ঐতিহ্যে নৌকা
ঐতিহ্যে নৌকা - ছবি : নয়া দিগন্ত
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের জমিনে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদী-খাল। আবহমানকাল থেকে এসব খাল-বিল আর নদীতে বিভিন্ন ধরনের নৌকা সগৌরবে বয়ে চলছে। বর্ষাকাল এলে নৌকার ব্যবহার বেড়ে যায়। নৌকার চালককে বলা হয় মাঝি। নৌকায় বিভিন্ন অংশ থাকে। যেমন : খোল, পাটা, ছই বা ছাউনি, হাল, দাঁড়, পাল, পালের দড়ি, মাস্তল, নোঙর, গলুই, বৈঠা, লগি ও গুণ। নৌকা প্রধানত কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। খোলকে জলনিরোধ করার জন্য আলকাতরা লাগানো হয়।
একসময় বর্ষাকালে মানুষের একমাত্র ও প্রধান বাহনই ছিল নৌকা। তাই এ দেশের শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে নৌকার প্রসঙ্গ বিজড়িত। পনেরো শতকের শেষের দিকের কবি বিপ্রদাস পিপলয় ও মুকুন্দ রায়ের বর্ণনায় বর্ণাঢ্য নাম আর বিবরণের সব নৌকো উঠে এসেছে। কী দারুণ সব নাম! নরেশ্বর, সর্বজয়া, সুমঙ্গল, নবরতœ, চিত্ররেখা, শশিমঙ্গল, মধুকর, দুর্গাবর, গুয়ারেখি, শঙ্খচূড় আরো অনেক। পরবর্তী সময় এবং বর্তমান সময়ের শিল্প, কাব্য আর সাহিত্যেও নৌকার উল্লেখযোগ্য প্রভাব লক্ষণীয়।
গঠনশৈলী ও পরিবহনের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকার প্রচলন রয়েছে। যেমন : ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙ্গি, পাতাম, বাচারি, রফতানি, ঘাসি, সাম্পান, ফেটি ইত্যাদি। এর মধ্যে অধিকাংশই প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিছু একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তপ্রায় কিছু নৌকার বিবরণ নি¤েœ তুলে ধরা হলো।
সাম্পান : ‘সুন্দর সাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে- যাই’- রফিক আজাদের এই কবিতার লাইনের মতোই এ দেশের লোকগীতি ও সাহিত্যের পরতে পরতে এই সাম্পানের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের নৌকার মধ্যে সাম্পান সবচেয়ে পরিচিত। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে বেড়ায় সাম্পান। চট্টগ্রাম আর কুতুবদিয়া এলাকায় সাম্পান নৌকা বেশি দেখা যায়। এই নৌকাগুলোর সামনের দিকটা উঁচু আর বাঁকানো, পিছনটা থাকে সোজা। দীনেশচন্দ্র সেন তার ‘বৃহৎবঙ্গ’তে সাম্পান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘দেখতে এটি হাঁসের মতো। এটি তৈরি হয়েছে চীন দেশের নৌকার আদলে।’
সাম্পান একটি ক্যান্টনিজ শব্দ, যা সাম (তিন) এবং পান (কাঠের টুকরো) থেকে উদ্ভব। আভিধানিক অর্থ ‘তিন টুকরো কাঠ’। একটি সম্পূর্ণ কাঠের টুকরো দিয়ে চ্যাপ্টা তল এবং তার দু’পাশে আস্ত আরো দু’খানা টুকরো জোড়া দিয়ে চায়না সাম্পানের কাঠামো তৈরি হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের সাম্পান আস্ত কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হয় না, বরং তাতে ব্যবহৃত হয় কাঠের সরু ফালি। চট্টগ্রামের সাম্পানের কিছু উপাদানের নকশা হুবহু চায়না সাম্পানের মতো।
বজরা নৌকা : এককালে বাংলার জমিদার এবং বিত্তশালীদের শখের বাহন ছিল বজরা। তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল। এতে খাবার-দাবার ঘুমানোসহ সব সুবিধা থাকত। কোনটাতে পালও থাকত। এতে ৪ জন করে মাঝি থাকত। বর্তমানে বজরা বিলুপ্তি হয়ে গেছে।
ময়ূরপঙ্খী নৌকা : আগেকার দিনের রাজা-বাদশাহদের শৌখিন নৌকার নাম হলো ময়ূরপঙ্খী। এর সামনের দিকটা দেখতে ময়ূরের মতো বলে এর নাম দেয়া হয়েছে ময়ূরপঙ্খী। নৌকাটি চালাতে প্রয়োজন হয় চারজন মাঝির। এই নৌকায় থাকত দুটো করে পাল। ময়মনসিংহে তৈরি হতো এ নৌকা। ১৯৫০ সালের পর থেকে একেবারেই বিলুপ্ত এটি।
