গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠা একটি দুঃসাহসিক কাহিনী
গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠা একটি দুঃসাহসিক কাহিনী - ছবি : সংগৃহীত
মধ্য আকাশে পাইলট হার্টফেল করে মারা গেলেন। বিমানের যাত্রী শিল্পপতি ডগ হোয়াইট, তার স্ত্রী ও দুই কন্যা। আর কোনো পাইলট নেই। সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার পেলেন কিভাবে তারা?
জো ক্যাবুকের ওপর যেকোনো যাত্রী নির্ভর করতে পারেন। ৬৭ বছর বয়স্ক এই মার্কিন বিমান বাহিনীর কর্নেল ভিয়েতনামের উপর দিয়ে এফ-১০০এস চালিয়েছেন, ইংল্যান্ডে একটি জঙ্গিবিমানের শাখাকে পরিচালনা করেছেন, ইতালিতে ন্যাটো অভিযানে সহকারী পরিচালক ছিলেন। ১৯৮৯ সালে সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি তার জন্মস্থান লুসিয়ানায় ফিরে আসেন। তার পরের ২০ বছর তিনি মনরো আঞ্চলিক বিমানবন্দর থেকে ভাড়া বিমান চালিয়েছেন। শুভ্রকেশ ও সুঠামদেহী ক্যাবুক ধর্মনিষ্ঠ এবং বিমান চালনার সময় কোনো ধরনের ঝুঁকি নেন না।
গত ইস্টার সানডে’র রাত দেড়টার দিকে তিনি ছয় আসনের বেচক্রাফট কিং এয়ার ২০০ নিয়ে ফ্লোরিডার দিকে যাত্রা শুরু করলেন। কো-পাইলটের আসনে বসা ছিলেন বিমানটির মালিক স্বয়ং। হালকা-পাতলা এই ধনী ব্যবসায়ীর নাম ডগ হোয়াইট।
হোয়াইটের স্ত্রী টেরি, তাদের দুই মেয়েও ছিল বিমানের যাত্রী। তারা অবশ্য যাত্রীদের কেবিনে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে ছিলেন। বাড়ি ফেরার তিন ঘণ্টা যাত্রাপথে তারা বই পড়ে আর ঘুমিয়ে কাটানোর পরিকল্পনা করেছিল।
উড়ান পথে ক্যাবুকের সঙ্গ হোয়াইটের, ৫৬, ভালোই লাগছিল। অবশ্য তার সময় ভালো যাচ্ছিল না। আগের শনিবার তার ৫৩ বছর বয়সী ভাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। সেই ভাইয়ের অন্তেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতেই তারা লুসিয়ানা থেকে ফ্লোরিডা যাচ্ছিলেন।
ক্যাবুক সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘আমরা মেঘের পর্দা ভেদ করে একটু উপড়ে যাব।’ ক্যাবুক মিয়ামির এয়ার কন্ট্রোলে বিমানের পরিচয় নম্বর এন৫৫৯ডিডব্লিউ জানিয়ে রুটিন কল দিতে শুরু করলেন, ‘মিয়ামি সেন্টার, কিং এয়ার ফাইভ-ফাইভ-নাইনার-ডেল্টা-উইস্কি...’। কিন্তু হঠাৎ করে তার কণ্ঠ থেমে গেল, চিবুকটা বুকের দিকে ঝুলে পড়লো।
হোয়াইট তাকে কাছে টেনে নিয়ে তার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। মাথা উঠিয়ে ক্যাবুক একটি দীর্ঘ আর্তচিৎকার করলেন। তারপরই তার চোখ দুটি কোঠরে বসে গেল এবং তিনি নিশ্চল হয়ে গেলেন।
