অনিন্দ সৌন্দর্যের তায়েফ
অনিন্দ সৌন্দর্যের তায়েফ - ছবি : সংগ্রহ
ভ্রমণপিপাসু মন সুযোগ পেলেই ফুরুৎ। হজ পরবর্তী পবিত্র মক্কা অবস্থাকালীন বাংলাদেশী গাড়িচালক জহিরকে নিয়ে ছুটি ইতিহাস-ঐতিহ্যের শহর তায়েফ নগরী। তায়েফ মক্কা থেকে প্রায় ৯১ কিলোমিটার পূর্ব-পশ্চিমে। সকাল প্রায় ৮টায় মিসফালাহ থেকে মাইক্রোতে আমরা মোট সাতজন চেপে বসার পর গাড়ি ছুটে চলে। মক্কা নগরের নানান প্রাকৃতিক ও আধুনিক স্থাপত্য দেখতে দেখতে চলছি। বিশাল উচ্চতার পাহাড়, তবুও সে সব জায়গায় পাথরের পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে প্রশস্ত সড়ক। আরো রয়েছে দীর্ঘতম উড়াল সড়ক। সত্যিই অবাক করার মতো দূরদর্শী পরিকল্পনা। কোথাও কোথাও এমনও দেখলাম, কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতি নেই।
শুধুই ধু ধু মরুভূমি। প্রাণীকুলের মধ্যে উট আর দুম্বা। বৃক্ষ বলতে শুধুই বাবলা গাছ। একটা সময় আবহাওয়ার তারতম্যেই বুঝা গেল আমরা তায়েফের কাছাকাছি। শুরু হলো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক। গাড়ি চকচকে পিচঢালা পথ ঘুরে ঘুরে শুধু উপরের দিকেই উঠছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ৬৯ ফুট উচ্চতায় আমাদের উঠতে হচ্ছে। সড়কের পাশে নানা কারুকার্যময় স্থাপনা। আরো রয়েছে বিভিন্ন কটেজ, রিসোর্ট ও শিষাবার। গাড়ির জানালা দিয়ে নিচে ও উপরে তাকালে বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এটিকে তায়েফের রিং রোড বলা হয়ে থাকে। সড়ক দ্বীপে বানরের দল নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়ায়। চারপাশে নির্মল সবুজের হাতছানি। যা আমাদের জন্য মায়াবী পথে চমৎকার এক যাত্রা। অপার্থিব ঘোরের মাঝে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যেই তায়েফ শহরে পৌঁছে যাই।
প্রথম দর্শনেই চোখ ছানাবড়া। কোলাহলহীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর। সড়কের পাশেই পার্ক, যেখানে সবুজের সমারোহ। নাশতার জন্য ছোট্ট ব্রেক। নাশতা শেষে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: মসজিদে দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করি। এটিই তায়েফের কেন্দ্রীয় মসজিদ। খুবই দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদ। এর পাশেই প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত আবদুল্লøাহ ইবনে আব্বাস রা: চির শায়িত অছেন। এরপর গাড়ি আবারো এগিয়ে যায়। ড্রাইভার জহির ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো, দক্ষ গাইডের মতোই আন্তরিকতার সাথে পরিচিতি করাতে লাগলেন। একে একে দেখলাম হজরত আলী রা: মসজিদ। ছাদে উঠতে গিয়ে দেখা হলো প্যাঁচানো সিঁড়ির দেয়ালের কারুকার্য, যা দেখে পর্যটকেরা অবাক না হয়ে পারে না। শত শত বছর আগের নীর্মাণশৈলী মনকে ভাবুক করে তোলে। তারপর