বাইচের নৌকা : নৌকা বাংলাদেশে এতটাই জীবনঘনিষ্ঠ ছিল যে, এই নৌকাকে ঘিরে হতো অনেক মজার মজার খেলা। নৌকাবাইচ এখনো একটি জনপ্রিয় খেলা। বর্ষাকালে সাধারণত এ খেলার আয়োজন করা হয়। বাইচের নৌকা লম্বায় ১৫০-২০০ ফুট পর্যন্ত হয়। প্রতিযোগিতার সময় এতে ২৫-১০০ জন পর্যন্ত মাঝি থাকতে পারে।
গয়না নৌকা : গয়না নৌকা কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে বেশি দেখা যেত। মূলত যাত্রী পারাপারের কাজেই এগুলো ব্যবহার করা হতো। এর ওপর বাঁশ দিয়ে তৈরি মাচার ছাদ থাকে। একসঙ্গে প্রায় ২৫-৩০ জন পর্যন্ত যাত্রী বহন করার ক্ষমতা ছিল এই নৌকাটির।
বালার নৌকা : কুষ্টিয়া অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নৌকা ছিল বলার। এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সেই প্রাচীনকাল থেকে এখনো এই নৌকা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই নৌকাগুলো আকারে অনেক বড় হয় এবং প্রায় ১২-৫৬ টন পর্যন্ত মালামাল বহন করতে পারে। এরা দৈর্ঘ্যে ১২-১৮ মিটার হয়ে থাকে। বৈঠা বায় ১০-১২ জন মাঝি। এ ধরনের নৌকায় পাল থাকে দুটো করে।
বাতনাই নৌকা : বালারের মতো খুলনা অঞ্চলে ব্যবহৃত নৌকা বাতনাই বা পদি নামে পরিচিত। এই নৌকাগুলো চালাতে ১৭-১৮ জন মাঝি লাগত। এতে ১৪০-১৬০ টন মাল বহন করা যেত। এই ধরনের নৌকায় থাকত বিশাল আকারের চারকোনা একটি পাল। এসব নৌকা এখন আর বাংলাদেশের কোথাও দেখা যায় না।
ছইওয়ালা (একমালাই) নৌকা : একসময় নৌকায় চড়ে দূরে কোথাও যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ছিল ছইওয়ালা (একমালাই) নৌকা। তবে আজো কোথাও কোথাও দেখা মেলে ছইওয়ালা নৌকার।
পাতাম : এটি দেখা যেত সিলেট ও কিশোরগঞ্জে। মালবাহী নৌকাটির নামকরণ হয়েছে ‘পাতাম’ শব্দ থেকে। এই পাতাম এক ধরনের লোহার কাঁটা। এটি দিয়ে দু’টি কাঠকে জোড়া লাগানো হয়ে থাকে। এ কারণে একে জোড়া নৌকাও বলে। নৌকার বডির কাঠগুলো এমনভাবে জোড়া লাগানো হতো, যেন নৌকার ভেতরে পানি ঢুকতে না পারে।
পানসি বা গস্তি নাও : বর্ষায় ভাটি অঞ্চলে নাইওরি বহনে সুনামগঞ্জের গস্তি নাও এখনো ধরে রেখেছে তার জনপ্রিয়তা। কুটুমবাড়ি বা মামাবাড়িতে বেড়ানোর জন্যও এর কদর আছে। হাওর এলাকায় একে ‘ছইয়া’ বা ‘পানসি নাও’ বলে।
পালতোলা পানসি : সম্রাট আকবরের আমলে পালতোলা পানসি নৌকায় জমিদাররা বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করতে যেতেন। সেই পানসি নৌকা এ দেশ থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ২০০ বছর আগে। গ্রামগঞ্জের নৌপথে চলাচলে ইঞ্জিনচালিত নৌকা এর স্থান দখল করে নিলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর চাহিদা এখনও অফুরন্ত।
মলার : পাবনা অঞ্চলে একসময় নির্মিত হতো মলার নৌকা। এটা মূলত মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হতো। ১২ থেকে ৫৬ টন ওজনের ভার বহনে সক্ষম মলার নৌকায় পাল থাকে দু’টি, দাঁড় ছয়টি। এ ধরনের নৌকাও এখন বিলুপ্তির পথে।
বাছারি : বাছারি নামের নৌকাটিও বাণিজ্যিক নৌকা ছিল। এটি তৈরি হতো রাজশাহীতে। ৪০ টন ওজনের ভার বহনে সক্ষম বাছারি গত কয়েক বছর ধরে বিলুপ্তির পাতায় চলে গেছে।
পটোল : ফরিদপুরের বাণিজ্যিক নৌকা ছিল পটোল। এ নৌকাও প্রায় নিশ্চিহ্ন।
কোসা : ছোটখাটো নৌকা কোসা তৈরি হয় নারায়ণগঞ্জে। এখনো বিভিন্ন অঞ্চলে কোসার প্রচলন আছে।
ডিঙ্গি নৌকা : সবচেয়ে পরিচিত নৌকার নাম হচ্ছে ডিঙ্গি নৌকা। নদীর তীরে যারা বাস করে তারা নদী পারাপার, মাছ ধরা ও অন্যান্য কাজে এই নৌকাটি ব্যবহার করে। আকারে ছোট বলে এই নৌকাটি চালাতে একজন মাঝিই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে এতে পালও লাগানো হয়।