ক্যাসিনো : কোটি কোটি টাকার খেলা
ক্যাসিনো : কোটি কোটি টাকার খেলা - ছবি : সংগ্রহ
ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা সিঙ্গাপুরে নয়, রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন স্পটে অবৈধ ক্যাসিনো বা জুয়ার আসরের ব্যবসা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য নেপাল, থাইল্যান্ডসহ চারটি দেশ থেকে প্রশিক্ষিত নারীদের পাশাপাশি নিরাপত্তা প্রহরীও আনা হচ্ছিল। ক্যাসিনোগুলোতে প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকা উড়ছে। ক্যাসিনোগুলোতে ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, কাটাকাটি, নিপুণ, চড়াচড়ি, ডায়েস, চরকি রামিসহ নানা নামের জুয়ার লোভ সামলাতে না পেরে অনেকেই পথে বসছেন। এতে পারিবারিক অশান্তিসহ সামাজিক নানা অসঙ্গতি বাড়ছে। ভুক্তভোগীরা সর্বস্বান্ত হলেও জুয়ার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আয়োজক চক্র। আর এ কাজে সহায়তা দিচ্ছে একশ্রেণীর প্রভাবশালী। অথচ আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু লোককে ম্যানেজ করেই দিনের পর দিন চলছে এসব কর্মকাণ্ড।
১৯৯৪ সালের দিকে আরামবাগে আগমন ঘটে ওয়ান-টেন খেলার। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার সব ক্লাবে। এ নিয়ে জুয়াড়িদের মধ্যে এতটাই উত্তেজনা ছড়ায়, যার ফলে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। ১৯৯৭ সালে দিলকুশা ক্লাবে জুয়াড়িদের হাতে খোকন নামের এক ব্যক্তি মারা যান। এর রেশ ধরে বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল জুয়ার আসর। এরপর আবার চালু হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সব ক্লাবে জুয়ার আসর নিষিদ্ধ করা হয়। ক্লাবগুলোতে র্যাব-সেনাবাহিনীর অভিযান চলত তখন নিয়মিত। এখন যুবলীগের নেতৃত্বে ক্যাসিনো অনেক জমজমাট।
গণমাধ্যম আগেই জানিয়েছিল
সংবাদমাধ্যম জুয়ার আখড়ার বাড়বাড়ন্তের খবর অনেক দিন থেকেই তাদের সাধ্যমতো প্রকাশ করে যাচ্ছিল। আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে কথিত ক্লাবগুলোর নাম ও অবস্থান দিয়ে প্রথম আলো পত্রিকায় ২০১৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বছরের পর বছর ধরে ক্লাবগুলোতে নিপুণ, চড়চড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, রেমি, ফ্ল্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের তাস খেলা বা কথিত ‘ইনডোর গেমস’-এর নামে জুয়া খেলা চলছে। ঢাকার ক্লাবগুলোর মধ্যে যাদের নাম সে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে, ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ক্লাব প্যাভিলিয়ন ফকিরাপুল, আরামবাগ ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, ডিটিএস ক্লাব, আজাদ বয়েজ ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, বিজি প্রেস স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সঙ্ঘ ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি ক্রীড়াচক্র বিমানবন্দর কমান্ড।
২০১৭ সালের ৭ জুলাই দৈনিক বণিক বার্তা জুয়ার আখড়ার রমরমা ব্যবসা নিয়ে ‘অবৈধ তবু বড় হচ্ছে’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছিল ক্লাবভিত্তিক রেস্টুরেন্টগুলোতে চলছে পশ্চিমা ধাঁচের অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা। বিদেশ থেকে প্রশিক্ষিত জুয়াড়ি এনে তাদের দিয়ে এসব ক্লাবে প্রতি রাতে বসছে জুয়ার আসর। উড়ছে কোটি কোটি টাকা। ২০১৫ সালে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগে গুলশান লিংক রোডের ফু-ওয়াং ক্লাবে অভিযান চালান র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে অনুমোদনহীন বিদেশী মদ ও বিয়ার বিক্রির অভিযোগে দু’জনকে গ্রেফতার করা হলেও ক্যাসিনোর বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
আইন কী বলে?
