কাশ্মির : যে বার্তা দিচ্ছে বিশ্বকে
কাশ্মির : যে বার্তা দিচ্ছে বিশ্বকে - ছবি : সংগৃহীত
ঠিক আমরা যখন মনে করছি যে অউদার গণতান্ত্রিক প্লেবুকের প্রতিটি কৌশল দেখে ফেলেছি, তখনই বিশেষভাবে উদ্যেমে ভাটা সৃষ্টিকারী একটির আগমন ঘটেছে। তা হলো নরেন্দ্র মোদির কাশ্মিরের দীর্ঘ দিনের স্বায়াত্তশাসন বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় এই এলাকাটি নিয়ে পাকিস্তানের সাথে ৭০ বছর ধরে বিরোধ চলছে।
উপমহাদেশকে ১৯৪৭ সালে দুই ভাগে ভাগ করার সময় অঞ্চলটিকে ভারতকে দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ভারতীয় সংবিধানে থাকা অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর আওতায় জম্মু ও কাশ্মিরকে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়াদি ছাড়া প্রায় সব বিষয়েই স্বায়াত্তশাসন দেয়া হয়। এই অনুচ্ছেদটি মোটামুটিভাবে অনুসরণ করা হয়ে আসছিল। কিন্তু ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সদস্য দেশের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কবিন্দ চলতি মাসের প্রথম দিকে অনুচ্ছেদটি বাতিল করেন।
রাতারাতি কাশ্মিরের ঐতিহাসিক মর্যাদা প্রত্যাহার করা হলো, যোগাযোগব্যবস্থা অচল করে দেয়া হলো। এরপর থেকে হাজার হাজার কাশ্মিরিকে গ্রেফতার করেছে ভারতীয় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ভারত সরকারের পদক্ষেপের পেছনে কিছু ঘটনাও রয়েছে। রাজ্যটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ ভাগ মুসলিম। তারা অব্যাহতভাবে ভারতের জাতিগত শুদ্ধতা অর্জনে আকাঙ্ক্ষী মোদির জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির জন্য অস্বস্তি ও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৯ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা সুসংহত করে তিনি দ্রুত ও সাহসিকতার সাথে হিন্দু ভারতের বিজেপির ভিশন বাস্তবায়নে অগ্রসর হন।
এসব পদক্ষেপ স্থানীয় প্রেক্ষাপটে করা হলেও এর বৈশ্বিক মাত্রাও আছে। আমরা এখন যে যুগে বাস করছি, সেটাকে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিকটর ওরবান ‘অউদার গণতন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এর প্রধান প্রচারক হলেন ওরবান, মোদি, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব এরদোগান, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, আমাদের নিজেদের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তারা সবই একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করেন। তারা তাদের শত্রুদের প্রায়ই সামাজিক মিডিয়ায় অপমান ও মানহানি করেন। তারা সংখ্যালঘু, অভিবাসী ও গরিবদের বিরুদ্ধে প্ররোচনা দেন, অসত্য ও প্রায়ই বর্ণবাদী কথাবার্তা বলেন। তারা সীমান্তগুলোতে প্রতিবন্ধকতা তোলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের থেকে জাতিগত, বর্ণগত বা ধর্মীয়ভাবে ভিন্ন আইন মান্যকারী লোকদের বহিষ্কার করেন।
অতি সাম্প্রতিক সময়ে তাদের অনেকে সচরাচর পরিচিত শত্রুদের বিরুদ্ধে ভূখণ্ড বিরোধে আগ্রাসী পদক্ষেপগুলোকে যৌক্তিক করার জন্য বিদ্যমান বাস্তবতায় পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন। এই অউদার ক্লাবের সদস্যদের চেয়ে একটু এগিয়ে থাকা পুতিন কাজটি করেছেন ২০১৪ সালের মার্চে পূর্ব ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে। জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্বের বেশির ভাগ অংশ এই পদক্ষেপকে অবৈধ সম্প্রসারণ হিসেবে অভিহিত করলেও পুতিন ও তার দোসরেরা তাদের আগ্রাসী কাজকে ক্রিমিয়ার জনসাধারনের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হিসেবেই প্রচার করেছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সামান্যই। পুতিন আগের মতোই কঠোর ও নির্মমই রয়ে গেছেন।
এখন মোদি কাশ্মিরে একই কাজ করেছেন। বিশ্ব যখন আমেরিকায় গণ-গুলিবর্ষণ, বেক্সিট বিশৃঙ্খলা, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো অন্যান্য উদ্বেগজনক ইস্যুর দিকে মনোযোগ দিয়েছে, তখন ভারতীয় সৈন্যরা ওই উত্তপ্ত এলাকায় নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার অজুহাতে ঢুকে পড়েছে। বিশ্ব এক পলকের জন্য দেখেই কর্তৃব্য শেষ করেছে।
প্রথমে ক্রিমিয়া ও এখন কাশ্মিরে এই অকার্যকর প্রতিক্রিয়ার ফলে আরো অউদার বাহিনীর হামলা সময়ের ব্যাপার মাত্র। গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়োজিত নেতানিয়াহু হয়তো পশ্চিম তীর সম্প্রসারণ করে নেবেন।
ইসরাইলি-ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও ভারত ও কাশ্মিরের অবস্থার মধ্যে অবাক করা মিল রয়েছে। উভয়টিই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যিক শাসনের পর ভাগ করার প্রয়াসের উপজাত। কাশ্মির ও পশ্চিম তীর- উভয় স্থানের লোকজনকে তাদের সংশ্লিষ্ট দেশের জাতিগত বিশুদ্ধবাদীরা বৈরী ও অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করে। মোদি ও নেতানিয়াহু উভয়েই তাদের মধ্যে থাকা মুসলিম জনসংখ্যার বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ও হুমকি সৃষ্টিকারী ভাষা প্রয়োগ করতে আগ্রহী। আর উভয়েই ট্রাম্পের কাছ থেকে সক্রিয় (বা ভয়াবহ রকমের নীরব) সমর্থন পেয়ে আসছেন।
নেতানিয়াহু যদি তার বারবার দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পশ্চিম তীর ও এর প্রায় ৩০ লাখ ফিলিস্তিনিকে দখল করে নেন তবে ট্রাম্প কী করবেন? তিনি ও তার অনুসারী অউদাররা পেছনে বসে বসে কর্কশভাবে বলবেন যে এটিই বিশ্বের নতুন পথ?
হয়তো তাই হবে। আর এ কারণেই অউদার নেতারা যখনই অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক পন্থায় তাদের ক্ষমতা সম্প্রসারণের চেষ্টা করেন, আমাদের প্রতিবারই প্রতিবাদ জানাতে হবে। বর্ণ বা জাতিগত অবস্থান-নির্বিশেষে যেসব নাগরিক সংগঠন তাদের দেশের নাগরিকদের সাম্যের জন্য লড়াই করছে, আমাদেরকে অবশ্যই তাদেরকে সমর্থন করতে হবে। আর আমাদের জোর দিয়ে বলতে হবে যে গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে অবশ্য তাদের সংবিধান ও অন্যান্য ভিত্তি নথিপত্রে থাকা মহান নীতিমালার প্রতি সম্মান দেখাতেই হবে। কারণ এগুলোই আজকের অউদারবাদের বিদেশীভীতি, বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সর্বোত্তম প্রতিষেধক।
লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস