজিকের মতো ও চিত্তাকর্ষক। কুরআনুল করিমে নৈতিকতাবিরোধী কবিতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কুরআনুল করিমের এই বিধানের প্রতি লক্ষ রেখেই নবী করিম সা: তদানীন্তন কবিদেরকে সঠিক পথনির্দেশ দিয়েছে। তাদের জানিয়ে দিয়েছেন তাদের সীমাবদ্ধতার সম্পর্কে। বলে রাখা আবশ্যক, সে আমলের শ্রেষ্ঠতম কবিরা নিয়মিত তার দরবারে আসতেন। তারা সহজেই ভালো-মন্দের মধ্যকার পার্থক্য নিরূপণ করতে পারতেন। তাদের মেধাকেও তারা ব্যবহার করতেন যথাযোগ্যভাবে। সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলা যায় যে, শিল্পকলার বিকাশের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা নতুন নতুন এমন অনেক বিষয় উদ্ভাবন করেন যা ছিল মানুষের চিন্তার বাইরে। অথচ এ ক্ষেত্রে তারা চমৎকার রুচির পরিচয় দেন এবং ক্ষতিকর বিষয়গুলোকে সযত্নে পরিহার করেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us