আফগানিস্তানে স্বপ্নভঙ্গের শিকার হচ্ছে ভারত!
আফগানিস্তানে স্বপ্নভঙ্গের শিকার হচ্ছে ভারত! - ছবি : সংগৃহীত
ক্যাম্প ডেভিডে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি ও তালেবান প্রতিনিধিদের মধ্যে অনুষ্ঠেয় পরিকল্পিত গোপন আলোচনা এর এক দিন আগে বাতিল করা হয়। দোহায় মার্কিন বিশেষ দূত জালমি খালিলজাদ ও তালেবানের মধ্যে প্রায় এক বছর ধরে চলা আলোচনার ফলে যে খসড়া শান্তিচুক্তি হয়েছে তা নিয়ে আফগান প্রেসিডেন্ট ও মার্কিন নেতৃত্বের কিছু অংশের মধ্যকার মতানৈক্য দূর করা।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, পররাষ্ট্র দফতর ও পেন্টাগনের মধ্যে ঐকমত্যের অভাব থাকলেও আলোচনা এগিয়ে চলেছে। এটা হয়েছে ২০২০ সালের পরবর্তী নির্বাচনের আগে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষার বাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনড় মনোভাবের কারণে।
মার্কিন সরকারের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও তিনি আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করেন। খালিলজাদ ও তালেবানের মধ্যে ৯ রাউন্ড আলোচনার প্রতিটি পর্বের পর মার্কিন সরকার তা এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে।
নির্বাচনী বছরকে সামনে রেখে ট্রাম্প চেষ্টা করছেন তালেবানের সাথে একটি চুক্তি করে আমেরিকান সৈন্যদের বেশির ভাগ ফিরিয়ে আনার জন্য। এটি ছিল ট্রাম্পর একক উদ্যোগ। তার ন্যাটো মিত্ররা, আফগান সরকার ও ভারত (নতুন ঘনিষ্ঠ মিত্র) এই আলোচনায় কখনো অংশ ছিল না, তবে তাদেরকে অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত রাখা হচ্ছিল।
শান্তিচুক্তির সর্বশেষ খসড়া যখন প্রেসিডেন্ট গনিকে দেখানো হয়, তখন তাকে এর কপি রাখতে দেয়া হয়নি! সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে যাদের বাদ রাখা হয়েছিল, তাদের মধ্যে সন্দেহাতীতভাবেই এ নিয়ে হতাশ হয়েছিল। আফগানিস্তানে কয়েক শ’ পুলিশ ও সৈন্য মোতায়েনকারী জার্মানি আফগানিস্তানে সব প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছিল, সর্বোচ্চ সংখ্যক জার্মানকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিল এই নিরাপত্তার হুমকির কথা বলে, বাকিদেরকে উত্তর আফগানিস্তানের দৃশ্যত নিরাপদ স্থানে রেখেছিল। অন্যান্য ন্যাটো সদস্যও একই কাজ করতে পারে।
আলোচনার সময় নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান আরো শক্তিশালী করার জন্য আফগান সরকারের ওপর তারা চাপ সৃষ্টি করে গেছে একের পর এক হামলা চালিয়ে। এসব হামলায় অনেক আফগানের পাশাপাশি বিদেশীরাও নিহত হয়েছে।
এসব চাপের কারণেই তালেবান খসড়া শান্তিচুক্তিতে তাদের অনেক দাবির প্রতি স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছে। এখন শান্তিচুক্তি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাওয়ায় মনে হতে পারে যে তালেবান হয়তো সর্বশেষ হামলাগুলো চালিয়ে ভুল করে ফেলেছিল।
সাময়িক বিজয়ী মনে হচ্ছে তাদেরই যারা শান্তিচুক্তিকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করেছিল, চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টাকে দুঃখজনক ভেবেছিল। গানি ও তার সরকার ছাড়া অন্য যারা এমন ভাবনায় ডুবে আছে তাদের মধ্যে রয়েছে ভারত।
পাকিস্তানের প্রতি সহজাত বিদ্বেষের কারণে আফগানিস্তান ও আফগান মাটিকে ভারত ব্যবহার করছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ নির্মাণের জন্য, যাতে পাকিস্তান বাধ্য হয় দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে। আফগানিস্তানের লোকজন ডুরান্ড লাইনকে (আফগানিস্তানের সাথে থাকা পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত) গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে আফগানিস্তানে পাকিস্তানবিরোধী অনুভূতি থাকায় ভারতের এই কৌশলটি সহজেই প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে।
