হংকং : সমাজতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র
হংকং : সমাজতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র - ছবি : সংগ্রহ
হংকং চীনের অংশ হলেও এটা যেন প্রাচ্যের বুকে পাশ্চাত্যের এক ধরনের খুদে সংস্করণ। কারণ দীর্ঘদিন ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে থাকায় রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জীবনাযাত্রাসহ প্রায় সবদিকেই হংকং পাশ্চাত্যের উন্মুক্ততা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। চীনে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লব হবার প্রায় অর্থশতাব্দী পরে, হংকংকে লিজের মেয়াদ শেষে চীনের হাতে তুলে দেয় ব্রিটেন। সেই হংকং আজও কিন্তু গণতন্ত্রের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। বেইজিং সরকারও উপলব্ধি করে যে, ক্যাপিটালিস্ট হংকং কমিউনিস্ট হওয়া দূরের কথা, সোস্যালিস্ট হতে পারাও সহজ নয়। তবুও যেন চীনা কর্তৃপক্ষ চায়, হংকং তার মনমানসিকতা বদলিয়ে চীনের একদলীয় রাজনীতি, আত্মস্থ করুক। কিন্তু চীনের ‘আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’, হংকং গত তিন মাসের একটানা গণ-আন্দোলনে প্রমাণ করেছে লাল চীনের অংশ হতে নয়. স্বাধিকার ভোগেই তার সমূহ আগ্রহ। সেই অভূতপূর্ব বিক্ষোভ ও প্রচণ্ড প্রতিবাদকে চীন সরকার কঠোর দমনপীড়ন দিয়েও থামাতে বা কমাতে পারছে না। হংকংবাসী প্রায় একচেটিয়াভাবেই মুক্ত অর্থনীতি নয় শুধু, মুক্ত রাজনীতির জন্যও রাজপথে দিনের পর দিন পড়ে থাকার ঝুঁকি নিয়েছেন। ‘এক দেশ দু-অর্থনীতি’র স্লোগান চীনা প্রশাসন হংকংয়ের বেলায় মেনে নিলেও পরস্পরের প্রতি একরকম সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়ে গেছে বলেই প্রতীয়মান। চীনের কমিউনিস্ট সরকার মনে করে, পশ্চিমা উসকানির দরুন হংকং কার্যত ‘স্বাধীন’ হতে চেয়ে চীনরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লংঘন করছে। এর বিপরীতে, হংকংবাসী মনে করে, বেইজিং কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর নিজেদের খেয়ালখুশি ও মতাদর্শ চাপিয়ে দিয়ে গণতন্ত্রের অবশেষটুকুও হরণ করে নিচ্ছে। দুপক্ষই প্রতিপক্ষের আচরণকে ‘বাড়াবাড়ি’ হিসেবে উপলব্ধি করে অনড় অবস্থান নিয়েছে নিজ নিজ দাবি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য। এই প্রেক্ষাপটে হংকংয়ে অচলাবস্থা কত দিনে কাটে, তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।
পুলিশ হেফাজতে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই ঘটে আসার মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের ঘটনা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ও সভ্যজগতে সঙ্ঘটিত হওয়ার কথা নয়। তবুও এর পুনরাবৃত্তি হয়, কিন্তু যথাযথ তদন্ত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয় না। এবার এমন গুরুতর অভিযোগ উঠেছে হংকং-এর আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে। যদিও অগণতান্ত্রিক, একদলীয় এবং নিপীড়নমূলক চীনা শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের দ্বারা অমানবিক আচরণ অপ্রত্যাশিত নয়; কিন্তু হংকংয়ের মতো ‘মুক্ত হাওয়া’র অভিজ্ঞতাপুষ্ট স্থানে তা স্বাভাবিকও বলা যায় না। আন্দোলনের একজন অংশগ্রহণকারীকে চীন সরকারের একটি বাহিনীর লোকজন ‘যৌন হয়রানি’ করার অভিযোগে হাজার হাজার মানুষ হংকংয়ের রাস্তায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। এ অভিযোগে চীনের প্রশাসন যে বিব্রত, তা সহজেই অনুমেয়। এখন পরিস্থিতি প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে সামাল না দিয়ে আরো হয়রানি ও হামলা, নির্যাতন ও গ্রেফতারির পথে গেলে বেইজিং মহাভুল করবে। এদিকে, কয়েক জন নারী বিক্ষোভকারীকে পুলিশের ‘যৌন হয়রানি’র বিরুদ্ধে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশকে আয়োজকরা পাশ্চাত্যের বহুলালোচিত ‘গব ঞড়ড়’ আন্দোলনের অংশরূপেই গণ্য করছেন। এমনকি, উল্লিখিত সমাবেশেই একজন নারী অভিযোগ করেন, বিক্ষোভকালে পুলিশ তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় তার শ্লীলতাহানি ঘটেছে।
