চীনা অগ্রগতি কি রুখতে পারবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র জোট?
চীনা অগ্রগতি কি রুখতে পারবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র জোট? - ছবি : সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে এই দুই দেশের মধ্যে পূর্ণ জোট গঠন অসম্ভব হলেও চীনের উত্থানের বিরুদ্ধে ভারসাম্য সৃষ্টি প্রশ্নে সাধারণ সমঝোতায় তারা পৌঁছাতে পারেন, কারণ এতে তাদের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে।
‘দি ইন্ডিয়া ডিভিডেন্ড: নিউ দিল্লি রিমেইন্স ওয়াশিংটনস বেস্ট হোপ ইন এশিয়া’ শীর্ষক প্রবন্ধে (এটি প্রকাশিত হয়েছে ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে সেপ্টেম্বর/অক্টোবর সংখ্যায়) ইউএস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের হেনরি এ কিসিঞ্জির সিনিয়র ফেলো রবার্ট ডি ব্ল্যাকউইল ও কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো অ্যাশলে জে তেলিস উল্লেখ করেন যে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অংশীদারিত্বকে ফলপ্রসূ করার জন্য উভয় পক্ষকে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে তাদের মূল অভিন্ন স্বার্থ নিহিত রয়েছে উদীয়মান চীনের সাথে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা- এবং সব গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত ইস্যুতে ঘনিষ্ঠ জোট বা মিত্রতা স্থাপনের প্রত্যাশা না করা।
ভারত সরকার প্রকাশ্যে ঘোষণা করেনি যে তারা চীনের উত্থানের সাথে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের কোনো কৌশল গ্রহণ করছে। তবে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এই পথেই অগ্রসর হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ক্ষমতার ভারসাম্য তত্ত্ব এই ধারণা দেয় যে কোনো দেশ যদি তার ওপর অন্যদের আধিপত্য প্রতিরোধ করতে চয়, তবে তাকে অবশ্যই ক্ষমতা থাকতে হবে কিংবা অন্যদের প্রতিভারসাম্য মোকাবিলায় নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই তত্ত্বে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সতর্কতা ও বৃত্তাবদ্ধ থাকার ওপর জোর দেয়া হয়।
বাস্তবে ক্ষমতার ভারসাম্য বলতে সাধারণত যা বোঝায় তা হলো প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলার জন্য কোনো নির্দিষ্ট শক্তিশালী দেশের জোট বা সামরিক মিত্রতা গঠন। স্নায়ু যুদ্ধ হলো এর ক্লাসিক্যাল উদাহরণ। এছাড়া এ ধরনের ভারসাম্য বৈরিতাও বাড়াতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনের উত্থানের মধ্যে অনেক আমেরিকান আবারো ক্ষমতার ভারসাম্য তত্ত্বটি সামনে নিয়ে এসেছেন। চীন প্রশ্নে ওয়াশিংটনের কৌশলগত বিকল্পও চীনকে সংযত রাখার ভারসাম্যে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ও চীনা উত্থান নিয়ে ভারতের উদ্বেগে এটা কিছুটা দেখা যায়।
অতীতে চীন ও ভারত বিরোধে জড়িয়েছিল এবং তাদের মধ্যে এখনো সীমান্ত ইস্যু নিষ্পত্তি হয়নি। এছাড়া ভারতের ঐতিহ্যবাহী প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে পাকিস্তান।
নয়া দিল্লি আশা করছে বেইজিংয়ের সাথে ক্ষমতার ভারসাম্যের মাধ্যমে তুলনামূলক ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে তার স্বার্থ নিশ্চিত করা যাবে। বিষয়টি বোধগম্য।
অবশ্য, ভারত ক্ষমতার ভারসাম্য বলতে যে স্বপ্ন দেখছে, তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ক্ষমতার ভারসাম্যের লক্ষ্য হলো এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার প্রাধান্য বজায় রাখা ও চীনকে সংযত রাখা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কয়েকটি এশিয়া-প্যাসিফিক দেশ বাস্তবিকই মার্কিন প্রাধান্যমূলকব্যবস্থঅয় তুলনামূলক স্থিতিশীলতা উপভোগ করেছিল। কিন্তু আঞ্চলিক কাঠামোটি বদলে যাচ্ছে। চীনের উত্থান এসব পরিবর্তনের অংশ মাত্র। ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোরও উত্থান ঘটছে, তারাও এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন অব্যাহতভাবে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে হালনাগাদ করছে। নয়া দিল্লি তার প্রতিবেশীদের সাথে সহযোগিতা জোরদার করছে, লুক ইস্ট নীতি এরই ফসল। ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে চীনের সহযোগিতাও নজিরবিহীন বেড়েছে। এ ধরনের পরিবর্তনের মধ্যে সেকেলে ক্ষমতার ভারসাম্য তত্ত্বের কোনো স্থান নেই। কোনো শক্তিই চীনা অর্থনীতিকে এগিয়ে যাওয়া রুখতে পারবে না। চীনের বাড়তে থাকা শক্তি অবশ্যই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের কাঠামোকে বদলে দেবে এবং বাইরের শক্তি বা সামরিক শক্তিগুলোর কোনোটিই এর সাথে ভারসাম্য স্থাপন করতে পারবে না। আঞ্চলিক দেশগুলোর প্রয়োজন নতুন ব্যবস্থা নির্মাণ করা।
চীনের সাথে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ভারতের নিজস্ব স্বার্থগুলোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। চীনা উন্নয়ন অপ্রতিরোধ্য হওয়ায় এবং তা এই অঞ্চলের সাধারণ উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় চীনের বিরুদ্ধে ঘেরাওয়ের আয়োজন চীনের সাথে সহযোগিতার করলে যেসব সুযোগের সৃষ্টি হতো, তা হারানোর আশঙ্কা সৃষ্টি করবে।
ভারতের বিষয়টি চিন্তা করা উচিত। চীনের সাথে সহযোগিতা জোরদার করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে যৌথভাবে চীনের উত্থান ঠেকানো আঞ্চলিক দেশগুলোর জন্য অসম্ভব। একেবারে শুরুতে হয়তো এ ধরনের কৌশলে কাজ হতো। কিন্তু সঙ্কটজনক মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে একটি বিকল্প বেছে নিতে হবে।
ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কৌশলটির উদ্ভব ঘটেছে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কূটনীতি থেকে। এতে অতীতে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট পররাষ্ট্রনীতি প্রতিফলিত হয়েছে। বর্তমানের বিশ্বায়ন করা দুনিয়ায় এশিয়ার দেশগুলোর কাছে অপেক্ষাকৃত ভালো বিকল্প আছে বলেই মনে করা হয়ে থঅকে। এটা কেবল ভারতের জন্যই নয়, চীনের জন্যও একটি পরীক্ষা। উভয়ের উচিত হবে এই কৌশলগত ফাঁদ থেকে একসাথে বের হয়ে যাওয়া।
লেখক : সিনিয়র সম্পাদক, পিপলস ডেইলি
গ্লোবাল টাইমস