কাশ্মির : ভারতের আগ্রাসী পদক্ষেপ
কাশ্মির : ভারতের আগ্রাসী পদক্ষেপ - ছবি : সংগ্রহ
২৩ আগস্ট শুক্রবার কাশ্মিরি জনগণ ভারত সরকার কর্তৃক এর বিশেষ মর্যাদা বাতিলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই দিবসে রয়টার্সের তোলা এক ছবিতে দেখা যায়, রাজধানী শ্রীনগরের একটি এলাকায়, বাড়ির জানালায় জনৈক শিশু প্লাকার্ড উঁচিয়ে ধরেছে। এতে লেখা ডব ধিহঃ ভৎববফড়স. আসলে কাশ্মিরের নরনারী, শিশুবৃদ্ধের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ‘ভূস্বর্গ’তুল্য এই অঞ্চলের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা পোষণ করেন আজও। অনেকে হয়তো স্বাভাবিক নিয়মে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করছেন। তবে কাশ্মিরিরা ভারতের নিপীড়নমূলক শাসন ও নিয়ন্ত্রণের অনুকূলে যে নেই, তা সবার কাছে স্পষ্ট। তবুও দিল্লি সরকার মুসলিম গরিষ্ঠতাপূর্ণ কাশ্মিরকে যেকোনো মূল্যে স্বীয় নিগড়ে আবদ্ধ রাখতে মরিয়া। এ জন্য সেখানে ভারত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কঠোরতা বৃদ্ধি করেছে। এমনিতেও বিশ্বের সর্বাধিক সামরিকীকরণ করা অঞ্চল এই কাশ্মির। প্রতি আটজন বাসিন্দার পেছনে একজন করে ভারতীয় সেনা নিয়োগ করা হয়েছে। এবার কাশ্মিরে ভারতের সৈন্যসংখ্যা আরো বাড়িয়ে দেয়ায় ৮ লাখে উন্নীত হয়েছে বলে জানা যায়। তবুও কাশ্মির ভারতের জন্য ‘গলার কাঁটা’ হয়েই থাকছে, নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে। অন্য দিকে, কাশ্মিরের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং ভূকৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় ভারত এই অঞ্চলকে নিজের অন্তর্ভুক্ত রাখতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপই নিচ্ছে। নয়াদিল্লির শাসকেরা মনে করেন, কাশ্মিরকে ধরে রাখতে যত নির্যাতন করা হোক না কেন, কোনো বৃহৎ শক্তি ভারতকে তা থেকে বিরত রাখার কোনো উদ্যোগ কার্যত নেবে না।
ভারতের মোদি সরকার হঠাৎ কেন কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নিয়েছ? দেশটির সংবিধানে কাশ্মিরবিষয়ক যে ধারা ছিল গত ৭০ বছর, সেটা বিনাদ্বিধায় বাতিল করা শুধু অভাবনীয় নয়, বিরাট ঝুঁকিপূর্ণও। জানা গেছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কিছু আগাম তথ্যের ভিত্তিতে বিজেপি সরকার তড়িঘড়ি করে এহেন গুরুত্ববহ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন একদিকে কাশ্মিরে দিল্লির দমনপীড়ন এবং তার প্রতিরোধ বৃদ্ধির পাশাপাশি মোদি সরকারকে ঘরে বাইরে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে। ভারত সরকার এসবের তোয়াক্কা করবে কী করবে না, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। তবে ভারতের যে ‘গণতান্ত্রিক ইমেজ’ এ যাবৎ বিশ্বে স্বীকৃত, তা অনেকটাই ক্ষুণ্ন হতে পারে।
ঘটনা হলো, কাতারের রাজধানী দোহাতে আফগান শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছে কিছু দিন আগে, ৩ আগস্ট। এতে পক্ষ দুটি- তালেবান ও মার্কিন কর্তৃপক্ষ। এ আলোচনায় আমেরিকার প্রতিনিধিরূপে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন বহুলালোচিত কূটনীতিক জালমে খলিলজাদে। তিনি খুব চেষ্টা করেছেন যেন কোরবানির ঈদের আগেই কোনো ‘সুসংবাদ’ দিয়ে শান্তি আলোচনাকে ‘ফলপ্রসূ’ হিসেবে দেখাতে পারেন। কিন্তু তালেবান নেতারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাদের হাইকমান্ডের সাথে পরামর্শ করার দরকার বোধ করায় আলোচনা বৈঠক স্থগিত করতে হয়। ফলে ভারতের গোয়েন্দারা এ সম্পর্কে মোদিকে যে আগাম তথ্য দিয়েছিলেন, তা ভুল প্রমাণিত হলো। তারা আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘কাতারের এই আলোচনা ফলপ্রসূ হবে।’ আসলে খলিলজাদের প্রাসঙ্গিক অনুমানের ওপর নির্ভর করে এই গোয়েন্দা রিপোর্ট বানানো হয়। উল্লেখ্য, রহস্যময় খলিলজাদে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বই কেবল করেননি, ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা বিদ্যমান। আফগানিস্তানের তালেবান বলেছে, তাদের দেশের সমঝোতা তৎপরতা আর কাশ্মির পরিস্থিতি এক নয়। অপর দিকে, ভারতের সরকারি গোয়েন্দারা আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জানান, ‘আফগান শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়ে গেছে ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথেই বিশ্বের চোখ পড়বে কাশ্মিরের দিকে। