উনিশের কন্যার স্পর্ধা
বিয়াঙ্কা আন্দ্রেস্কু - ছবি : সংগৃহীত
এ এক আশ্চর্য সমাপতনই বটে! উনিশের সমাপতন।
সাল ২০১৯। সেই সালের দ্বিতীয়ভাগে যিনি আবির্ভাবেই ইতিহাস সৃষ্টি করলেন বিশ্ব টেনিসে, তার বয়স ১৯। যাকে হারিয়ে সেই ইতিহাস, তিনিও, ঘটনাচক্রে, যখন এই প্রথম এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন, তখন তার বয়সও ছিল প্রায় ১৯।
আশ্চর্য সমাপতন। উনিশের সমাপতন। আশ্চর্য ইতিহাস। ২০১৯–এর ইতিহাস। যে ইতিহাস লিখলেন উনিশের কন্যা বিয়াঙ্কা আন্দ্রেস্কু।
হতে পারে তারা যা দেখতে এসেছিলেন, তা ঘটেনি। কিন্তু শনিবার নিউ ইয়র্কের আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামে প্রায় ২৪,০০০ দর্শক নাগাড়ে হাততালি দিয়ে যাচ্ছিলেন বিয়াঙ্কার জন্য। দুপুরের পড়ে আসা নরম রোদের আলোয় কন্যার মুখ উদ্ভাসিত। তার চোখে যেমন অবিশ্বাসের ঈষৎ লজ্জা, পেলব চোয়াল জুড়ে তেমনই কঠোর প্রত্যয়। ২০১৯–এর উইএস ওপেন সাক্ষী থাকল উনিশের কন্যার বিয়াঙ্কার স্পর্ধার, যার আগুনে কার্যত ভস্ম হয়ে গেলেন সেরেনা উইলিয়ামস। যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন মার্গারেট কোর্টের গ্র্যান্ড স্লাম ছোঁয়ার রেকর্ডের মুখে।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে নিজের জন্য একটা ইউএস ওপেন জয়ীর নকল চেক তৈরি করেছিলেন বিয়াঙ্কা। স্বপ্ন দেখতেন, সেই চেক এবং গ্র্যান্ড স্ল্যাম ট্রফি নিয়ে ক্যামেরার সামনে পোজ দিচ্ছেন। অবাক লাগলেও সত্যি যে, প্রতি বছর চেকে পুরস্কারের অঙ্কটা বদলে দিতেন তিনি।
সেই স্বপ্ন সত্যি হতে লাগল মাত্র তিন বছর। শনিবার বিকেলে যখন হাসিমুখে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন বিয়াঙ্কা, তখন তাঁর হাতে ঝলমলে ট্রফি। রোদ্দুরে ঝলসাচ্ছে। ট্রফির সঙ্গেই সেই ঈপ্সিত স্বপ্নের চেক, যেখানে খোদাই করা পুরস্কারমূল্যের অঙ্ক— ৩.৮৫ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২৮ কোটি টাকা)!
কানাডার জাতীয় ক্রীড়া লাঠি আর বলের ল্যাক্রসে। তবে অধুনা বেশি জনপ্রিয় আইস হকি, বেসবল বা বাস্কেটবল। সেখানে টেনিস কিছুটা অখ্যাতই। সেই খেলায় একেবারে আবির্ভাবেই গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়! ব্যাপারটার তাৎপর্য বুঝতেই উত্তাল হয়ে উঠেছে গোটা দেশ। এতদিন কানাডার টেনিস খেলোয়াড় বলতে লোকে চিনত ইউজিনি বুশার্ডকে। ফ্যাশন আইকন হলেও তিনি কোনওদিন গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের ধারেকাছেও আসতে পারেননি। ছেলেদের মধ্যে মিলোস রাওনিচ বা ডেনিস শাপোভালভ কিছুটা সুনামের সঙ্গে ট্যুরে খেলেছেন বটে। কিন্তু তাদের কাছেও গ্র্যান্ড স্ল্যাম এখনো অধরা। সেখানে বিয়াঙ্কা যেন এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন।
এর আগে দু’বার ইউএস ওপেনের মূল পর্বেই উঠতে পারেননি। যোগ্যতা অর্জন পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন। এবারই প্রথম ইউএস ওপেন খেলা তার। প্রথমবারেই চ্যাম্পিয়ন!
