কর্মজীবী নারীদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি কেন?
কর্মজীবী নারীদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি কেন? - ছবি : সংগ্রহ
বাংলাদেশে ইদানীং ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সার অধিক হারে ধরা পড়ছে। আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্যান্সারের অবস্থান থেকে বলতে গেলে প্রথম অবস্থানে চলে এসেছে। অন্যান্য সব ক্যান্সারের মতো ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কে জ্ঞান ও সচেতনতা গত এক দশকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
যদিও এখনো, এমনকি চিকিৎসকেরাও ব্রেস্ট ক্যান্সারের সঠিক কারণ সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত নন। তবে বিশ্বব্যাপী অনেক জরিপ যাচাইয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সাথে জড়িত বেশ কিছু ঝুঁকির কারণ আলাদা করা গেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু কারণ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেমন- নারীদের নারী হওয়ার কারণেই ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়া, ক্রমবর্ধমান বয়স, পরিবারের অন্য কারো ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার ইতিহাস, তুলনামূলক অল্প বয়সে মাসিক শুরু হওয়া, তুলনামূলকভাবে দেরিতে রজঃনিবৃত্তি বা মেনোপজ হওয়া ইত্যাদি। অন্যান্য যেসব কারণ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবন প্রক্রিয়া বা লাইফ স্টাইলের সাথে জড়িত।
এ প্রসঙ্গে আমি আজকের প্রতিপাদ্য বিষয়ে আসতে চাই। আমাদের দেশের পুরো জনগোষ্ঠীর ৫০ শতাংশ নারী এবং দেশের কর্মস্থলে অধিক হারে নারীরা এগিয়ে আসছেন। উচ্চশিক্ষা, সামাজিক পরিবেশে সহায়ক পরিবর্তন, পারিপার্শ্বিক চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন এবং সর্বোপরি দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের কারণে বাংলাদেশের করপোরেট জগতে ইদানীং অধিক হারে অগ্রগণ্য নারীদের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপ, দৈনন্দিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হওয়ায় বাড়তি দুশ্চিন্তা ও সাফল্যে পৌঁছার ক্রমবর্ধমান উচ্চাভিলাষ, এ যুগের কর্মজীবী নারীদের চিন্তা-চেতনা ও জীবনযাত্রায় ব্যাপক পজিটিভ পরিবর্তন এনেছে যা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকির পরিপুরক। আমাদের বুঝতে হবে, যদিও এই আর্থ-সামাজিক অবস্থানগুলো সরাসরি ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ নয়, তবে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সমীক্ষায় বারেবারে এই পরিবর্তনগুলোর সাথে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সম্পৃক্ততা দেখা গেছে। নিঃসন্তান বা বেশি বয়সে প্রথম সন্তান জন্মদান, সন্তানকে ব্রেস্ট ফিড না করানোর বা কোনো কারণে মায়ের বুকের দুধ পান করাতে না পারা, কায়িক পরিশ্রম কম হয় এমন জীবন যাপন, স্থূলতা, চর্বিযুক্ত খাবার ও ফাস্টফুড বেশি খাওয়া, ধূমপান বা মদ্যপান এবং হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি ইত্যাদি ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। কর্মক্ষেত্রে অধিক চাপ ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে একজন পুরুষ সহকর্মীর সাথে সমান গতিতে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদে, নারীরা ইদানীং দেরিতে বিয়ে করছে ও দেরিতে সন্তান জন্ম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বা একইভাবে কর্মস্থলের কঠিন সময়ের বেড়াজালে পড়ে অনেক কর্মজীবী মা সন্তানকে ব্রেস্ট