ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ অনিবার্য!
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ অনিবার্য! - ছবি : সংগ্রহ
এক সময় বিশ্লেষকরা মনে করতেন, সিরিয়া বা লেবাননের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ইসরাইল আর ইরানের মধ্যেকার উত্তেজনা যতই তীব্র হোক বা বিক্ষিপ্ত আক্রমণের ঘটনা যতই ঘটুক, একেবারে সরাসরি যুদ্ধ বেধে যাওয়া সেটা হয়তো হবে না। কিন্তু ইসরাইলের উত্তর সীমান্ত এলাকার কৌশলগত প্রেক্ষাপট দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
ইসরাইলের জন্য এই অঞ্চলে ‘ইরানি প্রভাব মোকাবেলা’ বহু পুরনো অ্যাজেন্ডা। ইরানের নেতারা ইহুদি রাষ্ট্রটির ঘোরতর বিরোধী এবং তারা ‘ইসরাইলকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার’ কথা বলেছেন। ইসরাইলবিরোধী অনেক উগ্র গোষ্ঠীকে সমর্থনও দিচ্ছেন। তাদের পরমাণু কর্মসূচিই যে শুধু ইসরাইলের মাথাব্যথার কারণ তা নয়, ইরানের হাতে আছে দীর্ঘপাল্লার এবং জাহাজ ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্রের মতো উন্নত অস্ত্রও। এসব অস্ত্র লেবাননের হিজবুল্লাহকে দিয়েছে ইরান।
সিরিয়ায় ইরানের নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য, কর্মকর্তা ও সামরিক উপদেষ্টা ছাড়াও কুদস নামে মিলিশিয়া বাহিনীও আছে- যারা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে। সিরিয়ায় যুদ্ধে আসাদের সমর্থনে ইরানসমর্থিত একাধিক বাহিনী এখন সেখানে সক্রিয়। আর তাই তারা এখন ইসরাইলের সীমান্তের খুব কাছে চলে এসেছে।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সিরিয়ার ক্ষমতায় টিকে গেছেন এবং তা প্রধানত ইরানের সমর্থনেই। রাশিয়া যদিও বাশার আল আসাদের সমর্থক, কিন্তু তারা সিরিয়ায় ইরানি প্রভাব কমাতে বা উচ্ছেদ করতে কোনো চাপ প্রয়োগ করছে না। ইসরাইলিরা বলছে, সিরিয়ার ভেতরে সম্প্রতি অস্ত্রগুদাম, ব্যারাক, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি তৈরি করেছে ইরান। লেবাননের বেকা উপত্যাকায় হিজবুল্লাহ উন্নতমানের গাইডেড মিসাইল কারাখানা তৈরির পরিকল্পনা করছে।
স্যাটেলাইটে ছবিসহ বিবৃতিতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, ইরানের সহযোগী হিজবুল্লাহ আল-নবী শিট এলাকার বেকা গ্রামের কাছে অস্ত্রাগার নির্মাণের জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি এনেছে সেখানে গাইডেড মিসাইল তৈরির জন্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। একাধিক ঘটনা ও পদক্ষেপে তার আভাস মিলেছে। আর এসব ঘটনা-পদক্ষেপ থেকে এটা মনে হচ্ছে যে, সঙ্ঘাতপূর্ণ ও অশান্ত মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ উসকে দিতে চাইছে ইসরাইল।
যদিও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক সক্ষমতায় তুরস্ক রয়েছে সবার ওপরে আর তারপর মিসর। তবু তৃতীয় স্থানে থাকা ইসরাইলের সাফল্যই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত। এরপর ইরান ও সৌদি আরবের অবস্থান। এদের চেয়ে সামান্য পিছিয়ে আছে সিরিয়া, ইরাক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু সেনাবাহিনীর আয়তন আর অস্ত্রসম্ভার দিয়ে সামরিক সক্ষমতার এসব তুলনামূলক অবস্থান সবসময় শক্তিমত্তার প্রকৃত চিত্র দেখায় না। বরং সামরিক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও নৈপুণ্যে সবার চেয়ে ইসরাইল এগিয়ে রয়েছে। আর ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের প্রতিটি আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরব দেশগুলো পরাজিত হয়েছে। তাই ইসরাইলের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা এসব দেশের নেই। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কৌশলগত কারণে সৌদি আরব ও মিসর এখন পরোক্ষভাবে ইসরাইলের মিত্র। তুরস্ক সরাসরি শত্রুতা এড়িয়ে চলার পথ নিয়েছে। বাকিরাও কমবেশি নিরাপদ দূরত্বে থাকাকে মঙ্গলজনক মনে করে। গোল বেধেছে সিরিয়া ও ইরান নিয়ে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে সিরিয়ার গোলান উপত্যকা দখল করার পর ১৯৮২ সালে লেবাননে আগ্রাসন চালানোর সময় তা দামেস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত করার পরিকল্পনাও ছিল ইসরাইলের। আর সিরিয়ার সাথে চিরশত্রুতা আরো চরমে উঠেছে ইরান-সিরিয়া সখ্যতায়। লেবাননে হিজবুল্লাহ ও গাজায় হামাসকে বিভিন্নভাবে সহায়তা-সমর্থন দেয়ায় ইরানের ওপর ক্ষিপ্ত ইসরাইল। আরবদের সাথে সঙ্ঘাতের ইতিহাসে ইসরাইলি সেনাবাহিনী একমাত্র হিজবুল্লাহ গেরিলাদের কাছেই একপ্রকার নতিস্বীকার করেছে, আর সেটা ২০০৬ সালে।