কুকুর খুব ভালোবাসেন বিয়াঙ্কা। ইউএস ওপেনের প্রতিটা ম্যাচেই গ্যালারিতে তার মা মারিয়ার কোলে বসে থাকতে দেখা গেছে প্রিয় কুকুর ‘কোকো’কে। আরও দুটি কুকুর এবং একটি বিড়াল রয়েছে তার। ‘জাতীয় পোষ্য দিবসে’ ইনস্টাগ্রামে তাদের সঙ্গে ছবিও পোস্ট করেছিলেন বিয়াঙ্কা। ঘুরতেও ভালোবাসেন তিনি। বিভিন্ন দেশে ঘোরার ছবিও রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার প্রোফাইলে। ১৯৯৪ সালে নিজের দেশ রোমানিয়া ছেড়ে কানাডায় চলে যান বিয়াঙ্কার মা–বাবা মারিয়া এবং নিকু। ঠিক ছ’বছর পরে জন্ম বিয়াঙ্কার। মেয়ের তিন বছর বয়সে ট্রাকের ব্যবসা সামলাতে রোমানিয়ায় ফেরেন মারিয়া। সেখানে কিছু বছর পরে টেনিসে হাতেখড়ি বিয়াঙ্কার। এরপর কানাডায় ফিরে অন্টারিও র্যাকেট ক্লাব থেকে উত্থান। টেনিস–জীবনে অনেক উত্থান–পতন এসেছে। কখনো চোটের কারণে, কখনো অফ ফর্মের জেরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি। এই জায়গাগুলোই বদলে দিয়েছেন বিয়াঙ্কার কোচ সিলভেন ব্রুনো। ছাত্রীর খুঁত খুঁজে বের করে সেগুলিতে আলাদা করে নজর দেওয়ার পাশাপাশি টেকনিকেও অসামান্য উন্নতি ঘটিয়েছেন বিয়াঙ্কার। যার ফসল সেরেনা উইলিয়ামসকে ৬–৩, ৭–৫ হারিয়ে ইউএস ওপেন জয়।
সেরেনার পাওয়ার হিটিং এবং দুরন্ত সার্ভের সামনেও একটুও নড়বড়ে দেখায়নি বিয়াঙ্কাকে। বিয়াঙ্কা জানিয়েছেন, ছোটবেলার একাধিক খেলার সঙ্গে যুক্ত থাকাই তাকে সাহায্য করেছে। ‘বিভিন্ন খেলা খেললে বিভিন্নভাবে ভাবতে হয়। এমন একটা পরিস্থিতি আসে যেখানে সঠিক জিনিসটা তৎক্ষণাত খুঁজে বের করতে হয়। আমার হাত–চোখের সমন্বয় যথেষ্ট ভাল। কিন্তু একবার হাতে র্যাকেট উঠলে সব কিছু ভুলে থাকতে পারি।’ একটানা বলে একটু থেমে তার সংযোজন, ‘সমস্যায় পড়লে আমি সবথেকে ভালো টেনিস খেলি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আমি বিশেষ মুহূর্তগুলোর পর অতিরিক্ত ফোকাস করি। আমার ধারণা এটাই কঠিন ম্যাচগুলোতে সাহায্য করেছে।’
গত বছরও ইউএস ওপেনের আগে পায়ে চোট পেয়েছিলেন। বাড়িতে বসে টিভিতেই দেখতে হয়েছিল গোটা টুর্নামেন্ট। এমনকি সেরেনার বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলবেন, সেই স্বপ্নও দেখতেন। যাবতীয় স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পর বিয়াঙ্কা বলছেন, ‘স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করো।’ তার ব্যাখ্যা, ‘এটা একটা প্রক্রিয়া। জীবনে একটানা সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। তাই কঠিন মুহূর্তে নিজের সেরাটা দিতে হবে, অর্থাৎ স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করতে হবে এবং ধৈর্য ধরে রাখতে হবে।’
একটু থেমে বলে চললেন, ‘এক–একটা সময় আসবে যখন আপনার মনে হবে আপনি পারবেন না। কিন্তু আপনি যদি বিশ্বাস করে সামনে ভালো সময় আসছে, তাহলে কঠিন মুহূর্তগুলো কঠিন মনেই হবে না। আমার ধারণা এতেই একটা মানুষের চরিত্রের গঠন হয়। প্রতিটা মানুষের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া উচিত, যাতে সে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে।’
সংবাদ সম্মেলনে বিয়াঙ্কার মুখে শব্দগুলো শুনে মনে হচ্ছিল কোনো মোটিভেশনাল স্পিকার কথা বলছেন। উনিশের স্পর্ধা বোধহয় একেই বলে!
সূত্র : আজকাল