তলপেটে ব্যথা : কেন হয়, কী করবেন
তলপেটে ব্যথা : কেন হয়, কী করবেন - ছবি : সংগ্রহ
শারীরিক সমস্যার জন্য অন্তত যেন আপনার মূল্যবান ও সুন্দর জীবনের অগ্রযাত্রা কোনোভাবেই থেমে না থাকে। এটা নির্ভর করে জীবনের প্রতি আপনার পজিটিভ ধারণা এবং কাজের ওপর। আপনার জরায়ু, ডিম্বাশয়, ডিম্বনালী আপনার অমূল্য সম্পদ। কাজেই স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়িয়ে চলুন। লিখেছেন ডা: শাহীন আরা আনওয়ারী
নাফিসা, ইউনিভার্সিটিতে এমবিএর ছাত্রী। লম্বা গড়ন, ছিমছাম। তলপেটটা একটু মোটা, এটার জন্য নাফিসার আফসোসের শেষ নেই। জামা পরলে তলপেটটা উঁচু হয়ে থাকে। ভালো দেখায় না। বান্ধবীরা উপদেশ দিয়েছে পাজামার নিচে একটা ফিটিং বেল্ট পড়তে। কিন্তু তাতে কেনো জানি বেশ ব্যথা লাগে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মাসিকের আগে তলপেট আরো ফুলে যায়। হাঁটার সময় টান লাগে। মাঝে মধ্যে ব্যথা করে। ১০-২০ পা হাঁটলেই মনে হয় তলপেটের নার্ভে টান পড়ছে। এর সাথে প্রস্রাবের বেগ হয়। ব্যথাটা আস্তে আস্তে পুরো তলপেটে ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর কোমরের দিকে ছড়ায়। উরুর দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
তখন হাঁটা অবস্থায় থাকলে একটু না বসে উপায় নেই। তো গেল মাস কয়েক আগের ঘটনা। গত দু-তিন মাস ধরে সমস্যাটা আরো বেড়েছে। মাসিক শুরু হওয়ার দু-তিনদিন আগে থেকেই তলপেটে বেশ ভালোই ব্যথা শুরু হয়। ব্যথার সাথে কখনো বমি হয়। পুরো শরীর মনে হয় অবশ হয়ে যাবে। ইউনিভার্সিটিও কামাই করতে হয়। আগে প্যারাসিটামল খেলে চলত, কিন্তু এখন পাঁচ-ছয়টা প্যারাসিটামলেও কাজ হয় না। ব্যথার যন্ত্রণা ক্রমে তীব্রতর হতে থাকে। বাসার সবাই বুঝে ফেলে নাফিসা কষ্ট পাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে বাথরুম পর্যন্ত যেতেই কী কষ্ট। তলপেটে চাপ দিয়ে ধরে প্রস্রাব করতে যেতে হয়। আবার ঘন ঘন প্রস্রাবও পায়। কিন্তু প্রস্রাব করার সময় ব্যথাটা আরো তীব্রতর হয়। তলপেট প্রচণ্ডভাবে টনটনে হয়ে ওঠে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা, এত কষ্ট! হায় খোদা, নাফিসা ভাবে, এ আবার কী রকমের অসুখ! কাজকর্ম বন্ধ করে ঘরে বসে তীব্র যন্ত্রণার দাহে নিজেকে এভাবে লুকিয়ে রাখতে রাখতে নাফিসা মানসিকভাবেও ভেঙে পড়ে। ইদানীং একটু উনিশ-বিশ হলে রেগে যায়। কখনো বা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ইন্টারনেট খুলে দেখে- এ রকম ব্যথার কী কারণ হতে পারে। কিন্তু মন ভরে না। কত কি সব লেখা আসে।