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহারের পরপরই কাশ্মিরে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন প্রচণ্ড হয়ে উঠেছিল। এবার শান্তিচুক্তির পর মার্কিন সেনাবাহিনী সে দেশ থেকে সরিয়ে নেয়া হলে কাশ্মির ইস্যু পুনরায় চাঙ্গা হয়ে উঠবে।’ মোদিকে আরো জানানো হয় যে, আফগান শান্তিচুক্তি ভারতের জন্য আরো একদিক দিয়ে ক্ষতির কারণ হবে। কেননা, তখন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাবে যা ২৮ সেপ্টেম্বর হওয়ার কথা। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি এবং শক্তিশালী একজন প্রার্থী আবদুল্লাহসহ ১৭ জন প্রার্থীকে দিল্লি মদদ দিচ্ছে এ নির্বাচনে। আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেলে আফগানিস্তানে বাড়বে তালেবানের প্রভাব, যারা ভারত নয়, তার প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ। এটা শুনে মোদি কাশ্মির নিয়ে ‘বড় কিছু করে ফেলা’র সিদ্ধান্ত নেন। সে মোতাবেক কাশ্মিরের বিভাজন এবং বিশেষ মর্যাদার অবলুপ্তি সম্পন্ন হলো।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রতিনিধিত্ব করছেন। দলটি উগ্র হিন্দুত্ববাদ, তথা সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের প্রবক্তা। বিজেপির পূর্বসূরি রাজনৈতিক দলের নাম জনসংঘ, যা ১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বহুলালোচিত রাজনীতিক এবং বহুল পরিচিত স্যার আশুতোষ মুখার্জির ছেলে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি (১৯০১-৫৩)। বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দর্শনের কাণ্ডারী বিনায়ক সাভারকার তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। ফলে শ্যামা প্রসাদ হিন্দু মহাসভায় যোগ দেন এবং ১৯৩৯ সালে হলেন এ দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। মহাসভা ও জনসংঘের মতো দলগুলোর উত্তরসূরি আজকের বিজেপি।
যা হোক, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি ১৯৪৪ সালে হিন্দু মহাসভার সভাপতি নির্বাচিত হন এবং একজন সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী হিসেবে তিনি ছিলেন ব্যাপকভাবে পরিচিত। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষনেতা জওয়াহের লাল নেহরু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার মন্ত্রিসভায় শ্যামা প্রসাদকে করেন শিল্পমন্ত্রী। ১৯৫০ সালে তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন এবং ’৫২ সালে বিরোধী দল থেকে পার্লামেন্ট সদস্য হন। সংসদে তিনিই বিরোধী দলকে নেতৃত্ব দিতেন।
এদিকে কাশ্মিরে রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছিল। কারণ জম্মু এলাকার প্রভাবশালী হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রজাপরিষদ গোটা কাশ্মিরকে ভারতের সরাসরি ও সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়। ’৫৩ সালের ১১ মে ভারতীয় পার্লামেন্টে এ দাবি তোলা হলে শ্যামাপ্রসাদ এর প্রতি জোর সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দৃশ্যত এর বিরোধিতা করে। তার প্রতিবাদে রাজধানী দিল্লিতে মিছিল বের করে শ্যামা প্রসাদ গ্রেফতার হয়েছিলেন। অবশ্য কিছু দিন পরই নেহরু সরকার তাদের এই সাবেক মন্ত্রীকে ছেড়ে দেয়। সে বছর ৫ মার্চ জম্মু ও কাশ্মির দিবসে শ্যামা প্রসাদ আরো কয়েকজন নেতাকে নিয়ে গ্রেফতার বরণ করেছিলেন। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মুক্তিলাভ করেন। ৮ মে তিনি ভারত সরকারের তৎকালীন কাশ্মিরনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ কাশ্মির যাত্রা করেন। সে রাজ্যে প্রবেশকালে তাকে গ্রেফতার করে শ্রীনগরে নিশাতবাগের কাছে এক কুটিরে আটকে রাখা হয়। এই অবস্থায় অসুস্থ হয়ে ২৩ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য, শ্যামা প্রসাদ ১৯২৭ সালে কংগ্রেস থেকে মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। তিনি ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠতম ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। তার পিতাও একসময় ছিলেন একই পদে অধিষ্ঠিত।