লেবাননের মাটিতে ৩৪ দিনের এই সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে শেষ হয়। ইসরাইল স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী দিয়ে লেবাননে হিজবুল্লাহর বিভিন্ন ঘাঁটিতে আক্রমণ চালালে লেবাননের প্রধান বিমানবন্দরসহ অনেক ভৌত অবকাঠামো ও ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। শ’খানেক হিজবুল্লাহ সদস্যসহ প্রায় দেড় হাজার লেবাননি নাগরিক প্রাণ হারায় এবং ১০ লাখ সাময়িকভাবে বাস্তুচ্যুত হয়। বিপরীতে সেনাসহ প্রায় দেড়শ’ ইসরাইলি নিহত হয় এবং তিন থেকে পাঁচ লাখ ইসরাইলি যুদ্ধ চলাকালীন হিজবুল্লাহর রকেট হামলা থেকে আত্মরক্ষায় সাময়িকভাবে ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংকারে ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়।
৩৪ দিনের এই যুদ্ধ আসলে ছিল ইসরাইল-ইরান পরোক্ষ যুদ্ধ। ইরানের কৌশলী সহায়তায় হিজবুল্লাহ বাহিনী অসম শক্তির এই লড়াইয়ে একপর্যায়ে ইসরাইলকে গেরিলা যুদ্ধে নামতে বাধ্য করে। যুদ্ধ চলাকালে বারবার ইসরাইলি সেনাবাহিনীর রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে রীতিমতো চমক দেখায় হিজবুল্লাহ। এ কারণে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও ইসরাইল হিজবুল্লাহকে কাবু করতে ব্যর্থ হয়। বিষয়টি ইসরাইলের কর্ণধারদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে তা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ গড়ার পরিকল্পনাকে অনেকটাই গড়বড় করে দেয়। এই যুদ্ধ চলার সময় তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইস লেবাননে ইসরাইলি বোমাবর্ষণকে নতুন মধ্যপ্রাচ্যের প্রসববেদনা বলেও অভিহিত করেছিলেন।
এটা ঠিক, ৩৪ দিনের ওই যুদ্ধের পর গত এক যুগে ইসরাইল আর হিজবুল্লাহ কোনো সঙ্ঘাতে জড়ায়নি। কিন্তু এই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে, যা আসলে অঞ্চলটির অস্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো সিরিয়া যুদ্ধ, যা ২০১১ সালে শুরু হয়। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠলে সিরীয় বাহিনীর সাথে সঙ্ঘাত বাধে, যা ব্যাপক গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।
সিরিয়া যুদ্ধে ইসরাইল প্রথম দিকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়নি, তবে নেপথ্যে আইএসআইএসকে সহযোগিতা করে এসেছে। ইসরাইলের মূল উদ্বেগ হলো ইরান। বাশার বাহিনীকে সহযোগিতা করতে হিজবুল্লাহর সদস্যরা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধের ময়দানে নেমেছে। এতে করে হিজবুল্লাহর যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা বেড়েছে, অস্ত্রভাণ্ডারে অস্ত্র জমা পড়েছে। আর এসব অস্ত্রের চালান এসেছে মূলত ইরান থেকে। বাশার বাহিনীর টিকে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সিরিয়ার মাটিতে ইরানের ঘাঁটি গাড়ার পরিধি অনেক বেড়ে গেছে। এটা ইসরাইলকে বড়ভাবে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। সে জন্য ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অস্ত্রশস্ত্র বহনকারী সন্দেহজনক বিভিন্ন বিমান ও স্থল যানবাহনে ইসরাইল হামলা চালিয়েছে, যার সব কটিই হয়েছে সিরিয়ার আকাশ ও ভূমিতে। আবার গত ডিসেম্বর থেকে ইসরাইলি বাহিনী উত্তর দিকে লেবানন সীমান্ত ঘেঁষে মাটির নিচে হিজবুল্লাহর ছয়টি সুড়ঙ্গপথ ধ্বংস করেছে।
বাড়ির পাশের শত্রুর বাড়িতে আরেক শত্রু এসে হাজির হলে যে কারোরই ঘুম হারাম হতে পারে। ইসরাইলের অবস্থা এখন অনেকটা সে রকম। সে জন্য ইসরাইলের সাথে ইরানের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ উড়িয়ে দেয়া যায় না।