শাহাদাত : মহাসত্যের সাক্ষ্য
মহাসত্যের সাক্ষ্য - ছবি : সংগ্রহ
‘শাহাদাত’ আরবি শব্দ। এর অর্থ সাক্ষ্য দেয়া। কিসের সাক্ষ্য? মহাসত্যের সাক্ষ্য। আর এ কারণেই, যে বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে মহাসত্যের সাক্ষ্য মৌখিকভাবে উপস্থাপন করা হয় তাকে বলা হয় কালেমায়ে শাহাদাত। এ বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ‘মুমিন’ হন। কী রয়েছে সে বাণীতে? আল্লাহকে ইলাহ অর্থাৎ সর্বময় ক্ষমতার মালিক ও মুহাম্মদ সা:কে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নেয়ার অঙ্গীকার রয়েছে সে বাণীতে। মূলত কালেমায়ে শাহাদত হলো আল্লাহর দাসত্ব ও মহানবী সা:-এর শর্তহীন আনুগত্য করার চুক্তিনামা।
একজন ব্যক্তি স্বপ্রণোদিত হয়ে যখন এ কালেমা বুঝে পড়েন তখন তার মধ্যে কতগুলো পরিবর্তন আসে। তিনি ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানের অনুবর্তী হন। এভাবে একজন ব্যক্তির চরিত্র ও কর্মে যখন তার মৌখিক স্বীকৃতির (কালেমার) ছাপ পড়ে তখনই তাকে বলা হয় ‘মুসলিম’ অর্থাৎ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী।
একজন মুসলিম যখন পরকালীন জবাবদিহিতার তীক্ষè অনুভূতিতে আল্লাহর ভয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অপছন্দনীয় কাজগুলো বর্জন করেন তখন তিনি হয়ে যান ‘মুত্তাকি’ অর্থাৎ খোদাভীরু।
একজন মুত্তাকি যখন প্রতিটি কাজ নিষ্ঠার সাথে মহান রবের সন্তুষ্টির নিমিত্তে সম্পাদন করেন তখন তিনি হয়ে যান ‘মুহসীন’।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এ ধরনের বান্দাহদের মধ্য থেকেই আল্লাহ কতক বান্দাহকে শাহাদাতের পেয়ালা পান করিয়ে মহা সৌভাগ্য দান করেন। আর আল্লাহর এসব মহান বান্দাহদেরই বলা হয় শহীদ। নবীদের পরে সিদ্দিক আর সিদ্দিকের পরেই শহীদদের স্থান। কারণ এ বান্দাহরা কেবল মৌখিক সাক্ষ্য দিয়ে নয়, কেবল আল্লাহর অনুগত হয়ে নয় বরং এসব কিছু করার পরেও রাসূল প্রেরণের সর্বপ্রধান উদ্দ্যেশ্য- দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজেদের প্রিয় জীবনটাকে পর্যন্ত বিলিয়ে দেন। আর এটাই মহাসত্যের সর্বোচ্চ সাক্ষ্যদান। যারা এ ধরনের সাক্ষ্য প্রদান করেন তারাই শহীদ। শহীদদের ত্যাগ যেমন সর্বোচ্চ, তাই তাদের মর্যাদাও সর্বাধিক।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হওয়ার কষ্ট অনুভব করে না, তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ের কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।’-তিরমিযি। হাদিস থেকে আরো জানা যায়, শহীদরা রঙিন পাখি হয়ে মনের আনন্দে জান্নাতের গাছে গাছে ঘুরে বেড়ান। পরকালে এ মহান বান্দারা রক্তাক্ত অবস্থায় উঠবেন আর তাদের জন্য সেখানে থাকবে বিশেষ মর্যাদা। বিনা হিসাবে তাদের বেহেশত দিয়ে দেয়া হবে। আলমে বরজখেও (কবর জীবন ) তাদের জন্য থাকবে সম্মানজনক জীবিকা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের তোমরা কোনো অবস্থাতেই ‘মৃত’ বলো না, তারা তো জীবিত, তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের ‘রিজিক’ দেয়া হচ্ছে।’ (সূরা আলে-ইমরান : ১৬৯)। তবে এ ধরনের জীবন-জীবিকা এই নশ্বর জীবন-জীবিকা থেকে আলাদা যা মহান রবের একটি বিশেষ ব্যবস্থাপনা। এ ধরনের বিশেষায়িত জীবন-জীবিকা এবং সম্মান কেবল শহীদদের জন্যই বিশেষভাবে বরাদ্দ করা হবে। দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পরও এরা হন অমর। মানুষের মনের মণিকোঠায় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় এরা চিরঞ্জীব হয়ে থাকেন। সত্যের সংগ্রামের ইতিহাসে এরা অনির্বাণ শিখা হয়ে মানুষকে সত্যের পথ দেখান। যখনই সত্য-মিথ্যার আলো আধারির দ্বন্দ্ব সত্য পথকে অস্পষ্ট করে দিতে চায় তখনই শাহাদাতের অনির্বাণ শিখায় সত্যের পথ জ্বল জ্বল করে ওঠে। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না। বস্তুত তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা বুঝতে পার না’। (সূরা বাকারা : ১৫৪)
শহীদরাই মানবতার শ্রেষ্ঠ সন্তান। ঈমানের বাস্তব ও চূড়ান্ত সাক্ষ্য তারাই প্রদান করেন। সত্যের সংগ্রামকে তারাই বেগবান করেন। কবি যথার্থই বলেছেন, ‘ইসলাম জেন্দা হোতা হায় হার কারবালা কি বাদ’। অর্থাৎ প্রত্যেক কারবালার পরেই ইসলাম সঞ্জীবনী শক্তি লাভ করে। যুক্তি ও অভিজ্ঞতাও তাই বলে। ত্যাগের বিনিময়েই অর্জিত হয় সাফাল্য। আর সাফল্যের মর্মসৌধ নির্মাণে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারাই হলেন শহীদ। সর্বকালের সব দেশের শহীদদের জানাই শ্রদ্ধা, আর সশ্রদ্ধ সালাম জানাই তাদের গর্বিত মা-বাবাদের।
লেখক : প্রাবন্ধিক