যে হাল ছেড়ে দেয়, কেবল সে-ই পরাজিত হয়। আর বাকি সবই বিজয়ী
যে হাল ছেড়ে দেয়, কেবল সে-ই পরাজিত হয়। আর বাকি সবই বিজয়ী - ছবি : সংগৃহীত
পাতা-ঝরা শীতে বৃক্ষ কি মনে করে, ঠা-ার কাছে সে হেরে গেছে?
বৃক্ষ তার পাতাকে বলে : ‘জীবনের বৃত্ত তো এমনই। হয়তো ভাবছ, তুমি মরে যাচ্ছ। আসলে তুমি আমার মধ্যে বেঁচে থাকবে। তোমার বদান্যতায়ই আমি জীবিত। তুমি ঝরে পড়েছ বলেই আমি শ্বাস নিতে পারছি। তোমার কারণেই আমি ক্লান্ত পথিককে ছায়া দিয়ে ভালোবাসা পেয়ে ধন্য হই। তোমার প্রাণরস আমারই প্রাণরসে, আমরা একই জিনিস।’
যে ব্যক্তি বছরের পর বছর ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতে আরোহণের প্রস্তুতি নিয়েছে, সে যদি দেখে পর্বতের চূড়াটিকে প্রকৃতি ঝড়ো মেঘের আবরণে ঘিরে রেখেছে, তখন সে কি নিজেকে পরাজিত মনে করে? লোকটি পবর্তকে বলে : ‘তুমি এবার আমাকে চাচ্ছ না, তবে আবহাওয়া বদলাবে, আমিও একদিন শীর্ষে উঠব। তুমিও তখন এখানে আমার অপেক্ষায় থাকবে।’
প্রথম প্রেমে প্রত্যাখ্যাত কোনো তরুণ কি কখনো বলে, প্রেম বলে কিছু নেই? তরুণটি নিজেকে বলে : ‘আমার অনুভূতি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবে - এমন কাউকে আমি খুঁজে বের করব। তখন আমি বাকি জীবনে সুখী হবো।’
প্রকৃতির বৃত্তে জয় বা পরাজয় বলে কিছু নেই : আছে কেবল গতি।
শীত তার আধিপত্য ধরে রাখতে প্রাণপণে চেষ্টা চালায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বসন্তের জয়কে মেনে নিতেই হয়। ওই বসন্ত সাথে করে নিয়ে আসে ফুল আর সুখ।
গ্রীষ্ম চায় তার উষ্ণ দিনগুলো সারা জীবন টিকে থাকুক। তার বিশ্বাস, উষ্ণতা পৃৃথিবীর জন্য কল্যাণকর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেও শরতের আগমনকে গ্রহণ করে নিতে হয়। এতে পৃথিবী বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পায়।
হরিণ ঘাস খায়, আবার তাকে গ্রাস করে সিংহ। এখানে কে সবচেয়ে শক্তিশালী, সেটি কোনো ব্যাপারই নয়। আসল কথা হলো এভাবেই আল্লাহ মৃত্যু আর পুনর্জীবনের বৃত্ত প্রকাশ করেন।
আর ওই বৃত্তের মধ্যে বিজয়ী বা পরাজিত বলে কিছু নেই। এগুলো হলো অনিবার্য পর্ব। এর মধ্য দিয়ে যেতেই হবে। মানুষের মন যখন তা বুঝবে, তখন সে হবে মুক্ত, কঠিন সময়কে গ্রহণ করে নিতে সক্ষম হবে, গৌরবের মুহূর্তে প্রতারিত হবে না।
দুটিই কেটে হয়ে যাবে। একটির পর আরেকটি আসবে। এই বৃত্ত চলতেই থাকবে, যতক্ষণ না আমরা নিজেদেরকে দেহ থেকে মুক্ত করে ঐশী শক্তির সন্ধান পাবো।
এ কারণেই যোদ্ধা যখন ময়দানে থাকে - সে স্বেচ্ছায় সেখানে গিয়ে থাকুক বা অনিবার্য ভাগ্যই তাকে সেখানে টেনে নিয়ে যেয়ে থাকুক না কেন - তার হৃদয় সম্ভবত আসন্ন লড়াইয়ের সম্ভাবনার উল্লাসে মত্ত থাকে। সে যদি নিজের মর্যাদা ও সম্মান ধরে রাখতে পারে তাহলে, এমনকি সে যদি লড়াইতে হেরেও যায়, তবুও সে কখনো পরাজিত হবে না কারণ তার আত্মা তখনো অটুট থাকবে।
আর তার প্রতি যা কিছু ঘটছে, সেজন্য সে কাউকে দোষ দেবে না। প্রথম প্রেমে পড়া এবং তাতে প্রত্যাখ্যাত হওয়া থেকে সে বুঝতে পেরেছে, প্রত্যাখ্যান মানেই ভালোবাসার সামর্থ্য শেষ হওয়া নয়। ভালোবাসার ক্ষেত্রে যা সত্য, যুদ্ধের বেলাতেও তা সত্য।
যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কিংবা সবকিছু হারিয়ে আমরা মনে করি, আমাদের ধারণ করা ইচ্ছাশক্তিই আমাদেরকে এই যন্ত্রণায় ফেলে দিয়েছে। কিন্তু ওই সময়টা কেটে গেলে আমরা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গোপন শক্তি দেখতে পাবো। এই শক্তি দেখে আমরা বিস্মিত হবো, নিজেদের আত্মমর্যাদা বেড়ে যাবে।
আমরা চারপাশে তাকিয়ে মনে মনে বলব : ‘আমি বেঁচে আছি।’ আর আমরা আমাদের কথাতেই উল্লাসে ফেটে পড়ব।
আর যারা অন্তরের শক্তি চিনতে ব্যর্থ হয়, কেবল তারাই বলবে : ‘আমি হেরে গেছি।’ তারা ব্যথিত হবে।
অন্যরা পরাজয়ের কারণে কষ্ট পাবে। তাদের সম্পর্কে বিজয়ীরা যা কিছু বলছে তাতে হয়তো অপমানিত হয়ে কয়েক ফোঁটা চোখের জল ঝরাবে। যন্ত্রণায় গুমরে মরবে, কিন্তু আত্মসমর্পণ করবে না। তারা জানে, এটি হলো যুদ্ধের ¯্রফে একটি বিরতি, ঠিক এই মুহূর্তে তারা কিছুটা প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে।
তারা নিজেদের হৃদয়ের স্পন্দন শোনে। তারা নিজেদের উত্তেজনা ও ভীতির ব্যাপারে সচেতন। তারা তাদের জীবনের কথা ভাবে। তারা বুঝতে পারে, ভয় পেলেও তাদের বিশ্বাস জীবন্ত আছে। এই বিশ্বাসই তাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়।
তারা তাদের ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত করার চেষ্টা করে। তাদের শক্তি-সামর্থ্যও বুঝে নেয়। তারা পরাজয়ের এই মুহূর্তটিকে বিশ্রাম গ্রহণের সুযোগ হিসেবে নেয়, ক্ষতের নিরাময় করে, নতুন নতুন কৌশল প্রণয়ন করে, নিজেদের আরো ভালোভাবে প্রস্তুত করে।
তারপর একদিন ভোরে তাদের দরজায় নতুন যুদ্ধ কড়া নাড়ে। তারা তখনো ভীত থাকে। তবে তাদেরকে সাড়া দিতে হয়। হয় তাদেরকে লড়াইয়ে নামতে হবে নয়তো জীবনভর অবনত হয়ে কাটাতে হবে। যে দুর্ভোগ সহ্য করেছে সে কথা মনে করে তারা উঠে দাঁড়ায়, প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়। ওই অপদস্থ হওয়া তারা আর বরদাস্ত করতে চায় না।
তারা আগেরবার পরাজিত হয়েছে, কাজেই এবার জয়ী হতেই হবে। তারা আরো একবার একই কষ্ট সহ্য করতে চায় না।
কিন্তু এবারো যদি জয় তাদের হাতে ধরা না দেয় তো কী হয়েছে! পরেরবার দেবে। আর পরেরবারও না হলে তার পরেরবার তারা জয়ী হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিজের পায়ে আবার দাঁড়াতে পারার সামর্থ্য।
আর যে হাল ছেড়ে দেয়, কেবল সে-ই পরাজিত হয়। আর বাকি সবই বিজয়ী।
তারপর সেই দিন আসবে যখন ওসব কঠিন সময় স্রেফ গল্পে পরিণত হবে। গল্পগুলো গর্বভরে বলা হবে। যারা শুনতে চাইবে তারা শুনবে শ্রদ্ধার সাথে, তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখবে তারা-
কাজ করার জন্য ঠিক মুহূর্তটি পর্যন্ত ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করো।
পরের সুযোগটি হাতছাড়া হতে দেবে না।
তোমার গায়ে থাকা আঘাতের চিহ্নগুলো নিয়ে গর্ব করো।
দেহে লেগে থাকা আঘাতের চিহ্নগুলো হলো মেডেল। তোমার শত্রুরা এগুলো দেখে ভয় পাবে। কারণ এগুলো হলো তোমার যুদ্ধ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রমাণ। এগুলোই অনেক সময় তাদেরকে তোমার সাথে আপস করতে, সঙ্ঘাত এড়াতে বাধ্য করবে।
যে তরবারির আঘাত ক্ষতগুলো সৃষ্টি করেছে, সেগুলো ওই অস্ত্রটির চেয়েও জোরে কথা বলবে।