শেষে ওই একই কথা দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যান। সব সমস্যার কথা বিস্তারিত আলাপ করুন। প্রয়োজনে তলপেটের আলট্রাসনোগ্রাম করে দেখুন- জরায়ু, ডিম্বাশয় ঠিক আছে কি না? তলপেটে কোনো চাকা আছে কি না। নাফিসার তলপেটের ব্যথা এখন প্রায় সারা মাসই থাকে। তীব্রতা একটু কম হলেও ব্যথা পুরোপুরি যায় না। এর সাথে মাঝে মধ্যে দুই পা ঝিম ঝিম করে। অবশের মতো হয়ে যায় আঙুলগুলো। শরীর চলতে চায় না। পড়তে বসলে এক রাশ ক্লান্তি এসে মাথাচাড়া দেয়। ল্যাপটপের সামনেও বেশিক্ষণ বসতে পারি না। মাথা-চোখ ব্যথা করে। কেমন জানি ঝিমুনি আসে। অথচ এক গাদা হোম টাস্ক, এসাইনমেন্ট বাকি পড়ে আছে। নাফিসা এখন কী করবে? একে তো টিউশন ফির টাকা গুনতে পরিবার ক্লান্ত। তার ওপর রোগবালাইয়ের জন্য আলাদা খরচের ব্যাপারটা পরিবারকে না বলে নিজে নিজেই হজম করতে চেয়েছিল। ও ভেবেছিল তলপেটে ব্যথা তো মেয়েদের নিত্যসঙ্গী। এমনিতেই সেরে যাবে। চিকিৎসা এখন না নিলেও চলবে। এমবিএ পাসটাস করে পরে চিকিৎসা করালে চলবে। এখন কোনোমতে ব্যথাটা হজম করতে পারলেই হলো।
কিন্তু নাফিসার এই ভাবনা একদমই সঠিক ছিল না। তলপেটের এত সমস্যা নিয়ে কোনো মতেই স্বাভাবিক জীবন কাটানো যায়? পড়াশোনা, কাজকর্ম, এসব সেরে পাশাপাশি শারীরিক সুস্থতা একান্তভাবেই কাম্য। নাফিসা সহ্য না করতে পেরে মাকে সব খুলে বলে। সিদ্ধান্ত হয় ডাক্তার দেখানোর। ডাক্তার তলপেটের আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা করতে বলেন। সেখানে ধরা পড়ে নাফিসার ডিম্বাণুতে এক ধরনের সিস্ট জন্মেছে। নাম অ্যান্ডোমেট্রিয়োটিক সিস্ট। আবার সেটাকে চকোলেট স্টিত বলে। আয়তন ১০ঢ৯ সেন্টিমিটার। পেট না কেটে পেটে ছিদ্র করে এই সিস্ট সরাতে হবে। সে অপারেটশনটা হবে ল্যাপারোস্কপিক সিস্টেকমি। তবে নাফিসা যদি প্রথম অবস্থাতেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করত, মাসিকের এই তীব্র ব্যথার চিকিৎসা আরো আগে করত। তবে সিস্টের সাইজ এত বড় হতো না।
অপারেশনও লাগত না। নাফিসা ডাক্তারের সামনেই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। হায় খোদা! এ আবার কী রোগ। ডাক্তার ওকে যথাসাধ্য আশ্বাস দেন। বলেন, হাসপাতালে দু’-একদিন থাকলেই চলবে। মারাত্মক ঝুঁকি নেই। ব্যথার কষ্ট সহ্য করতে হবে না। তবে নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে। চিকিৎসা ছেড়ে দিলে এ রোগ আবার দেখা দিতে পারে। তবে অপারেশন করে সিস্ট ফেলে দেয়াই উত্তম। নাফিসাকে বিয়েশাদি করে তাড়াতাড়ি বেবি নেয়ার উপদেশও দেন ডাক্তার। নাফিসা ভেতরে ভেতরে আঁৎকে ওঠে। কি বাজে রোগ। পাস করে বিয়েশাদি করে বেবি নিতে গেলে ক্যারিয়ারের কী হবে।
নাফিসার ইচ্ছা বিসিএস দেবে, প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকবে। তার জন্য কঠোর সাধনা, ত্যাগ অত্যন্ত দরকার। নাফিসার কেন এমন হলো। কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তবে সৌভাগ্য এটা যে, নাফিসার বোন-মা কাছে এসে দাঁড়ায়। এ রকম মুহূর্তে ফ্যামিলি সাপোর্ট অত্যন্ত জরুরি। মা নাফিসাকে জড়িয়ে ধরে সাহস দেন।