দেখলাম মসজিদে আদম। আঙ্গুরের বাগানের পাশেই মসজিদটি। এরপর কথিত বুড়ির বাড়ি। জায়গাটি পাথর দিয়ে ঘেরা। তার পাশেই বড় বড় দু’টি পাথর। ছোট্ট পাথর দ্বারা আটকে আছে। হুজুর সা:-কে হত্যার উদ্দেশ্যে পাহাড় থেকে এই পাথরগুলো বুড়ি ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ পাকের কুদরতের মাধ্যমে তা প্রতিহত হয়। যা আজো সেভাবেই রয়েছে। পাহাড়ের পাদশেই রয়েছে হুজুর সা: মসজিদ। সঙ্গীরা কেউ কেউ মসজিদে দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করল। দু’পাশে সবুজ বনানী, ফসলের ক্ষেত আর নানা আধুনিক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। আবহাওয়া তাপমাত্রা মক্কায় যখন ৪০-৪২ তখন তায়েফে মাত্র ২৫-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মক্কা-মদিনার পর তায়েফ পবিত্রতার গুরুত্বের দিক থেকে তৃতীয়। এর মাটিতে নানান ধরনের ফসলসহ সুস্বাদু সব ফলের আবাদ হয়। বিভিন্ন ফুলের মধ্যে গোলাপও বেশ চাষাবাদ হয়। গোলাপজল তৈরিতে তায়েফের গোলাপের বেশ খ্যাতি রয়েছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর। ভাত খেলাম এক বাঙালি হেটেলে। দেশীয় সব খাবার। বেশ কিছুকাল পর বেশ আয়েশ করেই খাবার সারলাম। যাচ্ছি এবার শহর থেকে প্রায় ৯৫ কিলোমিটার দূরে হুজুর সা:-এর দুধ মা হালিমার বাড়ি সাদিয়া তায়েফ অঞ্চলে। দ্রুত গতিতে গাড়ি সাদিয়া তায়েফের পথে চলছে। একটা সময় দৃষ্টির সীমানায় শুধুই পাহাড় আর পাহাড়। পুরো সৌদি আরব দেশটাই পাহাড় ঘেরা। চলতে চলতে সম্ভবত ৪০-৪৫ মিনিটের মধ্যেই সাদিয়া তায়েফ পৌঁছে গিয়েছিলাম। আসলে গাড়ির জানালা দিয়ে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে কৃত্রিম আর প্রাকৃতিক রূপ দেখায় বিভোর থাকায়, ঘড়ির কাটায় তেমন খেয়াল রাখা হয়নি। গাড়ি পার্ক করা হলো। কিছুটা পথ হেঁটে প্রথমেই গেলাম হুজুর সা:-কে যে স্থানে সিনা চাক করা হয়েছিল। ওই স্থানে একটি বড়ই গাছ রয়েছে।
অনেকেই বলেন, বড়ই গাছটা নাকি সেই থেকেই। কিন্তু আমার কাছে তা অবিশ্বাস্য। তবে এখানে যে সিনা চাক করা হয়েছিল, তাতে কোনো ভুল নেই। দুঃখের বিষয়- সঙ্গীদের তাড়ার কারণে খুব বেশি তথ্য নিতে পারিনি। তখন আমাদের দে-ছুট ভ্রমণ সঙ্ঘের বন্ধুদের খুব মনে পড়ছিল। গাছের কিছুটা দূরেই কূপ। যেখান থেকে পেয়ারে আখেরি নবী পানি তুলতেন। পুরো অঞ্চলটাই বিশাল বিশাল পাহাড় ঘেরা। পাহাড়ের পাদদেশেই আবাদি জমি। এরপর চলে যাই মা হালিমা রা:-এর বাড়িতে। তেমন কিছু নেই। শুধু ঘরটা পাথর দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বড় বড় পাথর। এসব জায়গাতেই হুজুর সা:-এর শিশুকাল কেটেছে। তাঁর পবিত্র পা’দুটো এসব জায়গাতেই বিচরণ করেছে। ভাবতেই শ্রদ্বায় গা শিওরে উঠে। আবারো সঙ্গীদের তাড়া। কি আর করা। ঠিক গোধূলি লগ্নে গাড়ি সাদিয়া তায়েফ থেকে হুদায়বিয়ারের পথে ছুটে।