পানির অভাবে ধ্বংস হবে সৌদি আরব!
পানির অভাবে ধ্বংস হবে সৌদি আরব! - ছবি : সংগ্রহ
সৌদি আরব দুই পবিত্র মসজিদের (বায়তুল্লাহ এবং মসজিদে নববী) দেশ। তাই পুরো মুসলিম জাতির আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু দেশটি। সেখানকার সব ঘটনাই শুধু মুসলমান নয়, সব মানুষকে আলোড়িত করে। সে দেশের পানি সঙ্কট তেমনই ভাবনার একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পৃথিবীর পুরো মুসলমান মসজিদুল হারামমুখী (কাবা) হয়ে সেজদা দেয়। মুসলিম জগতের সর্বাধিক পবিত্র ও সম্মানিত এ মসজিদ অবস্থিত মক্কা নগরীতে। এ ছাড়া মুসলিমদের হৃদয়াবেগ জড়িত নবীর শহর মদিনা মুনাওয়ারা, যেখানে নবী সা: স্থাপিত মসজিদ এবং তাঁর রওজা মুবারক রয়েছে। দেশটি এখন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং পৃথিবীর যুব জনশক্তি আধিক্যসম্পন্ন দেশগুলোর অন্যতম। সেখানে অনধিক ২৫ বছর বয়সী মানুষ মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ।
নজদ, হেজাজ, পূর্ব আরব (আল আহসা) ও দক্ষিণ আরব (আল আছির) নিয়ে গঠিত সৌদি আরবের আয়তন ২১ লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার। রাজধানী রিয়াদ আকাশচুম্বী সব আধুনিক ভবন দিয়ে সাজানো এক আধুনিক নগরী। নতুন নতুন আরো ভবন শুধু রিয়াদে নয়, দেশটির আন্যান্য শহরেও মাথা তুলছে। এ চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন হয়েছে শুধু তেলের কল্যাণে। ১৯৩৮ সালে প্রথম সেখানকার পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে তেলখনির সন্ধান পাওয়া যায়। এখন সৌদি আরব আমেরিকার পর দ্বিতীয় বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী এবং বৃহত্তম তেল রফতানিকারক দেশ। তেল রফতানির আয় দেশটিকে সমৃদ্ধ করেছে। ফলে জনসাধারণের জীবনমানও হয়েছে উন্নত। আর এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে মানুষ যেমন ভোগবাদী হয়েছে, সাথে এসেছে অপচয়ের মানসিকতা।
সৌদি আরবে এখন তেল, খুবই সহজলভ্য। আর মানুষের জীবন ধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় আরেকটি তরল, ব্যবহারযোগ্য পানির রয়েছে দুষ্প্রাপ্যতা। এর সাথে যোগ হয়েছে জনগণের বেহিসাবি পানির ব্যবহার। এখন তাই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তেলে নির্মিত আধুনিক সৌদি আরব পানির অভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে না তো? এ প্রশ্নের জবাব হয়তো ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত। কিন্তু বাস্তব অবস্থা সত্যিই উদ্বেগজনক।
সৌদি আরবের পানির উৎস দুটি। একটি সাগর, অন্যটি ভূগর্ভ। দেশটির সাথে সংযুক্ত আছে লোহিত সাগর আর পারস্য উপসাগর। সাগর সন্নিহিত এলাকায় সাগরের লবণাক্ত পানি পরিশোধন করে সরবরাহ করা হয়। আর মধ্যাঞ্চলের নির্ভরতা গভীর নলকূপের মাধ্যমে উত্তোলিত ভূগর্ভের পানি। রাজধানী রিয়াদের বিরেইন এলাকায় রয়েছে পানির দুটি ফ্যাক্টরি। এর একটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত আহমদ সফর আল আসমারির ভাষায়, ‘আমরা আছি মধ্য অঞ্চলে। এখানে গভীর নলকূপই একমাত্র ভরসা।’ আল আসমারির মতো যারা পানি বিক্রির ব্যবসার সাথে জড়িত, তারা অবশ্য দেশে ভবিষ্যতে পানি সঙ্কটের আশঙ্কা দেখতে পান না। তিনি জানান, ভূগর্ভের পানিতে আরো ১৫০ বছর সৌদি আরবের চলে যাবে বলে সমীক্ষা করে পাওয়া গেছে। দেশের মাটির নিচে অসংখ্য পানির রিজার্ভ রয়েছে। সুতরাং এ এলাকায় আমাদের কোনো সমস্যা নেই।
তার এরকম নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের সাথে অবশ্য বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বাদশাহ ফয়সল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভূগর্ভস্থ পানি বিশেষজ্ঞ ২০১৬ সালে জানিয়েছিলেন, ভূগর্ভে পানির যে রিজার্ভ অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে দেশের আর ১৩ বছরের চাহিদা মেটানো যাবে। ২০০৮ সালে জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছিল, সৌদি আরবের ভূগর্ভস্থ পানির আধার দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে আসছে। বেশির ভাগ পানি ফসিল ডিপ অ্যাকুইফার (জীবাশ্ম জলের আধার) থেকে উত্তোলন করা হয়। কিছু পূর্বাভাস ধারণা দেয়, এসব উৎস ২৫ বছরের বেশি টিকবে না। সৌদি আরবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব সামান্য। সেখানে বিরেইনের মতো পানি উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ পানি অপচয় করে, তা আখেরে অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রমাণিত হবে। কারণ দেশটির ৯৮ শতাংশ বিশুদ্ধ পানিই ভূগর্ভ থেকে তোলা হয়।