২৯ আগস্ট কোনো কোনো পত্রিকায় একটি খবর- হংকংয়ের একটি বিমান সংস্থার একজন ক্রুকে কর্মচ্যুত করার ঘটনা সেখানকার চলমান গণবিক্ষোভে নয়ামাত্রা সংযোজন করেছে। হংকংয়ের নজিরবিহীন গণপ্রতিবাদ সমাবেশ-মিছিলের মাধ্যমে অব্যাহত উত্তাল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে অনেক আগেই। এর মধ্যে হংকংভিত্তিক বিমান সংস্থা ক্যাথেপ্যাসিফিকের জনৈক ক্রুকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রতিবাদ আন্দোলনের আগুনের উত্তাপ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কনফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়ন্স-এর আহ্বানে ২৮ আগস্ট হংকংয়ের শত শত লোক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। বিমান সংস্থাটির সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভের অনুমতি না পেয়ে প্রতিবাদকারীরা মহানগরীর কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকায় এই কর্মসূচি পালন করেছে। এর প্রতি সহমর্মিতার অভিযোগে পাইলট, কেবিন ক্রু ও অন্যান্যকর্মীসহ ২০ জন স্টাফ কর্মচ্যুত হতে পারেন। কর্তৃপক্ষ বলেছে, এরা ‘শ্বেতসন্ত্রাসী’। এর জবাবে, বাকস্বাধীনতার সপক্ষে অবস্থান নিতে আহ্বান জানানো হয়। যে নারীকর্মীর চাকরিচ্যুতিকে কেন্দ্র করে এত কিছু, তিনি বলেছেন, ‘কীভাবে বিনা কারণে আমাকে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হলো?’ আসলে তিনি হংকংয়ের চলমান বিক্ষোভকে সমর্থন দেয়ায় তার কর্মচ্যুতি ঘটেছে। ক্যাথেপ্যাসিফিক আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত বিমান সংস্থা। তবে গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাদের একজন স্টাফের কর্মচ্যুতির ঘটনা সংস্থাটির ইমেজ কিছুটা হলেও ক্ষুণœ করতে পারে বৈকি।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে হংকং-এর আইন সভাতে আসামি প্রত্যর্পণ বিল উত্থাপন করা হলে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া সঞ্চারিত হয়। কারণ, যতই কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে ‘আইনশৃঙ্খলার ইস্যু’ হিসেবে দেখাক না কেন, হংকংবাসীর কাছে এটা প্রথম থেকেই গণতন্ত্রবিরোধী চীনা কর্তৃপক্ষের দমনপীড়নের নতুন হাতিয়ার হিসেবে গণ্য। আগে থেকেই মানবাধিকার ইস্যুতে হংকংয়ের মানুষ বেইজিংয়ের ওপর ক্ষুব্ধ। তাদের এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, আলোচ্য বিলটি অ্যাক্ট বা আইনে পরিণত হলে কমিউনিস্ট চীন ইচ্ছাকৃতভাবেই এর ব্যাপক অপব্যবহার করবে এবং তখন হংকং থেকে যে কোনো ‘সন্দেহজনক’ ব্যক্তিকে চীন তার মূল ভূখণ্ডে জোর করে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করতে পারে। আসামি প্রত্যর্পণ বিল বাতিলের আন্দোলনে একপর্যায়ে হংকং-এ চীনের নিযুক্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যারি লামের পদত্যাগের দাবি যুক্ত হলো। দাবির তালিকায় যোগ করা হয়েছে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশসহ মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ও। ক্রমান্বয়ে আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটে এবং প্রধানত তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা এটাকে তীব্র করে তোলে। মাঝে মাঝে এত বেশি মানুষ এতে অংশ নেয় যে, যানচলাচল, অফিস আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি বন্ধ হয়ে যায় এবং হংকংয়ের জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। ট্রেন ও প্লেনের যাতায়াতও অসম্ভব হয়ে ওঠে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী লাখো মানুষের উত্তাল ও নিয়মিত আন্দোলনে চীন সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে এর মোকাবেলায় বল প্রয়োগ করেছে বারবার। বিক্ষোভকারীরাও কখনো কখনো সহিংস হয়ে উঠেছে। যেমন- ১ জুলাই তারা আইন সভা ভবনে হামলা চালায়। চীনা প্রশাসনের নিয়োজিত নির্বাহী দাবি মানার ঘোষণা দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছেন। এ আন্দোলনের পেছনে ‘পাশ্চাত্যের হাত থাকা’র জোরালো অভিযোগ করেও বেইজিং হংকংকে বশে আনতে পারেনি। ব্রিটেনের লিজের মেয়াদ শেষ হবার পরে, ২১ বছর চীনের অধীনে থেকেও যে হংকংবাসী সমাজতন্ত্রী হয়নি, তার প্রমাণ এ আন্দোলন।