আমরা তো তোমার পাশে আছি। তুমি ভালো ছাত্রী। অধ্যবসায়ী। তুমি জীবনে দাঁড়াতে পারবে ইনশাআল্লাহ। রোগ তো মানুষেরই হয়। কিন্তু তারও তো চিকিৎসা আছে। কাজেই চিন্তা করো না। ডাক্তারও সেভাবে বললেন।
নাফিসার অপারেশন হয়। পেটে সামান্য ছিদ্র করে ল্যাপারোস্কপিক পদ্ধতির মাধ্যমে, এটি একটি আধুনিক পদ্ধতি। অপারেশনের পরে পেটে দাগ থাকে না। ব্যথা, হসপিটালে থাকার সময়ও কম লাগে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরেও যেতে পারে আবার তৈরি না হয়, সে জন্য ডাক্তার মাস ছয়েকের ওষুধ দেন। আপাতত মাসিকটা বন্ধ রাখার জন্যও ওষুধ দেন। তবে নাফিসা ঠিক আগের মতো সব কাজকর্ম করতে পারবে। একদিনও ইউনিভার্সিটি কামাই করতে হবে না। কোনো হোমটাস্ক, অ্যাসাইনমেন্ট বাকি পড়বে না।
নাফিসা অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। নতুন জীবন পায় নাফিসা। পরিবারের সবাই পাত্র দেখা শুরু করেছেন। ভেতরে ভেতরে পরিবর্তনও অনুভব করে নাফিসা। মানুষটি কেমন হবে। বেবি নিতেও দেরি করতে নিষেধ করেছেন ডাক্তার। নাফিসার মনোবল আরো বাড়াতে হবে। জীবনটা তো কাজের। কোনো কাজকেই অবহেলা করা যাবে না। চিকিৎসা করাতে দেরি করায় সে ভোগান্তি হলো এ জন্য ভেতরে ভেতরে একটা অপরাধবোধে ভোগে সে। এখন নিয়মিত চেকআপে থাকতে হবে। সুন্দর জীবন। সুগঠিত ক্যারিয়ার হবে। সহযোগী হৃদয়বান স্বামী, সুন্দর সুস্থ বেবি, সবটাই চাই জীবনে।
এ তো গেল নাফিসার জীবনের সুখ-দুঃখের কথা। প্রতিটা জীবনই নাফিসার জীবনের মতো মূল্যবান।
কাজেই আপনি যখন শরীরের কোনো ধরনের সমস্যায় ভুগবেন সেটা আপনার কাজের ব্যাঘাত ঘটায় কিংবা কষ্ট পান- কখনো নিজে নিজে চিকিৎসা করতে যাবেন না, কিংবা ডাক্তারের কাছে দেরি করে যাবেন না। নাফিসার ওই সিস্টের আয়তন যদি চার সেন্টিমিটারের নিচে হতো তবে অপারেশন না করলেও চলত। এত কষ্টও পেতে হতো না। এতগুলো টাকাও লাগত না। সহজে সমাধান হয়ে যেত। এ জন্য বলছি, আপনি জীবনটাকে সুন্দরভাবে উপভোগ করুন, সময় মতো ডাক্তারের কাছে চেকআপে যান। শরীরের প্রতি অবহেলা করবেন না। শারীরিক সমস্যার জন্য অন্তত যেন আপনার মূল্যবান ও সুন্দর জীবনের অগ্রযাত্রা কোনোভাবেই থেমে না থাকে। এটা নির্ভর করে জীবনের প্রতি আপনার পজিটিভ ধারণা এবং কাজের ওপর। আপনার জরায়ু, ডিম্বাশয়, ডিম্বনালী আপনার অমূল্য সম্পদ। কাজেই স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়িয়ে চলুন।
লেখিকা : স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
চেম্বার : পপুলার ডায়াগনস্টিক, শান্তিনগর শাখা, ইউনিট-২। ফোন: ০১৭১৮২৭১৭১৯