হোয়াইট চারপাশে তাকালেন, তার পর স্ত্রীকে চিৎকার করে ডাকলেন : ‘টেরি, এদিকে চলে এসো। বিপদে পড়ে গেছি।’ এসে দেখলেন ক্যাবুক তার আসনে পড়ে রয়েছে, তিনি তাকে জাগাতে চেষ্টা করলেন। হোয়াইট বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ থেকে তিনি ভয়ঙ্কর সত্য কথাটি বললেন, ‘ও মারা গেছে।’
কেবিনে লুসিয়ানা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ১৮ বছর বয়স্ক ম্যাগি আর তার বোন হাইস্কুলের পড়–য়া বেইলি (১৬), আতঙ্কে কাঁপছিল।
বিমানটি তখন মাটি থেকে এক মাইল ওপরে এবং মিনিটে ২০০০ ফুট করে উপরে ওঠছে। বিমানে সেটিকে নিরাপদে ভূমিতে নামিয়ে আনতে পারে এমন কেউ ছিল না।
অবশ্য ডগ হোয়াইটের পাইলটের লাইসেন্স ছিল। তবে তার বিমান চালানো অভিজ্ঞতা সামান্য। ১৯৯০ সালে তিনি এক ইঞ্জিনের ক্ষুদ্র সেসনা ১৭২ চালিয়েছিলেন লাইসেন্স পাওয়ার জন্য। লাইসেন্স পাওয়ার পর শখের বশে আর মাত্র একবার বিমানটি চালিয়েছিলেন। তার পর আর না।
১৮ বছর পর তিনি এই কিং এয়ারটি কেনেন। সেসনা আর কিং এয়ারের মধ্যে পার্থক্য অনেক। প্রথমটি খুবই ছোট এবং অনেক সরল। তুলনায় কিং এয়ার অনেক জটিল এবং দুই ইঞ্জিনের। এটি সেসনার চেয়ে দ্বিগুণ দ্রুত, পাঁচগুণ ভারি এবং এর সুইচগুলোর সংখ্যা বেশি ও দুর্বোধ্য। হোয়াইট এই বিমানের মাত্র একটি যন্ত্রই চালাতে পারেন এবং সেটি হলো রেডিও। এটাও তিনি শিখেছিলেন আগের ফ্লাইটে পাইলটের কাছ থেকে।
বিমানটি এখন চলছে অটোপাইলটে। এই ব্যবস্থার সঙ্গেও হোয়াইট পরিচিত নন। মৃত্যুর আগে ক্যাবুকের ইচ্ছা ছিল ১০ হাজার ফুট ওপরে উঠার, কিন্তু ইতোমধ্যে তিনি মারা যাওয়ায় তিনি আর প্রয়োজনীয় সুইচে চাপ দিতে পারেননি। ফলে বিমানটি উপরের দিকে উঠতেই থাকলো। হোয়াইট জানতেন, বিমানটি যদি ৩৫ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় উঠে যায়, তবে পাতলা বায়ুস্তরে এটি পাঁক খেতে থাকবে।
এর চেয়েও বড় বিপদ ছিল : ক্যাবুকের দেহটি হুমড়ি খেয়ে কন্ট্রোলবোর্ডে পড়ে যেতে পারে। হোয়াইট তার স্ত্রীকে বললেন দেহটিকে সরিয়ে ফেলতে। তিনি ম্যাগির সাহায্য চাইলেন। কিন্তু সেখানে জায়গা ছিল সামান্যই। টেরি ক্যাবুকের দেহটি সরাতে চেষ্টা করলেও কাজের কাজ কিছুই হলো না। হোয়াইট তাই দেখে টেরিকে বললেন, তুমি তোমার জায়গায় ফিরে গিয়ে প্রার্থনা করতে থাকো।
তিনি ক্যাবিনে ফিরে মেয়ে দুটিকে জড়িয়ে ধরে থাকলেন। তিনি প্রার্থনা করতে লাগলেন, মৃত্যু হলে যেন তারই হয়। শাশুরীর এক পুত্র মাত্র এক সপ্তাহ আগে মারা গেছে। প্রভু, এখন আবার তাকে পুত্রশোকে ফেলো না।
হোয়াইট রেডিওতে বার্তা পাঠালেন, ‘মিয়ামি, জরুরি সাহায্য দরকার। আমার পাইলট অজ্ঞান হয়ে গেছেন।’
তার এই বার্তাটি মিয়ামি এয়ার রুট ট্রাফিক কন্ট্রোল সেন্টারে পৌঁছালো ন্যাট হেনকেলসের (৩০) হাতে। সেদিন কর্মরত ৯৭ জন কন্ট্রোলারের একজন তিনি। পাল্টা হোয়াইটকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি পাশ করা পাইলট?’
