কাশ্মিরে ১ শতাংশ লোকের জন্য প্রতিরক্ষা খাতে ৩৮ ভাগ বরাদ্দ
কাশ্মিরে ১ শতাংশ লোকের জন্য প্রতিরক্ষা খাতে ৩৮ ভাগ বরাদ্দ - ছবি : সংগ্রহ
কী হচ্ছে ভারত-শাসিত কাশ্মিরে? গত ৫ আগস্ট ভারতীয় সংবিধানে থাকা বিশেষ অনুচ্ছেদ বাতিল করার পর এখনো বলতে গেলে বিচ্ছিন্ন রয়েছে কাশ্মির। নিরাপত্তা বাহিনী অবরুদ্ধ করে রেখেছে কাশ্মিরকে। আচ্ছা এজন্য কি ভারতীয় বাহিনী সমস্যায় পড়ছে না? এ নিয়ে মাসুম খলিলীর বিশ্লেষণ এখানে তুলে ধরা হলো।
তিন বাহিনী মিলিয়ে ভারতের সশস্ত্রবাহিনীর মোট সদস্যসংখ্যা ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৯২১। প্রতিরক্ষাবাহিনীর জন্য ছয় হাজার ৬৫০ কোটি ডলারের বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে কাশ্মিরে মোতায়েন করা হয়েছে ছয় লাখ সৈন্য। এতে রাষ্ট্রের সশস্ত্রবাহিনীর মাথাপিছু গড় ব্যয় ৪৬ হাজার ৫৫ ডলার হিসাবে কাশ্মিরে নিরাপত্তাবাহিনী সদস্যদের জন্য ভারতের মোট ব্যয় হচ্ছে দুই হাজার ৭৬৩ কোটি ডলার। জম্মু ও কাশ্মিরের মাথাপিছু জাতীয় আয় হলো এক হাজার ১৯৮ ডলার। এক কোটি ২২ লাখ জনসংখ্যার কাশ্মির উপত্যকা থেকে ভারত রাষ্ট্রের জিডিপিতে যুক্ত হয় এক হাজার ৩৮১ কোটি ডলার। এর বিপরীতে প্রতি বছর রাজ্যের বাজেট ব্যয় এক হাজার ১৪৭ কোটি ডলার।
আর এখানকার নিরাপত্তা বজায় রাখতে ভারতের খরচ হচ্ছে দুই হাজার ৭৬৩ কোটি ডলার। কাশ্মিরে যে নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভারত তৈরি করে রেখেছে তাতে এই রাজ্যটিতে ভারত সরকারকে রাজ্যের আয়ের অতিরিক্ত যে দুই হাজার ৫২৯ কোটি ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে, তা ভারতের মোট প্রতিরক্ষা বাজেটের ৩৮ শতাংশের সমান, অথচ সেখানকার জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। শুধু নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারের পাঁচ বছরেই জম্মু-কাশ্মিরের জন্য ভারতবাসীকে সাড়ে ১২ হাজার কোটি ডলার নিট ভর্তুকি দিতে হয়েছে। তা ভারতের এক বছরের জাতীয় বাজেটের এক-চতুর্থাংশের সমান। জম্মু ও কাশ্মিরকে আলাদা থাকতে দিলে ভারতকে এ দায় বহন করতে হতো না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর কাশ্মিরের নিরাপত্তার জন্য ব্যয় আরো অনেক বেড়ে যাবে। ভারতীয়দের ভাবতে হবে, তারা প্রতি বছরের বাজেটের প্রতি ২০ টাকার মধ্যে এক টাকা ভর্তুকি কাশ্মিরিদের দমনের জন্য ব্যয় করবেন, নাকি ভারতের জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য এ অর্থকে উৎপাদনশীল খাতে কাজে লাগাবেন।
উপত্যকার জনগণের চাহিদা অনুসারে কাশ্মির, এটিকে স্বাধীন করে দিলে ভারতের প্রতি বছর যে অর্থনৈতিক সাশ্রয় হতো সেই অর্থ রাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যয় করা হলে পুরো ভারতেরই উন্নয়ন নিশ্চিত করা হতো সম্ভব। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার ভারতীয় জনগণকে এ প্রকৃত সত্য সম্পর্কে জানতে না দিয়ে তাদের এক ধরনের মোহাচ্ছন্নতার মধ্যে রেখে দিয়েছে। স্বপ্ন দেখাচ্ছে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার। প্রকৃতপক্ষে এই স্বপ্ন দেখিয়ে ভারতের ও বিশ্বের মাফিয়া অস্ত্র ব্যবসায়ীরা দেশটির সোয়া শত কোটি মানুষের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যকে কেড়ে নিয়ে বিশ্বের সর্বাধিক আত্মহনন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এক দেশে পরিণত করেছে ভারতকে।
শক্তিমত্তার দেশ হওয়ার উন্মাদনা থেকে ভারতে এখন যে অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রতিদিনই ঘনীভূত হচ্ছে। দেশটির ২৭টি ব্যাংককে ১৩টিতে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংকের অর্থ সরকারকে সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যয় করতে হচ্ছে। বেকারত্ব হু হু করে বাড়ছে। ডলারের বিনিময় হার কমতে কমতে বাংলাদেশী টাকার কাছাকাছি চলে এসেছে। এক সময় জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে এর স্থায়ী সদস্য হিসেবে ভারতকে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে মোদির সরকার।
সে স্বপ্ন হতাশায় পরিণত হওয়ার পর এখন ‘অখণ্ড ভারত’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখানো শুরু হয়েছে। এটি করতে গিয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে মোদি-অমিত শাহের সরকার। এ অবস্থায় বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের কাশ্মিরনীতি ভারতের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
‘আচ্ছে দিন’ কোথায়?
নরেন্দ্র মোদির সরকার প্রথম দফা ক্ষমতায় আসার আগে, সবার জন্য কাজ আর জনগণের জন্য সুদিন ফেরানোর স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ অর্থনীতির স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন। কিন্তু উচ্চ মূল্যের নোট বাতিলসহ অর্থনৈতিক সংস্কারের যেসব পদক্ষেপ মোদি নিয়েছেন, তার প্রায় সবটাই সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তনে উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। নোট বাতিলের পদক্ষেপে তৃণমূল পর্যায়ের অনেক ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়ে যায় এবং আকস্মিক বেকারত্ব ও উৎপাদন ক্ষতির সৃষ্টি করে। এর প্রভাবে পরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিচে নেমে আসে। প্রথম মেয়াদে মোদির বিজেপি সরকার উচ্চহারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জায়ান্ট করপোরেট হাউজগুলোকে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে। আর প্রতিরক্ষা শিল্পের স্থানিক বিকাশের নীতি-কৌশল তিনি গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিরক্ষা শিল্পে নিজস্ব সমরাস্ত্র¿ উৎপাদনের কৌশল পরিত্যাগ করে, বেসরকারি খাতের সাথে বাইরের রাষ্ট্রায়ত্ত অথবা বেসরকারি সমরাস্ত্র উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ অংশীদারিত্বভিত্তিক উৎপাদন শুরু করা হয়।
নতুন এ উদ্যোগে সমর্থন দেয়ার জন্য প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানো হতে থাকে। প্রতিরক্ষা কাঠামো ও সমরাস্ত্র আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। একই সাথে প্রতিরক্ষা খাতে উচ্চ বাজেট প্রবৃদ্ধি এবং সশস্ত্র বাহিনীগুলোর আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে সেনা, বিমান ও নৌ খাতের জন্য অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা সামগ্রী কেনার জন্য জাতির সামনে যুক্তি হাজির করার প্রয়োজন হয়। এ জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং উগ্র জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলার দরকার পড়ে। এই প্রয়োজনের সাথে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের এবং রিলায়েন্স-টাটা-বিড়লার মতো বৃহৎ করপোরেট কোম্পানির স্বার্থ যেমন জড়িত হয়, তেমনি ভারতের অস্ত্র সরবরাহের অংশীদার বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল ফ্রান্স এমনকি রাশিয়ার স্বার্থও সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে।
সেসব দেশের বৃহৎ অস্ত্র বিক্রেতা ও উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোও সক্রিয় থাকে ভারতে নীতিগত প্রভাবের ক্ষেত্রে। তারা নিজস্ব স্বার্থে নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি সরকারকে ভারতে শক্তিমত্তার সাথে বহাল রাখার জন্য প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। নিরাপত্তা সংক্রান্ত উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য চীন ও পাকিস্তানের সাথে দুটি ফ্রন্টে বিজেপি সরকার বিরোধ চাঙ্গা করে তোলে। এর মধ্যে, ভুটানের ডোকলামে চীনের সাথে আর কাশ্মিরে পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এ ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের আন্তর্জাতিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, এমনকি রাশিয়াও একদিকে উত্তেজনা কমানোর জন্য বাইরে আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখার কথা বলে, অন্যদিকে ভেতরে ভেতরে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের নীতি ও পদক্ষেপের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে থাকে।