ফিড করাতে পারছেন না। এ ছাড়াও আজকাল করপোরেট জগতে কর্মক্ষেত্রে নারীরা ডেস্কে বসেই প্রচুর কাজ করছেন এবং সময় বাঁচাতে ফাস্টফুড দিয়েই দুপুরের খাবার সেরে নিচ্ছেন, ফলে শরীরে প্রচুর চর্বি জমে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের মতোই বাংলাদেশেরও নারীরা করপোরেট জগতে সমান তালে কাজ করাতে স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো মিটিং বা অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান বা মদপানের ঝুঁকিও তাদের থেকেই যায়।
এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তবে কি করা যায়? সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে- সচেতন হওয়া।
আমাদের মেনে নিতে হবে যে, সব নারীই নারী হওয়ার কারণেই ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকেন এবং বয়সের সাথে সাথে এই ঝুঁকি বাড়ে। নারীদের অধিক হারে কর্মক্ষেত্রে আসার কারণে এবং এ সংক্রান্ত জীবন যাত্রার পরিবর্তনের ফলে, কর্মজীবী নারীদের ও করপোরেট খাতে কর্মরত সব স্তরের নারীদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি দেখা যাচ্ছে। কাজেই সচেতনতা ও ঝুঁকি নিরূপণে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাই এর একমাত্র প্রতিকার। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের নারীদের নিয়মিত প্রতি মাসে অন্তত একবার ব্রেস্ট সেল্ফ এক্সামিনেশন বা নিজে নিজে ব্রেস্ট পরীক্ষা করা উচিত। একজন জেনারেল সার্জনের কাছে গেলে তিনি এ ব্যাপারে শিখিয়ে দেবেন। নারী তার নিজের পরীক্ষায় ব্রেস্টে কোনো অস্বাভাবিকতা যেমন ত্বকের রং পরিবর্তন বা চাকা বা কুঁচকানো ইত্যাদি পাওয়া গেলে, দেরি না করে একজন জেনারেল সার্জনের শরণাপন্ন হবেন। যদি নারীর বয়স ৪০ বা তার উপরে হয়, তবে প্রতি মাসে সেল্ফ এক্সামিনেশনের পাশাপাশি বছরে একবার ম্যামোগ্রাম করা উচিত। ম্যামোগ্রাম এক ধরনের বিশেষ এক্স-রে পদ্ধতি, যার মাধ্যমে খুব আগেই ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এগুলোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যসচেতন জীবন যাপন করা বাঞ্ছনীয়, যেমন- সুষম খাদ্য গ্রহণ, চর্বি জাতীয় খাবার এবং গরু বা খাসির গোশত পরিহার ও সবুজ শাক-সবজি খাওয়া।
প্রতিদিন সময় করে নিয়মিত ব্যায়াম, সপ্তাহের পাঁচদিন অন্তত ৪৫ মিনিট ছোট ছোট পায়ে দ্রুত হাঁটার অভ্যাস করাটা উপকারী, ধূমপান বা মদপান অবশ্যই পরিহারযোগ্য।
পরিশেষে বলব, যদি কোনো নারী তার যেকোনো ব্রেস্টে চাকা অনুভব করেন, তবে মনে রাখবেন, নারীদের ত্রিশোর্র্ধ্ব বয়সে ১০ শতাংশের স্তনের চাকাই শুধু ক্যান্সারে রূপ নেয়।
যদিও বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এই ঝুঁকির হার বাড়তে থাকে। স্তনে চাকা অনুভব করলে চেপে রাখবেন না, লজ্জা পেয়ে দেরি করবেন না, অনতিবিলম্বে একজন জেনারেল সার্জনের শরণাপন্ন হোন; কারণ শুধু জেনারেল সার্জনরাই স্তনের চিকিৎসা দানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত, কাজেই সঙ্কোচ করে কোনো মহিলা গাইনি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। চিকিৎসক পুরুষ কিংবা নারী যেই হোক না কেন, সঠিক চিকিৎসক-ই রোগের সঠিক চিকিৎসা দিতে সক্ষম। এ ছাড়া কোনো প্রকারের কবিরাজি বা ঝাড়-ফুঁকের সাহায্য নিয়ে সঠিক চিকিৎসা বিলম্বিত করবেন না। মনে রাখবেন, অনেক ক্যান্সারের মতো, ব্রেস্ট ক্যান্সারও যদি শুরুতেই ধরা পড়ে, তবে এর থেকে নিরাময় পাওয়া সহজতর হয়।
লেখক : এমবিবিএস, এমএসসি (কানাডা), এফসিপিএস, এফআরসিএস (গ্লাসগো, যুক্তরাজ্য), কনসালট্যান্ট, জেনারেল অ্যান্ড ল্যাপারোস্কপিক সার্জারি
ইউনাইটেড হসপিটাল লিমিটেড, ঢাকা।