রহস্যময় জিন পাহাড়
রহস্যময় জিন পাহাড় - ছবি : সংগ্রহ
পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর ইউটিউবে যখন সৌদি আরবের জিন পাহাড়ের সংবাদ ও ভিডিও দেখতাম, তখনই মনের ভেতর তা নিজ চক্ষে দেখার প্রচণ্ড আগ্রহ সৃষ্টি হতো। তো পবিত্র হজে যাওয়ার সুযোগ এলো। আল্লাহর রহমতে গেলামও। ঠিকঠাক মতো হজ পালন হলো। মক্কায় কয়েক দিন থাকার পর এবার এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, মোয়াল্লেম মক্কার কার্যক্রম শেষে আমাদের পবিত্র মদিনা নিয়ে গেলেন। এখানে থাকা হবে ৯ দিন। হজসাথীদের সাথে জুটি বাঁধলাম। এক দিন ফজর নামাজ পরেই মাইক্রোতে চড়ে ছুটলাম সেই কাঙ্ক্ষিত জিন পাহাড়। গাড়ি চালক হলেন এক অ্যারাবিয়ান।
গাড়ি চলছে ঐতিহাসিক ওহুদ পাহাড়ের পাশঘেঁষে। পুরো মদিনা শহরটাকে ঘিরে রেখেছে এই ওহুদ পাহাড়। শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে জিন পাহাড়ের অবস্থান। মদিনার উত্তর-পশ্চিমে ওয়াদি-ই-আল বায়দা নামক পাহাড় ঘেরা এক উপত্যকা আছে। যাকে আমার মতো সাধারণ পর্যটকেরা জিনের পাহাড় হিসেবেই চিনি। মূলত এর নাম ওয়াদি-আল জিন। কাছাকাছি যেতেই চোখে ধরা দিলো নানা আকৃতির বৃক্ষহীন ন্যাড়া পাহাড়। এর চূড়াগুলোও অদ্ভুত আকৃতির। দুঃখের বিষয়, চালক না বুঝে ইংলিশ না বুঝে হিন্দি। ফলে সে যা বলছে, তা যেমন আমরা বুঝি না, আমরাও কি জানার আগ্রহী সেটাও সে বুঝে না। যার ফলে এক মহা ক্যাচালে পরেছিলাম। বহুত ঘাম ঝরিয়ে বোঝানোর পর সে গাড়ির ব্রেক ও ক্লাস থেকে পা তুলল। এবার গাড়ি নিউটালে আপন গতিতেই প্রায় ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্পিডে ছুটল। আনন্দে চোখে-মুখে ঝিলিক এলেও তা পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়।
গাড়ি থেকে নেমে ঘুরতে চাইলাম, কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলাম না। ইশারা-ইঙ্গিতে বেশি অনুনয়-বিনয় করায় লোকটির চেহারায় বাংলাদেশের লোকাল বাসচালকদের ভাব দেখতে পেলাম। কী আর করা, সে দিনের মতো আফসোস নিয়েই ফিরতে হলো। এসে খোঁজ লাগাই বাঙালি বা ইন্ডিয়ান ড্রাইভারের। পরদিন আবার যাবো। এদিক-সেদিক খবরাখবর নিতেই মোবাইল নম্বর পেয়ে যাই বাংলাদেশী এক চালকের। সেলফোনে কন্টাক্ট হয়। পরদিন ফজরের পরই চলে আসে সে। নব উদ্যমে আবারো ছুটে চলা। গাড়ি চলছে আর নানা ঐতিহাসিক জায়গার বর্ণনা দিচ্ছেন চালক।
মাঝে মধ্যে নিজ থেকেই ব্রেক করে নামার সুযোগ দিচ্ছেন। জিনপাহাড়ের কাছাকাছি পথের মাঝ বরাবর বিশাল গেটটি খোলা। নামার পর খেয়াল করলাম, পিচ করা সড়কটি ঢালু। এবার চালক নিজ থেকেই পানি ভরা একটি বোতল আমার হাতে দিয়ে বললেন, এখানে বোতলটি রাখেন। কথা অনুযায়ী রাখলাম। আশ্চর্য বোতল ঢালুর বিপরীতে গড়িয়ে যেতে লাগল। পানি ঢাললাম,তাও বিপরীতেই গেল। সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। গাড়ি নিউটালে রাখার পরও ঢালুর উল্টো দিকেই চলল। সেই মুহূর্তে আমার মনের ভেতর যে আনন্দের ঢেউ খেলল তা এখানে লিখে প্রকাশ করতে পারব না।
ওয়াদি আল জিন পাহাড় সম্পর্কে মানুষের প্রথম ধারণা আসে ২০০৯-১০ সালে। সৌদি সরকার এখানে একটি সড়ক তৈরির পরিকল্পনা করে। যথাসময়ে কাজও শুরু হয়। কিন্তু সমস্যা বাধে, রাস্তা নির্মাণের জন্য রাখা যন্ত্র ও পিচ ঢালাই করার বড় বড় রোলার গাড়িগুলো আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে থাকে। একটা সময় গাড়ি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মদিনা শহরের দিকে চলতে শুরু করে। এই দেখে শ্রমিকেরা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে নির্মাণকাজ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফলে সড়কটি মাত্র ৩৫-৪০ কিলোমিটার কাজ হওয়ার পর নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্বের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় ও অদ্ভুত পথ হলো এই ওয়াদি-আল জিন পাহাড়ের বুক চিরে যাওয়া সড়কটি।