আকসাই চীন নিয়ে চীন-ভারতের লড়াই
আকসাই চীন - ছবি : সংগ্রহ
কাশ্মির পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষণ এখনো নেই। থমথমে অবস্থা। এক কাশ্মির কিন্তু নিয়ন্ত্রণ তিন দেশের। এক অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে পাকিস্তান। যা আজাদ কাশ্মির নামে পরিচিত। বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। আর অন্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে চীন। চীনের এ অংশের নাম আকসাই চীন।
কাশ্মির নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত ব্রিটিশদের হাতে। মতবিরোধের কারণে ব্রিটিশ নেতৃত্ব দেশ ভাগের সময় কাশ্মির নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। ছেড়ে দিয়েছে এখানকার জনগণের ওপর। গণভোট হবে। সেই গণভোটেই নির্ধারণ হবে কাশ্মির ভারতের অংশ হবে, নাকি পাকিস্তানের, নাকি স্বাধীন দেশ। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তই শেষ। গণভোট আর হয়নি। নিয়ন্ত্রণ গেছে তিন দেশের হাতে। শুরুতে কাশ্মিরের কোনো অংশের নিয়ন্ত্রণ চীনের না থাকলেও ১৯৬২ সালের পর তারা নিয়ন্ত্রণ করছে একটি অংশ। সে দেশে স্থানটির নাম আকসাই চীন। কিন্তু এই আকসাই চীনের দাবি করছে ভারত তাদের নিজেদের এলাকা হিসেবে। কিন্তু কিভাবে আকসাই চীনের নিয়ন্ত্রণ করছে চীন? আর কেনই বা ভারত দাবি করছে তাদের নিজস্ব ভূমি হিসেবে?
ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মিরকে ‘কাশ্মির উপত্যকা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। বর্তমানে কাশ্মির বলতে একটি তুলনামূলক বৃহৎ অঞ্চলকে বোঝায়। বর্তমান ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির রাজ্য (বিশেষ অধিকার বাতিলের আগে যেটি জম্মু, কাশ্মির উপত্যকা ও লাদাখের সমন্বয়ে গঠিত ছিল), পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মির ও গিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চলদ্বয় এবং চীন-নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীন ও ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্ট অঞ্চলদ্বয় বৃহত্তর কাশ্মিরের অন্তর্ভুক্ত।
পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ববর্তী সময়ে কাশ্মির প্রথমে হিন্দুধর্ম এবং পরে বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরবর্তীতে নবম শতাব্দীতে কাশ্মিরে শৈব মতবাদের উত্থান ঘটে। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে কাশ্মিরে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটে এবং শৈব মতবাদের প্রভাব হ্র্রাস পায়।
১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মিরের প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীব্যাপী কাশ্মিরে মুসলিম শাসন বজায় ছিল। এর মধ্যে মোগল সম্রাটরা ১৫৮৬ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত এবং আফগান দুররানী সম্রাটরা ১৭৪৭ সাল থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মির শাসন করেন। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মির দখল করে। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে শিখরা পরাজিত হয়।
এরপর অমৃতসর চুক্তি অনুসারে জম্মুর রাজা গুলাব সিংহ অঞ্চলটি ব্রিটিশদের কাছ থেকে ক্রয় করেন এবং কাশ্মিরের নতুন শাসক হন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তার বংশধররা ব্রিটিশ রাজমুকুটের অনুগত শাসক হিসেবে কাশ্মির শাসন করেন। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের সময় অঞ্চলটি একটি বিবদমান অঞ্চলে পরিণত হয়। বর্তমানে ভারতের নিয়ন্ত্রণে কাশ্মিরের ৪৫ শতাংশ অঞ্চল। বেশির ভাগ কাশ্মিরি বাসও করেন ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরেই। পাকিস্তানের দখলে রয়েছে ৩৫ শতাংশ। আর বাকি ২০ শতাংশ দখলে চীন।
আকসাই চীন হলো ভারত ও চীনের মধ্যকার এক বিতর্কিত অঞ্চল। ভারতের মতে এটি ভারতের লাদাখের অংশ। অপর পক্ষ চীনের মতে আকসাই চীন তাদের জিংজিয়াং প্রদেশের অংশ। এ অঞ্চলটির আয়তন ৩৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের আগে আকসাই চিন ভারতের লাদাখের নিয়ন্ত্রণে ছিল। যুদ্ধের পর অঞ্চলটি চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ অঞ্চল নিয়ে এখনো ভারত ও চীনের মধ্যে বিবাদ রয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ হাজার মিটার বা ১৬ হাজার উচ্চতার কারণে আকসাই চীনের ধ্বংসস্থানগুলো দেখে বোঝা যায় যে, এটি প্রাচীন বাণিজ্য পথ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে মানুষের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, যা গ্রীষ্মকালে জিনজিয়াং ও তিব্বতের কার্নিভালের জন্য একটি অস্থায়ী পাস বা গিরিপথ ছিল। সামরিক অভিযানের জন্য এই অঞ্চলটি অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছিল। কারণ তারিম উপত্যকা থেকে তিব্বত পর্যন্ত এটি একমাত্র পথ ছিল যা সারা বছর ধরে কার্যকর ছিল।
চীনের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আকসাই চীনের বাসিন্দাদের বেশির ভাগ অংশই ভ্রাম্যমাণ গোষ্ঠীর সদস্য যারা নিয়মিতভাবে এলাকার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে। পরিচিত বসতিগুলো হলো- টিয়ানশুইহাই শহর এবং তিলংঘন গ্রাম।
ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ হয় ১৯৬২ সালে। সীমানা নিয়ে বিরোধ থেকে এই যুদ্ধের সূত্রপাত। যুদ্ধে চীনের কাছে ভারত পরাজিত হয়। চীন তিব্বত দখল করার পর ভারতের বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীনকে তাদের এলাকা বলে দাবি করে। এভাবে যে সীমান্ত সমস্যার শুরু হয় তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সূচনা করে। যুদ্ধে চীন জয়ী হয়ে একতরফা যুদ্ধবিরতি জারি করে আকসাই চীন দখলে রাখে কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু চীন-ভারত কখনোই এই এলাকায় সীমান্ত চিহ্নিতকরণ করতে পারেনি।
হয়তো ব্রিটিশ ভাগের সময় কাশ্মির নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারলে আজকের এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। কাশ্মিরের এ বিরোধের শেষ কোথায় কেউ জানে না। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিমাদের আরো বেশি মাত্রায় সামরিকীকরণের রাস্তা উন্মুক্ত করবে কিনা- সেটিই এখন দেখার বিষয়।