কয়েক বছর ধরে আফগানিস্তানে বন্ধুত্ব প্রদর্শন করছে ভারত সেখানে বিশাল কূটনৈতিক দল রেখে, অবকাঠামো খাতে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।
ভারত ১৯৮০-এর দশকে রুশ দখলদারিত্বের সময় আফগানিস্তানে একটি ছাপ রেখে আসতে পেরেছিল সোভিয়েতদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে। রুশ প্রত্যাহার ও আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধের সময় ভারত উদ্বেগে ছিল তালেবানে সাথে সুসম্পর্কের জের ধরে আফগানিস্তানে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেখে।
পরিস্থিতি ভারতের দিকে আবার ফিরে যায় পাকিস্তানের ইউ-টার্ন নেয়ার কারণে। ২০০১ সালে তালেবানের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নেয় পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মিত্ররা যুদ্ধ করছে, তাদের জীবন দিচ্ছে, আর ভারত এর ফল কুড়িয়ে নিচ্ছে।
আফগানিস্তানে কখনোই ভারতের প্রত্যক্ষ সামরিক উপস্থিতি ছিল না। তবে আফগান জাতীয় সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং জাতীয় গোয়েন্দাদের সব বিভাগেই ভারতীয় সামরিক বাহিনীর দৃঢ় সম্পৃক্ততা ছিল। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কার্যত ভারতীয়রাই পরিচালনা করে।
বাস্তবতার দিক থেকে আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনডিএসআই) ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এরই একটি শাখা। ফলে গানির ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এ এনডিএসআইয়ের সাবেক প্রধান আসলে ছিলেন আসন্ন নির্বাচনে ভারতীয় প্রার্থী।
আফগানিস্তানে হাজার হাজার ভারতীয় বিভিন্ন নির্মাণ কোম্পানি, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা বা ভারতীয় কনস্যুট ও দূতাবাসগুলোতে কাজ করে যাচ্ছে। ভারতের চারটি কনস্যুলেটের সবগুলোই গুপ্তচর বৃত্তির ঘাঁটি, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে বিচ্ছিন্নবাদী বিদ্রোহীদের সাহায্য করছে।
ভারতীয় প্রভাবের একটি সম্ভাব্য খাত শিক্ষা। প্রতি বছর ভারত সরকারের স্কলারশিপে সহস্ত্রাধিখ আফগান ছাত্র ভারতে যাচ্ছে। ভারত-আফগান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে লেখক ও শিল্পীরা উপকৃত হচ্ছে।
এছাড়া আফগান সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজটিও করছে ভারত। কাবুল থেকে কান্দাহার পর্যন্ত পশতুদের মধ্যে এসব কারণেই ভারতের প্রতি ব্যাপক সমর্থন দেখা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র যখন শান্তি আলোচনা করছিল, তখন ভারত ভাবছিল, শান্তিচুক্তি হলে কী হবে। এখন পর্যন্ত ভারত যোগাযোগ করেনি তালেবানের সাথে, তালেবানও ভারতীয়দের সাথে আলোচনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।
তবে ভারত চাচ্ছে তালেবান ঘাঁটি জাতিগত পশতুদের সাথে সংলাপে বসতে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ায় সাময়িকভাবে হয়তো ভারত লাভবান হবে। কিন্তু এর ফলে মার্কিন প্রশাসন, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল ও পেন্টাগনের মধ্যে অন্তঃদ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যেতে পারে।
যেকোনো মূল্যে তালেবানের সাথে চুক্তি করার বিপক্ষে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন। তিনি প্রতিটি ইস্যুতে পাকিস্তানের বিরোধিতা করতেন। কিন্তু অন্য মার্কিন কূটনীতিকরা পরিস্থিতি সামাল দিতেন। তালেবানের সাথে আলোচনা বাতিল হয়ে যাওয়াতেই সম্ভবত তাকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন ট্রাম্প। হয়তো বোল্টনের পরামর্শেই আলোচনা বাতিল হয়েছিল। কিন্তু পরদিন সকালে বাস্তব অবস্থা দেখে তিনি হতাশ হয়েছিলেন।
কত দ্রুত চুক্তি হবে তা নির্ভর করবে ট্রাম্প তার নীতি আবার প্রয়োগ করতে শুরু করতে পারেন, তার ওপর। তবে ভারতকে হতাশ করে খুব দেরি হওয়ার আগেই শুরু হয়ে যাবে।