গণিতশাস্ত্রে মুসলিম মনীষা
গণিতশাস্ত্রে মুসলিম মনীষা - ছবি : সংগ্রহ
গণিতশাস্ত্রে মুসলিম গণিতবিদদের অবদান বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। প্রথম ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দের একদল মুসলিম পণ্ডিত গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দান করেন। তাদের অবদানের ওপর। আলোকপাত করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
আল খাওয়ারিজমি (৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দ) রচনা করেন আল জামি ওয়াত তাফারিক বি হাসিব আল হিন্দনামে গণিতশাস্ত্রের ওপর একখানা অমূল্য গ্রন্থ, যাতে তিনি শূন্য এবং দশমিক চিহ্নের ব্যবহার প্রথম দেখান। আল খাওয়ারিজমি জ্যোতিষ শাস্ত্র ও ত্রিকোণমিতিতেও বিশেষ অবদান রাখেন। অ্যালজেবরার ওপর তিনি কিতাব আল জবর ওয়াল মুকাবিলাগ্রন্থ রচনা করেন। আল খাওয়ারিজমিকে আধুনিক অ্যালজেবরার জনক মনে করা হয় না, বলা হয় আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিক ডাইয়োকান্টোস (২৫০ খ্রিষ্টাব্দ) আধুনিক অ্যালজেবরার স্রষ্টা, তবে এ কথা সত্য বলে স্বীকার করতে হবে যে, আল খাওয়ারিজমি প্রথম অঙ্কবিদ যিনি অ্যালজেবরা ও জ্যামিতির মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করেন। তিনি রেখাগত এবং সমচতুষ্কোণসহ সমীকরণের জ্যামিতিক সমাধান দেন। নির্দ্বিধায় বলা যায়, আল জবর শব্দটি আরবদের আবিষ্কার এবং আধুনিক অঙ্কের অ্যালজেবরা শব্দটি এখান থেকেই এসেছে।
গণিতশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ শাখা অ্যালজেবরার অগ্রগতি সাধনে যেসব মুসলিম গণিতবিদ অবদান রাখেন। তাদের মধ্যে আবু কামিল সুজা (মৃত্যু ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে), ইবনে আল হাইতামের (মৃত্যু ১০৪১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে) নাম করতে হয়। এ ছাড়া প্রখ্যাত দার্শনিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ ওমর খৈয়ামের অবদানের কথা বলে শেষ করার নয়।
ওমর খৈয়ামের অ্যালজেবরা গ্রিকদের অ্যালজেবরা অপেক্ষা উন্নত ছিল। ওমর খৈয়ামের কাজ আল খাওয়ারিজমির অপেক্ষা উন্নতমানের ছিল। আল খাওয়ারিজমি সমচতুষ্কোণের ধারণা প্রদান করেন। অপর পক্ষে ওমর খৈয়াম কিউবিক সমীকরণ সমস্যার সমাধান দেন। তৃতীয় ও চতুর্থ ডিগ্রির সমীকরণের সমাধান করেন। তিনি তৃতীয় ডিগ্রি পর্যন্ত অ্যালজেবরার সমীকরণে শ্রেণী এবং সমরূপ অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করেন। আবুল জুদ, আবিত বিন কারা, আবু জাফর আল খাজিন, আল খুজানদি প্রমুখ গণিতে আধুনিক অ্যালজেবরায় বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হন। আধুনিক অ্যালজেবরার কিছু দিক তাদের লেখা থেকেই আহরিত হয়েছে।
গণিতশাস্ত্রের অপর শাখা জ্যামিতির উন্নতিতে আরবের প্রখ্যাত অনুবাদক ও জ্যামিতিবিদ আবিত বিন কারা বিশেষ অবদান রাখেন। প্রথম সহস্রাব্দে যেসব মুসলিম জ্যামিতিবিদ জ্যামিতির ওপর গবেষণা করেন এবং জ্যামিতির উন্নতিকল্পে নিবেদিত হন তারা হচ্ছেন- আল মাহনি (মৃত্যু ৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দ), আল নাইরিজি (৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলে অনুমান করা হয়), ইবনে আল হাইতাম (মৃত্যু ১০৪১ খ্রিষ্টাব্দে) এবং আবুল ওয়াকা (মৃত্যু ৯৯৭ এর দিকে)। এদের মধ্যে আবুল ওয়াকা ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান জ্যামিতিবিদ। তিনি অধিবৃত্তের কৌণিক ব্যবধান এবং অধিবৃত্তের নতুন ধারণা দান করেন। তিনি জ্যামিতিশাস্ত্রের সাইন টেবল নির্মাণে একটি নতুন পন্থা উদ্ভাবন করেন, যা ছিল লগ বুক ব্যতীত একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
আরব মুসলিম গণিতবিদেরা ত্রিকোণমিতিতে বিরাট সাফল্য লাভ করতে সমর্থ হন। ত্রিকোণমিতিতে আবুল ওয়াকা মৌলিক অবদান রাখেন। তিনি একটি বা বহুত্রিভুজের কোণের সংযোজনে ফর্মুলা আবিষ্কার করেন।
প্রথম সহস্রাব্দ ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথমভাগে যেসব আরব গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ তাদের মূল্যবান গবেষণার ওপর গ্রন্থ রচনা করেছেন তা আরবি ভাষা থেকে হিব্রু, ল্যাটিনসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। আরব গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদদের রচিত গ্রন্থের অনুবাদ সম্পর্কে এখানে ধারণা দিলে তাদের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। একাদশ শতাব্দীতে আরবি থেকে হিব্রু ও ল্যাটিন ভাষায় বিভিন্ন গ্রন্থ অনূদিত হয়।
আডেলার্ড অব বাথ (মৃত্যু ১২৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) জ্যোতির্বিজ্ঞান-বিষয়ক বেশ কয়েকখানা গ্রন্থ আরবি ভাষা থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। গণিতশাস্ত্রের মুসলিম পণ্ডিত আল খাওয়ারিজমির আল জামি ওয়াত তারিক বি হাসিব আল হিন্দ গ্রন্থটিকে অ্যাডেলাউ ল্যাটিন ভাষায় Aljoritmi de Newer Indorium নামে অনুবাদ করেন। এই অনুবাদ গ্রন্থের সাহায্যে গণিতশাস্ত্রে আল খাওয়ারিজমি অবদান সম্বন্ধে পাশ্চাত্য জগৎবাসী জ্ঞাত হয়।
গণিতশাস্ত্রে মুসলিম গণিতজ্ঞদের অতীত অবদানের ওপর ভিত্তি করে আধুনিক গণিতশাস্ত্রের বিকাশ সাধন ঘটায় আমরা তাদের কাছে চিরঋণী- এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে।