চুরির অন্তরালে
চুরির অন্তরালে - ছবি : সংগ্রহ
বল তুই ক্যান টাকা চুরি করলি? আমার দোকানের ভিতরে ঢোকার এত বড় সাহস কী করে হলো তোর?
এই চোরের বাচ্চা কথা বলতেছ না ক্যান! তোর মুখে কি টেপ লাগাইছো! রাজুর মাথার চুলগুলো মুঠো করে ধরে দুই রানে মাইর দেয় আর চুরি করার সঠিক কারণ জানতে চায় আয়নাল ব্যাপারি।
আয়নাল ব্যাপারি কুড়িগ্রাম শহরের একজন নাম করা ব্যবসায়ী। রাজুর আশেপাশে অনেক লোকের ভিড়। সবাই বলাবলি করছে চোরের বাচ্চা চোর ওরে বেশি করে মাইর দিতে হবে। না হলে ওর মুখ থেকে কথা বাহির হবে না। শত লোকের ভিড় থেকে কে যেন একজন এসে রাজুকে একটা গাছের সাথে শক্ত করে বাঁধল। আশেপাশের সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাজুকে মাইর দেয়া দেখছে আর বলছে এতটুকু বয়সে চুরি করতে আইছে। চোরের বাচ্চারা যে চোর হয় এর প্রমাণ এই পিচ্ছিটা। কত আর হবে রাজুর বয়স সবে মাত্র এগারো বছর। রাজুকে মারতে মারতে এক সময় আয়নাল ব্যাপারি ক্লান্ত হয়ে যায়। তবুও রাজুর মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারল না।
রাজুকে সবাই যখন চোরের বাচ্চা বলে গালি দেয়, তখন মুখ ফুটে কিছু বলতে গিয়েও আটকে যায় রাজু। প্রচণ্ড মাইরের কারণে এক সময় নেতিয়ে পড়ে রাজুর ক্লান্ত শরীর। পানি পানি বলে সবার কাছে বারবার আকুতি করে, তবে কেউ এক ফোটা পানি এনে দেয় না। সবাই বলাবলি করে চোরের বাচ্চা চোর আরো মাইর খাওয়ার ভয়ে এমন করে অসুস্থর ভাব ধরছে। এক সময় ছোট্ট রাজু বিড় বিড় করে বলতে থাকে মা আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার বুকের দুধের ঋণ শোধ করতে পারলাম না।
দেখতে দেখতে এক সময় বরফের মতো ঠাণ্ডা হয় রাজুর দেহ। কেউ একজন এগিয়ে এসে ডাকাডাকি করে কোনো প্রকার সারা শব্দ না পেয়ে থানা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে লাশ চাটিয়ায় মুড়িয়ে ভ্যান গাড়িতে তুলতে যাবে। আর ঠিক তখনি হঠাৎ করে রাজুর প্যান্টের পকেট থেকে একটা সাদা কাগজ নিচে পড়ে। একজন পুলিশ এগিয়ে এসে কাগজটা হাতে নেয়। ভাজ খুলে পড়তে শুরু করে।
চিঠিটা পড়ে নিজের চোখের জলকে আটকাতে পারে না। রাজুর ওই কাগজে তার মাকে নিয়ে অনেক কথা লেখা ছিল। রাজুর মা একজন অসুস্থ মানুষ। বাবা নেই। অনেক আগে হঠাৎ করে মারা গেছে।
রাজুও তার মা, এই দুজন মিলেই ওদের সংসার।
মায়ের চিকিৎসা করাতে প্রতি সপ্তাহে অনেক টাকার প্রয়োজন। ওদের সহায় সম্বল বলতে যা ছিল সব বিক্রি করা শেষ মায়ের অসুখ। তবুও ভালো হয় নাই।
আজ দু’সপ্তাহ হলো ওর মায়ের ওষুধ কিনতে পারে নাই। কোনো এক প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় ওর মাকে রেখে আসছে। রাজু আজ মাকে কথা দিয়ে ছিল যেকোনোভাবে হোক ও ওষুধ নিয়ে তবেই ফিরবে মায়ের কাছে। আজ সকাল থেকে অনেক জনের কাছে হাত পেতেছে। সবাই তাড়িয়ে দিছে, কেউ কেউ বলছে ফকিরের বাচ্চা লজ্জা করে না এই বয়সে ভিক্ষা করতে আইছো! শেষে বাধ্য হয়ে রাজু সিদ্ধান্ত নেয় চুরি করার। আর চুরি করতে যাওয়ার আগে মায়ের কাছে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো চিঠিতে লেখছে।
শেষে লেখা ছিল, মা যদি কখনো জানতে পারো তোমার ছেলে চুরি করতে গিয়ে কোথাও ধরা পড়ছে, তবে আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।
তোমার চিকিৎসার টাকা জন্য শেষে আমাকে এই চুরির পথেই নামতে হলো মা।
ইতি তোমার আদরের রাজু।
চিঠি পড়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বাঁশের চাটিয়ায় মুড়িয়ে রাজুর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মর্গে। অথচ তখনো কোনো এক স্কুলের বারান্দায় অপেক্ষায় রাজুর অসুস্থ মা। মনে মনে ভাবে হয়তো আর একটু পরে ছেলে ফিরে আসবে ওষুধ হাতে।
অথচ আমাদের সমাজের উপর তলার মানুষগুলো কখনই অন্যায়ের পিছনের কারণ খুঁজতে যায় না।
দুর্গাপুর, কুড়িগ্রাম