হোয়াইট জবাব দিলেন, ‘সামান্য, এক ইঞ্জিনের। আমার এখন কিং এয়ার পাইলটের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
হেনকেলস শিউরে উঠলেন। পাইলন অক্ষম হওয়ার পর যাত্রীদের বিমানকে ল্যান্ড করানোর অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এই বিমানের মতো বড় ও জটিল বিমানের ক্ষেত্রে তেমন ঘটনা বলতে গেলে ঘটেনি। তিনি হোয়াইটের অবস্থাটি তার উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে হোয়াইটকে ১২ হাজার ফুট উঁচুতে ওড়ার পরামর্শ দিলেন। তবে হেনকেলসের নিজেরই বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল সীমিত। তা-ই ঠিক কী করতে হবে বুঝতে পারছিলেন না। তবে টানা ছয় মিনিট খোঁজাখুজির পর কিং এয়ারের একটি মডেল সামনে নিয়ে বসলেন।
এ দিকে বিমানটি তখনো ওপরে উঠছিল। হোয়াইট বললেন, এটাকে থামাতে হবে।
হেনকেলস জবাব দিলেন, ‘আমি আছি এখানে। ভয় পেয়ো না। আমি একটা সমাধান দেয়ার চেষ্টা করছি।’ ঠিক তখনই একজন সুপারভাইজার আসলেন এ কাজে পারদর্শী লিসা গ্রিমকে (৩১) নিয়ে। গ্রিম প্রথমেই হোয়াইটকে বিমানটিকে অটোপাইলট অবস্থা থেকে সরিয়ে আনতে কী করতে হবে তা জানালেন। বিমানটি তখন সাড়ে ১৭ হাজার ফুট উপরে। তিনি একেবারে শান্ত গলায় বললেন, আমরা বিমানের গতি খুব ধীরে ধীরে কমিয়ে আনবো। তিনি হোয়াইটকে কয়েকটি সুইস চাপতে বললেন। সেটাও খুব সহজ ছিল না। তবে হোয়াইট তা শেষ পর্যন্ত করতে পারলেন। গ্রিমরা চেয়েছিলেন বিমানটিকে মিয়ামিতে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু বিমান চলাচলের নিয়ম হলো, এসব ক্ষেত্রে কাছাকাছি বিমানবন্দরেই বিমানটিকে অবতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই ফোর্ট মায়ার্সের সাউথইস্ট ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টকে বেছে নিলেন। তাদের কাছেই বিমানের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিলেন। হোয়াইট ততক্ষণে তাদের সঙ্গ পছন্দ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে থাকার উপায় ছিল না।
ফোর্ট মায়ার্স কন্ট্রোল সেন্টারে ব্রায়ান নরটন তখন কাজ শেষে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু জরুরি এই কাজের কথা বলে তার বস তাকে থামালেন। সেদিন যে দুজন কন্ট্রোলারের বিমান চালানোর ব্যাপক অভিজ্ঞতা ছিল তাদের একজন ছিলেন নরটন (৪৮)। অন্য জন ছিলেন ড্যান ফ্যাবিও (২৯)। তিনি মাত্র দু’মাস আগে ফোর্ট মায়ার্সে যোগ দিয়েছেন। তবে তাদের কারোরই কিং এয়ার ২০০ চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে ফ্যাবিও কিংয়ের গুরু ক্যারি সরেনসনের (৪৩) এয়ার কিং সম্পর্কে ধারণা ছিল। সরেনসনের জীবনটি ছিল বিমান দুর্ঘটনায় জর্জরিত। তিনি যখন কিশোর, তখন তার বাবা, কর্পোরেট পাইলট, বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। বিমান প্রশিক্ষক তার সৎপিতাও বিমান দুর্ঘটনার শিকার হন। পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেই তিনি পাইলট হয়েছিলেন। তার প্রতিজ্ঞা ছিল দুর্ঘটনা প্রতিরোধে।
হোয়াইটকে সহায়তা করতে নরটন বসলেন রাডার প্যানেলে, আর ফ্যাবিও তার সেল ফোন তুলে কল করলেন সরেনসনকে। সরেনসন জানালেন, তিনি ১৯৯৫ সালের পর আর কিং এয়ার চালাননি, তবে কিছু ধারণা দিতে পারেন। তিনি বাড়িতে কম্পিউটারের সামনে বসে হোয়াইটের বিমানটির একটি মডেল বাছাই করলেন।
নরটন রেডিওতে হোয়াইটের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আমরা এখন অন্য একজন পাইলটের নিকট থেকে সাহায্য নিয়ে তোমাকে জানাচ্ছি। তুমি এখন অটোপাইলটে আছো, নাকি হাতে চালাচ্ছো?’