মরুভূমির বুকে প্রতিষ্ঠিত রিয়াদ নগরীতে বিপদ মনে হয় অদৃশ্য। এখনো সেখানে নতুন নতুন বহুতল ভবন গজিয়ে উঠছে। তেল আবিষ্কারের সুফল হিসেবে এ শহরের পত্তন হলেও পানি যে কতটা প্রয়োজন, সে চিন্তা মনে হয় কম লোকেরই মাথায় এসেছিল। শুরুর পর থেকেই নগরীর মানুষদের খাদ্যের যোগান স্বাভাবিক রাখতে মরুভূমিতে গমের মতো এমন সব শস্য চাষের বড় বড় ফার্ম গড়ে তোলা হয়, যাতে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। দেশটির তেলের মজুদ নিয়ে বিভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। কিন্তু তেল শেষের চেয়ে পানির সঙ্কট সেখানকার বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিতে পারে। সৌদি আরবের জনগণ দৈনিক মাথাপিছু গড়ে ২৬৩ লিটার পানি খরচ করেন এবং তা বাড়ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে পানি খরচের পরিমাণ এর প্রায় অর্ধেক, ১৫০ লিটার। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিও পানি সঙ্কট বাড়িয়ে তুলছে।
সৌদি আরবের প্রয়োজনীয় পানির শতকরা ৫০ ভাগ পাওয়া যায় ভূগর্ভ থেকে। আর ৫০ ভাগের যোগান দেয়া হয় সাগরের লোনা পানি শোধন করে। মধ্যপ্রাচ্যে পানি লবণমুক্ত করার এ কাজ পানি সঙ্কটের জন্য রূপালী বুলেট হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশটিতে ৩১টি পানি লবণমুক্ত করার প্লান্ট আছে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব দুনিয়ায় এক নম্বর। পানি লবণমুক্ত করতে জ্বালানি খরচও খুব বেশি। জেদ্দার বাদশাহ আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক হিসাব করে দেখেছেন, দেশে প্রতি বছর লবণমুক্ত পানির চাহিদা ১৪ শতাংশ হারে বাড়ছে। এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং টেকসই প্রক্রিয়া নয়। লবণম্ক্তু করার প্লান্টগুলো চারপাশের পরিবেশের জন্যও বিপজ্জনক। সেগুলো বাতাসে বিষ ছড়ায় এবং সামুদ্রিক প্রতিবেশের জন্যেও ভয়ঙ্কর।
সবচেয়ে গুরুতর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে যেসব বিকল্প রয়েছে তার সবই পানি ব্যবহারের অভ্যাস পরিবর্তনের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। এ ব্যাপারে অবশ্যই মিতব্যয়ী হতে হবে। দেশটি তার লোহিত সাগর প্রকল্পে জোর দিচ্ছে। তেল অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে এখনো অক্ষত এ সাগরের বিচে বেলজিয়ামের আয়তনের সমান ‘ট্যুরিজম হ্যাভেন’ গড়ে তুলে লাখ লাখ পর্যটক আকৃষ্ট করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সেখানে ৫০টি হোটেল নির্মাণ করা হবে। এসব রিসোর্টে দৈনিক ৫৬ হাজার ঘনমিটার পানি প্রয়োজন হবে।
অনেক মানুষ সৌদি আরবে পানির এ সঙ্কটকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দিতে চান। নবীর দেশকে আল্লাহ তায়ালা সবসময় রহমতের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখবেন বলে তারা বিশ্বাস করতে চান। এ ব্যাপারে একটি কথা বলা হয়তো অবান্তর হবে না যে, আল্লাহ তার তামাম মাখলুকাতের জন্য সৃষ্ট নেয়ামতের অপচয় বা অপব্যবহার সহ্য করেন না। যে বা যারা তা করেন একসময় সেটার জন্য তাদের আল্লাহ পাকড়াও করেন।
পরিস্থিতি নাজুক উপলব্ধি করে অবশ্য দেশটির কর্তৃপক্ষ গত মার্চ থেকে কাতরাহ কর্মসূচি নামে পানির রেশনিং চালু করেছে। এর লক্ষ্য জনগণের পানি ব্যবহারের পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে ফেলা। ২০২০ সাল নাগাদ দৈনিক মাথাপিছু পানি খরচের পরিমাণ ২০০ লিটার এবং ২০৩০ সাল নাগাদ ১৫০ লিটারে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। দেশটির ঘোষিত ভিশন ২০৩০-এ খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য কৃষি ফার্মে ব্যবহৃত ৪১৬ শতাংশ পানির পরিমাণ ১৯১ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। দেশটির প্রধান খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আলমারাই তাদের ডেইরি ফার্মের গরুর খাবার উৎপাদন করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আর্জেন্টিনায় জমি কেনার চেষ্টা করছে। এসবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু ইতোমধ্যে বন্ধুর হয়ে পড়া এ পথ পাড়ি দিতে হলে আরো অনেক দূর যেতে হবে।
গোয়েন্দা এবং ভূরাজনৈতিক তথ্যাদি বিশ্লেষণের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ড. রেবেকা কেলার বলেন, সৌদি আরবে পানির উৎসগুলো যে হারে পুনঃভরণ হয়, দেশটি তার চারগুণ পানি ব্যবহার করছে। টেকনিক্যালি তারা জীবাশ্ম পানি (ভড়ংংরষ ধিঃবৎ) ব্যবহার করছে। এ পানির পুনঃভরণের হার খুব, খুবই কম। তিনি গুরুত্ব বোঝাতে এভাবেই বলেন। তিনি বলেন, এটা মরুভূমি। এখানে পানি প্রাকৃতিকভাবেই দুর্লভ। সৌদি আরবকে অবশ্যই তা মাথায় নিয়ে চলতে হবে।