জুয়া এ দেশে নিষিদ্ধ। ১৮৬৭ সালে প্রণীত বঙ্গীয় প্রকাশ্য জুয়া আইন বাংলাদেশে এখনো প্রযোজ্য। সেই আইন অনুযায়ী, যেকোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এ রকম কোনো ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে ক্রীড়ারত (জুয়ারত) বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। পুলিশ জুয়ার সামগ্রীর খোঁজে যেকোনো সময় (বল প্রয়োগ করে হলেও) তল্লাশি চালাতে পারবে বলেও আইনে উল্লেখ রয়েছে।
যুবলীগের একশ্রেণীর নেতার ছত্রছায়ায় এ সর্বগ্রাসী জুয়ার আস্তানা এখন ছড়িয়ে পড়ছে আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীর অলি-গলিতেও। ক্লাবের বাইরে বিভিন্ন এলাকার গেস্ট হাউজ ও ফ্ল্যাট বাসায়ও এ ধরনের আয়োজন করা হচ্ছে। বাদ পড়ছে না বস্তি এলাকাও। নিকেতন, নিকুঞ্জ, উত্তরা, রূপনগর, খিলগাঁও, লালবাগ, হাজারীবাগ, বাড্ডার অসংখ্য বাসায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসানো হয়।
এসব আসরে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ছিনতাইকারী, ছিঁচকে চোর, পকেটমার, মলমপার্টির সদস্যরাও অংশ নেয়। উত্তরার একটি অভিজাত ক্লাবে নেপালিসহ কয়েক জন বিদেশী নারী-পুরুষের সহযোগিতায় চালানো হচ্ছে অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য। উত্তরার পাশাপাশি দক্ষিণখানে, আশকোনাতেও রয়েছে ক্যাসিনো। জুয়ার আসরগুলো থেকে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, মাস্তান, কমিউনিটি পুলিশের ইউনিট, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পিএস-এপিএসদের নাম লিখে দৈনিক বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দেয়া হচ্ছে। জুয়াড়িরা খেলতে আসা লোকদের কাছ থেকে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। জুয়া খেলতে গিয়ে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানরাও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারসহ এলাকার মানুষজন।
নেতাদের ছত্রছায়ায় চলছিল ক্যাসিনো
ঢাকার স্পোর্টস ক্লাবগুলো ঘিরে কয়েক দশক ধরে রমরমা জুয়ার আসর বসানো হচ্ছে। তবে বছর চারেক আগে এই জুয়ার আসরগুলোকে ক্যাসিনোতে উন্নীতকরণ শুরু হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজধানীজুড়ে ক্যাসিনোর বিস্তার ঘটে। ওই নেতারাই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ করে ক্যাসিনো পরিচালনা করে আসছিলেন।
এসএম গোলাম কিবরিয়া ওরফে শামীম চলাফেরা করতেন গডফাদারের মতো। সঙ্গে তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন দেহরক্ষী। বহরে থাকত অন্তত তিনটি গাড়ি। সাইরেন বাজাতে বাজাতে রাস্তা অতিক্রম করতেন। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে দেহরক্ষীরা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখতেন। রাজধানীর নিকেতন এলাকায় তিনি প্রবেশ করলেই সবাই তার উপস্থিতি টের পেতেন। এই মহাক্ষমতাধর ব্যক্তি নিজের নাম সংক্ষেপ করে বলতেন জি কে শামীম। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জি কে বিল্ডার্সের মালিক তিনি। নিজেকে পরিচয় দিতেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক বলে। গত শুক্রবার র্যাব তাকে ও তার সাত দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করেন। এরপর সেখান থেকে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র (তার মায়ের নামে ১৪০ কোটি), ৯ হাজার ইউএস ডলার, ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার, একটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং মদের বোতল জব্দ করা হয়েছে।
রাজধানীর নিকেতন থেকে গ্রেফতার ঠিকাদার এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমকে ১০ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত।
র্যাবের অভিযানের সময় শামীমের ঠিকাদারি কার্যালয়ে ঢুকেই দেখা যায়, অভ্যর্থনাকক্ষের দেয়ালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. কাওসার, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহানের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শামীমের অন্তরঙ্গ ছবি টানানো। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ের গাড়ি পার্কিংয়ের পর নকশাখচিত দুই পাল্লার দরজা পেরিয়ে ভবনটির যত ভেতরে ঢোকা গেল, ততই জৌলুস চোখে পড়ে। তৃতীয়তলায় প্রায় ৩০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া শামীমের বসার কক্ষটি দামি বাতি, কাঠ দিয়ে সাজানো।
এর আগে গত বুধবার যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গুলশানে তার নিজ বাসা থেকে আটক করে র্যাব। একই দিন ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে তার পরিচালিত অবৈধ ক্যাসিনোতেও অভিযান চালানো হয়। খালেদের গ্রেফতারের পরপরই শামীমের নাম আলোচনায় আসে।
অভিযানে থাকা র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, শামীমের মায়ের কোনো ব্যবসা নেই। তার পরও তার নামে ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে। তার দেহরক্ষীরা অস্ত্র প্রদর্শন করে বিভিন্ন জায়গা থেকে সুবিধা নিতেন।
র্যাব সূত্র জানায়, কলাবাগান ক্লাবই প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ক্যাসিনো চালুর উদ্যোগ নেয়। কলাবাগান ক্লাবের আদলে প্রথমে ভিক্টোরিয়া ও পরে একে একে ওয়ান্ডারার্স, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা, মোহামেডান, আরামবাগে স্লট মেশিন বসে। তবে সেখানে যাতায়াত ছিল এমন একটি সূত্র জানায়, কলাবাগানে স্লট মেশিন জুয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মানের বোর্ড, নেপাল থেকে প্রশিক্ষিত নারী-পুরুষদের নিয়ে আসা হয়। প্রথমে ক্লাবগুলোয় বাকারা (তাসের খেলা) নামের একটা খেলা হতো, পরে যুক্ত হয় রুলেট (চাকার মতো বোর্ড) এবং আরো কয়েকটি খেলা। প্রতিদিন কলাবাগান ক্লাবের আয় ছিল প্রায় কোটি টাকা।