হোয়াইট জানালেন, ‘আমি আর সদাপ্রভু হাতেই বিমানটি চালাচ্ছি।’ তার পেছনে কেবিনে তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে তখনো আতঙ্কে গুটিয়ে রয়েছে।
নরটন বললেন, ‘ঠিক আছে। আমরা এখন তোমাকে বিমানবন্দরের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। তিনি হোয়াইটকে বাঁ দিকে ৯০ ডিগ্রি যেতে বললেন। ফ্যাবিও তখন সরেনসনের কাছ থেকে কখন কোন বাটনে কীভাবে চাপ দিতে হবে তা জেনে নরটনকে জানাচ্ছিলেন, নরটন সেটা বলে দিচ্ছিলেন হোয়াইটকে।
সরেনসন আরেকটি পরামর্শ দিলেন : তাকে বলো, কিং এয়ার আসলে এক ইঞ্জিনের বিমানের মতোই। বিমান মানেই বিমান। এই পরামর্শ হোয়াইটকে অনেক চিন্তা থেকে রক্ষা করলো। তাদের পরামর্শ মতো হোয়াইট বিমানটি চালাতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে নেমে আসতে লাগলো বিমানটি।
সম্ভাব্য যেকোনো দুর্ঘটনা মোকাবেলায় বিমানবন্দরে তখন অ্যাম্বুলেন্স আর দমকল বাহিনী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। হোয়াইট চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিমানটিকে ল্যান্ড করতে। টেরি আরো জোরে তার মেয়ে দুটিকে আঁকড়ে ধরেছে, প্রার্থনা করছে মনেপ্রাণে। নরটন হোয়াইটকে জানালেন, পুরো রানওয়ে তোমার। তুমি যেখান দিয়ে খুশি নামো।
মিয়ামিতে একজন সুপারভাইজার লিসা গ্রিমকে জানালেন, ‘তিনি নেমেছে।’ গ্রিম চিৎকার করে জানতে চাইলেন, ‘এর মানে কি? বিমানটি নিরাপদে নেমেছে নাকি দুর্ঘটনা ঘটেছে?’
ফোর্ট মায়ার্সে বিমানটি কিভাবে নামছে, তা দেখছে ফ্যাবিও ভবন থেকে দৌড়ে বাইরে এলেন। কিং এয়ার নিখুঁতভাবে অবতরণ করেছে। সবার মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। চার জনই বিমান থেকে বের হয়ে আসলেন। চিকিৎসকরা এসে জো ক্যাবুককে ককপিট থেকে নামিয়ে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কাজ হলো না। পরে ময়না তদন্তে দেখা যায়, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
লুসিয়ানার বাড়িতে ফিরে হোয়াইট গিফট সার্টিফিকেট পাঠালেন গ্রিম, নরটন, ফ্যাবিও ও সরেনসনকে। জবাবে তারা জানালেন, সব কৃতিত্ব হোয়াইটের। তিনিই কিং এয়ারকে মধ্য আকাশ থেকে অখণ্ডভাবে নামিয়ে এনেছেন।
এই ঘটনার এক মাস পরও প্রতিরাতের তিনটায় দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙতো হোয়াইটের। প্রতিবারই তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তিনি বিমানটির কন্ট্রোলে এবং কী করতে হবে জানেন না। তিনি আবার বিমান চালানো শিখতে গেলেন, আবার যদি জরুরি অবতরণ করতে হয়, তবে তিনি নিজেই যাতে পারেন। তিনি এখনো মনে করেন, ওপরওয়ালাই তাকে ও তার পরিবারকে বাঁচিয়েছে।